You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর বিক্রম জামাল উদ্দিন

জামাল উদ্দিন, বীর বিক্রম (১৯৫২-১৯৭১) শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৫২ সালে জামালপুর জেলার নান্দিনা উপজেলার আড়ালিয়া গ্রামের গোপালপুর বাজার নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মো. নাসিরউদ্দিন ও মায়ের নাম জয়তুন নেছা। ৪ ভাই ২ বোনের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ। ১৯৭১ সালে তিনি গোপালপুর হাইস্কুলে দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে নান্দিনায় অসহযোগ আন্দোলন-এ অংশ নেন। জামাল উদ্দিন বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
জামাল উদ্দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৫ই এপ্রিল তিনি ঢালু সীমান্ত দিয়ে ভারতের মেঘালয়ের তুরায় যান। তুরা মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণের জন্য গেরিলা বাহিনীতে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হন। ১৬ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে পর্যন্ত এখানে তিনি ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হলে জামাল উদ্দিন ১১ নম্বর সেক্টরের রংড়া সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে প্রথম যুদ্ধে অংশ নেন। জুনের প্রথম সপ্তাহে ১১ নম্বর সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল হুদা তারার নেতৃত্বে জামাল উদ্দিন, হাবিবুর রহমান, আব্দুল জব্বারসহ ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নেত্রকোনার কমলাকান্দা থানায় অপারেশন করার জন্য পায়ে হেঁটে রামপুর সীমান্ত দিয়ে নেংগুরা হয়ে নাজিরপুরে আসেন। এখান থেকে তাঁরা ভোর ৪টার দিকে কমলাকান্দা থানাস্থ পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালান। এ আক্রমণে পাকসেনাদের পরাস্ত করতে না পেরে তাঁরা পিছু হটেন। এর কয়েকদিন পর দ্বিতীয়বার নাজমুল হুদা তারার নেতৃত্বে জামাল উদ্দিনসহ মুক্তিযোদ্ধারা কমলাকান্দা থানায় আক্রমণ করেন। এবার মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা আহত হয় এবং তারা পিছু হটে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ক্যাম্প থেকে কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করেন।
১৫ জন পাকসেনা ও কয়েকজন রাজাকার নেত্রকোনার থাকড়াকোণা ব্রিজ পাহারা দিত। নাজমুল হুদা তারা ব্রিজ পাহারারত পাকসেনা ও রাজাকারদের ওপর জুন মাসে আক্রমণ করেন। এ আক্রমণে জামাল উদ্দিন অংশগ্রহণ করেন। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের প্রায় ১ ঘণ্টা গুলি বিনিময় হয়। এ-যুদ্ধে ৬ জন রাজাকার ধরা পড়ে। তারা পরে ভারতের রংড়া ক্যাম্পে নিহত হয়। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে জামাল উদ্দিন কমলাকান্দার বড়াইল নদীতে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর পরিচালিত মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে অংশ নেন। এ আক্রমণের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে পাকিস্তানি সেনাদের নৌকা ডুবে যায়। ১৫-২০ জন পাকসেনা নৌকা থেকে নেমে পালিয়ে যায়।
২৬শে জুলাই নেত্রকোনা জেলার কমলাকান্দা উপজেলার নাজিরপুর বাজার সংলগ্ন নদী দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর রেশন নিয়ে যাওয়া একটি লঞ্চের ওপর নাজমুল হুদা তারার নেতৃত্বে জামাল উদ্দিনসহ ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধা আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির শব্দ শোনামাত্র পাকসেনারা পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকে। কিছুক্ষণ পর তারা গুলি ছোড়া বন্ধ করে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছুড়তে থাকেন। জামাল উদ্দিনের এইচএমজি-র গুলিতে ১৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ২ ঘণ্টা যুদ্ধ করার পরও পাকিস্তানি সেনারা পাল্টা কোনো গুলি না ছোড়ায় ভোর ৫টার দিকে নাজমুল হুদা তারাসহ মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা ‘জয় বাংলা’ বলে দাঁড়াতেই লঞ্চ থেকে আহত এক পাকিস্তানি সেনা তাঁদের লক্ষ করে এলএমজি-র ব্রাশফায়ার করে। এতে জামাল উদ্দিনসহ ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শহীদ অন্য মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— নুরুজ্জামান, ইয়ার মামুদ, ভবতোষ চন্দ্র দাস, দ্বিজেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস, ডা. আব্দুল আজীজ ও ফজলুল হক। নাজমুল হুদা তারা গলায় গুলিবিদ্ধ হন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে আত্মদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার জামাল উদ্দিনকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করে। [রীতা ভৌমিক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!