জিরি মাদ্রাসা মুজাহিদ ক্যাম্প অপারেশন (পটিয়া, চট্টগ্রাম)
জিরি মাদ্রাসা মুজাহিদ ক্যাম্প অপারেশন (পটিয়া, চট্টগ্রাম) পরিচালিত হয় ২০শে আগস্ট। এর ফলে হানাদারদের ১৬টি রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
পটিয়া জিরি মাদ্রাসা ছিল মুজাহিদ ক্যাম্প। পটিয়া পিটিআই হানাদার ক্যাম্প থেকে সেখানে ২০টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল সরবরাহ করা হয়েছিল। ২০শে আগস্ট ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে তাঁর দলের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা, শাহজাহান ইসলামাবাদী গ্রুপ ও সামশুদ্দিন আহমদ গ্রুপ এই ২০টি রাইফেল হস্তগত করার উদ্দেশ্যে জিরি মাদ্রাসায় অপারেশন পরিচালিত করে।
১৯শে আগস্ট রাতে শাহজাহান ইসলামাবাদী গ্রুপ ও সামশুদ্দিন আহমদ গ্রুপের ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা চন্দনাইশ উপজেলার বরকল মৌলভিবাজার থেকে চানখালি নদী ও বুধপুরা খাল হয়ে তিনটি সাম্পানে চড়ে বুধপুরা হাসপাতালের পেছনে আলী নবীর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেই রাতে আলী নবী ও তাঁর মা তাদের যত্ন করে খাওয়ান এবং গোয়াল ঘরে থাকার ব্যবস্থা করেন।
২০শে আগস্ট সকালে ক্যাপ্টেন করিম একজন সঙ্গীসহ সেখানে এসে উপস্থিত হন। তখন সামশুদ্দিন আহমদের সঙ্গে আলাপের মাধ্যমে ক্যাপ্টেন করিম জিরি মাদ্রাসা মুজাহিদ ক্যাম্পে অপারেশন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন এবং তাঁর সঙ্গী লোকটিকে নিজের দলের যোদ্ধাদের এই অপারেশনে অংশ নেয়ার জন্য খবর প্রদানের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন। দুপুরের মধ্যেই করিমের লোকজন চলে আসে। আলী নবীর বাড়িতে সকলের খাওয়া-দাওয়ার পর অপারেশনে যাওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা দুটি দলে বিভক্ত হন। দ্বিতীয় দলকে আগেই জিরি কাজির হাটে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাদের বলা হয়- অপারেশনস্থল থেকে “জয় বাংলা’ ধ্বনি উঠলে তাঁরা মাদ্রাসায় পৌঁছবেন।
অপারেশনে সরাসরি অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত প্রথম দলটি ২টি এলএমজি, ৩টি স্টেনগান, ৩টি রিভলবার, ৭-৮টি গ্রেনেড এবং কয়েকটি মার্ক-৪ রাইফেল সঙ্গে নেয়। সেমাইয়ের খাঁচায় ঘাস দিয়ে তার মধ্যে অস্ত্রগুলো নেয়া হয়। ঘাসের ওপরে নেয়া হয় ১০-১২টি মুরগি। বিকেলে আছরের নামাজের পর এই দলটি পশ্চিমদিকে জিরি মাদ্রাসার উদ্দেশ্যে দুজন-দুজন করে রওনা হয়। খাঁচা বহনকারী এমনভাবে চলতে থাকেন, যেন বাজারে মুরগি বিক্রি করতে যাচ্ছেন। তাঁরা যে-মেঠো পথ দিয়ে হাঁটছিলেন, তার দুপাশে পানিভর্তি বিল। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। মাগরিবের নামাজের সামান্য আগে এই দল মাদ্রাসার নিকটবর্তী হয়ে যার-যার অস্ত্র নিজের কাছে নিয়ে উক্ত মেঠো পথের দুপাশের পানিভর্তি বিলে এম্বুশ নেয়। হঠাৎ তাঁরা দেখেন, মেঠো পথ ধরে মাদ্রাসার পূর্ব গেইটের দিকে এক মাওলানা হেঁটে যাচ্ছে। তার হাতে ল্যাম্প। সে ছিল মুহতামিম। এক যোদ্ধা এম্বুশ থেকে উঠে
এসে তাকে লক্ষ করে অস্ত্র ধরলে অন্যরাও এম্বুশ প্রত্যাহার করে তাকে এগিয়ে নেন পূর্ব গেইটে। ইতোমধ্যে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শূন্যে ফায়ার করলে ভীষণ ভয় পেয়ে মুহতামিম মাদ্রাসার সব অস্ত্র তাদের দিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করে। পূর্ব গেইট তালাবদ্ধ ছিল। এক ক্বারি ভয়ে-ভয়ে এসে তালা খুলে দেয়। তখন মুক্তিযোদ্ধারা মাদ্রাসার ভেতরে ঢুকে দেখেন মাদ্রাসার ছাত্ররা মুক্তিযোদ্ধাদের ফায়ারের আওয়াজে মাদ্রাসার পুকুরে অস্ত্র-শস্ত্র ফেলে আগেই পালিয়েছে। অতঃপর মুহতামিমের নির্দেশে ক্বারি কয়েকজন ছাত্রকে খুঁজে আনলে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশে এই ছাত্ররা পুকুরে নেমে ১৬টি রাইফেল তুলে এনে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে দেয়। ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের আওয়াজ শুনে মাদ্রাসা থেকে দেড়শ-দুশ গজ দূরে কাজিরহাটে অপেক্ষারত তাঁদের দ্বিতীয় দলটিও চলে এসেছিল।
১৬টি রাইফেল উদ্ধারের পর সেগুলো থেকে ৪টি শাহজাহান ইসলামাবাদী গ্রুপ, ৪টি সামশুদ্দিন আহমদ গ্রুপ ও ৪টি ক্যাপ্টেন করিমকে দেয়া হয়। ক্যাপ্টেন করিমের পরামর্শে কাজির হাট থেকে আসা একেবারে নিরস্ত্র আ হ ম নাসিরুদ্দিনকে বোয়ালখালী উপজেলায় একটি মুক্তিযোদ্ধা- গ্রুপ গঠনের জন্য বাকি ৪টি অস্ত্র দেয়া হয়। এ অপারেশনে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম দলে ছিলেন ক্যাপ্টেন করিম ও তাঁর দলের নায়েক আজিজুল হক (পিতা আবদুল হাকিম, শাহমীরপুর কর্ণফুলী), এম এন ইসলাম (পিতা ইসহাক মিয়া, জুলধা, কর্ণফুলী), প্রদ্যোত কুমার পাল দুলাল, ইউসুফ, সোলায়মান, বদিউজ্জামান; শাাহান ইসলামাবাদী ও তাঁর গ্রুপের মোজাহেরুল ইসলাম (পিতা মোহাম্মদ বকস, বাইনজুরি, চন্দনাইশ), মোহাম্মদ আহমদুর রহমান (পিতা আবদুর রহিম, বরকল, চন্দনাইশ); সামশুদ্দিন আহমদ (পিতা আবদুল মন্নান, গোবিন্দারখীল) ও তাঁর গ্রুপের আবুল বশর (পিতা আবুল খায়ের, করল, পটিয়া), আবুল কালাম (পিতা আবদুস সালাম, পটিয়া সদর), সেনা-সদস্য আহমদ ছফা চৌধুরী (উত্তর, গোবিন্দারখীল পটিয়া), আহমদ নবী (হুলাইন, পটিয়া)। দ্বিতীয় দলে ছিলেন আ হ ম নাসিরুদ্দিন (বোয়ালখালী), আবু তাহের সিদ্দিকি, জহির, নুরুল আলম, যদু গোপাল বৈষ্ণব, আবদুস সালাম, আবদুর রশিদ, মনজুর, বারিক, ওবায়েদ প্রমুখ। [শামসুল আরেফীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড