You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে জামালগঞ্জ উপজেলা (সুনামগঞ্জ)

জামালগঞ্জ উপজেলা (সুনামগঞ্জ) ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপরই পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ জনতা উপজেলার প্রতিটি বাড়িতে কালো পতাকা উত্তোলন করে। সুনামগঞ্জ মহকুমা পর্যায়ে গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। বারো সদস্যবিশিষ্ট এ পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরী এমএনএ। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুদ্ধের কথা চিন্তা করে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন থানার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে অন্যান্য থানার মতো জামালগঞ্জেও গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। এ পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন আব্দুর রহমান তালুকদার (সাচনা) এবং সদস্য ছিলেন- জমিরউদ্দিন মাস্টার (সেলাইয়া), সাদেক আলী (সাচনা), নিশিরঞ্জন ঘোষচৌধুরী (সাচনা), নির্মলেন্দু ঘোষচৌধুরী (সাচনা), ঋষিকেষ রায় (সাচনা), নজির মিয়া (শেরমস্তপুর), আলী আমজাদ চৌধুরী (ফেনারবাঁক), হিমাংশু রায় (কলত খাঁ), সুখময় সরকার (সাচনা), গোপেশ তালুকদার (গঙ্গাধরপুর) এবং অমূল্য পুরকায়স্থ (বেহেলী)। সংগ্রাম পরিষদ এলাকার ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করেন।
উপর্যুক্ত ব্যক্তিবর্গ পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া কমরেড প্রসূন কান্তি রায় ওরফে বরুণ রায়, সাদেক আলী (সাচনা), রাকেশ তালুকদার, আব্দুল মান্নান তালুকদার, আব্দুল হামিদ মাস্টার, আব্দুল জলিল তালুকদার, অজিত লাল রায় প্রমুখও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন আব্দুল জব্বার মিয়া (দক্ষিণ কামলাবাজ) ও আব্দুল লতিফ (ফজিলপুর)। আব্দুল লতিফ ছিলেন আনসার ভিডিপির প্লাটুন কমান্ডার। তিনি বাণিজ্যিক কেন্দ্র সাচনা বাজারের নিরাপত্তার জন্য জামালগঞ্জ থানার ওসি বড়ুয়ার কাছ থেকে ১টি রাইফেল ও ১০০ রাউন্ড গুলি সংগ্রহ করেন এবং তাঁর দুই সহোদরকে বিভিন্ন সেক্টরে গিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণের আদেশ দেন। পরে তিনি যুদ্ধ করার জন্য বালাট যান। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকবাহিনী জামালগঞ্জে প্রবেশ করে এবং সাচনা বাজার মাদ্রাসার পাশে ক্যাম্প ও সাচনা বাজারে ১০টি বাংকার স্থাপন করে। পাকবাহিনীকে যারা সাহায্য করে তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়রা হলো- মফিজউদ্দিন (ফেনারবাঁগ, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি পিডিপি), শানুর আলী (রাধানগর, পিডিপি), সিরাজুল ইসলাম (শুকদেবপুর, জামায়াতে ইসলামী), আজহার আলী (লম্বাবাগ, পিডিপি), শাহেদ আলী (হিন্দুকালিপুর, পিডিপি), আব্দুল আজিজ (চানপুর, পিডিপি), জমশেদ আলী (তেরানগর, পিডিপি), সাইফুল ইসলাম (সাচনা বাজার, জামায়াতে ইসলামী), আব্দুল কাদির (নয়া হালট, পিডিপি), আবুবকর (নয়া হালট, পিডিপি), আবুল খায়ের (বিছনা, পিডিপি), সিদ্দিক আলী পণ্ডিত (বিছনা, জামায়াতে ইসলামী) প্রমুখ। মার্চ মাসের শেষদিকে জামালগঞ্জে স্বাধীনতাবিরোধী শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এর নেতৃত্বে ছিল আবুল মনসুর আহমেদ ওরফে লাল মিয়া (সভাপতি), আব্দুল বারিক চৌধুরী (সহ-সভাপতি), আব্দুস সাত্তার পীর (সহ-সভাপতি), সোনা মিয়া তালুকদার (সেক্রেটারি) এবং আব্দুল মতিন (সহ-সেক্রেটারি)। এপ্রিল মাসে পাকবাহিনীর প্রবেশের পর তাদের সহযোগিতায় রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। এর নেতৃত্বে ছিল শামছুল আলম ঝুনু (লক্ষীপুর) ও আব্দুল ওয়াহেদ (দক্ষিণ কামলাবাজ)। এ উপজেলায় তিনশতাধিক রাজাকার সদস্য ছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিল খুবই ভয়ানক ও দুর্ধর্ষ। পাকবাহিনীর ছত্রছায়ায় তারা পাঞ্জাবি আব্দুল গফুর (লাল বান্দর নামে পরিচিত) ও আব্দুর রেজ্জাক (কিলার নামে পরিচিত)-এর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নানারকম তৎপরতা চালায়। তাদের কাজই ছিল হত্যা, নারীনির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড সংঘটিত করা।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিবাহিনী জামালগঞ্জের ওয়াপদা ভবন থেকে তিনজন পাকসেনার অস্ত্র কেড়ে নিলে সুনামগঞ্জ থেকে পাকসেনাদের একটি দল জামালগঞ্জ এসে অন্যান্যদের সঙ্গে কাজী সাদ উল্লাহ ও আনসার কমান্ডার আবদুল জব্বারকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর আর এ-দুজনের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান লাল মিয়া কয়েকজন রাজাকারসহ সশস্ত্র অবস্থায় কাজীরগাঁও গ্রামের নিকট থেকে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে যায় এবং যাবার সময় এ গ্রামের সব বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়। কয়েকদিন পর একইভাবে কালীপুর গ্রামের অধিকাংশ বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। পরে তারা জামালগঞ্জ সদরের নিকটস্থ কামলাবাজ গ্রামে একাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের কেউ আর ফিরে আসতে পারেননি। রাজাকাররা সাচনা বাজারসহ আশপাশের সকল হিন্দুগ্রাম লুট করে। জামালগঞ্জে অনেক নারীনির্যাতনের ঘটনাও ঘটে।
পাকবাহিনী সাচনা বাজারের মসজিদের নিকট স্থাপিত বাংকার ও মাদ্রাসার পাশে অবস্থিত ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য ও মহিলাদের তুলে নিয়ে নির্যাতন করত। কমান্ডার আব্দুল লতিফ বালাট থেকে জামালগঞ্জে এসে দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরী এমএনএ, মাস্টার জমির আলী, আ. রহমান (রহমান মিয়া), মফিজ মিয়া, নবীগঞ্জের রেজ্জাক মিয়া ও শফিক মিয়া, ইটনা-মিটামইনের জালাল উদ্দিনসহ ৪০ জনের একটি মুক্তিবাহিনী নিয়ে জামালগঞ্জ থানার ওসি বড়ুয়ার পরামর্শে দিরাই থানার হাতিয়া গ্রামের ছাত্রনেতা আবু তালেবের বাড়িতে ক্যাম্প করেন এবং সেখান থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তাঁরা দিরাই-পাইবদা গ্রামের ডাকাত কালা মিয়ার বাড়ি থেকে ২টি রাইফেলসহ বেশকিছু গোলাবারুদ উদ্ধার করেন। ইপিআর নায়েক আ. রেজ্জাক ছিলেন এ গ্রুপের কমান্ডার।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহিম খলিল ও আসাদউল্লাহ সরকারের নেতৃত্বে স্থানীয় গ্রামবাসী ধানকুনিয়া হাওরের ওয়াপদা ভবনে অবস্থানরত ৩ জন পাকসেনার অস্ত্র কেড়ে নেয়। জামালগঞ্জ উপজেলায় এটিই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম অপারেশন। এরপর ৩রা জুলাই ভোর ৪টায় কমান্ডার আব্দুল লতিফের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা দিরাই থানা অপারেশন করেন এবং হানাদারদের হটিয়ে থানা দখল করেন। ২৯শে জুলাই সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলীর পরিকল্পনা ও নিদের্শনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের একাধিক গ্রুপ কমান্ডার আব্দুল হাই, জগৎজ্যোতি দাস, বীর বিক্রম-, মোজাহিদ মিয়া প্রমুখের নেতৃত্বে সাচনা বাজারে স্থাপিত পাকবাহিনী ও রাজাকারদের ক্যাম্প ও বাংকার একযোগে আক্রমণ করলে দুপক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে ৩৫ জন পাকসেনা ও অনেক রাজাকার নিহত হয় এবং বাকি পাকসেনা ও রাজাকাররা পালিয়ে যায়। এ ঘটনা সাচনা বাজার ক্যাম্প ও বাংকার অপারেশন নামে পরিচিত। ৪ঠা ডিসেম্বর জামালগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
জামালগঞ্জ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আবুল কাশেম (পিতা চান মিয়া, কালীপুর তাহিরপুর; উপজেলা যুদ্ধে শহীদ), জাকির মোল্লা (পিতা মো. ছবুর মোল্লা, হরিনাকান্দি), মন্তাজ আলী (পিতা আব্দুল গণি, উত্তর কামলাবাজ), নানু মিয়া নানু মিয়া (পিতা (পিতা দেওয়ান আলী, কাজী মফিজনগর), আব্দুল আউয়াল (পিতা আপ্তাব উদ্দিন, পলক), মাহমুদ আলী (পিতা সমুজ আলী, পলক), সাদ উল্লাহ (পিতা সেকান্দার মামুদ, জামালগঞ্জ সদর), আব্দুল জব্বার (পিতা চেরাগ আলী সরকার, দক্ষিণ কামলাবাজ), আলাউদ্দিন (পিতা উছমান তালুকদার, চানপুর), মাকসুদ আলী (পিতা সমুজ আলী, পলক), মনফর আলী (পিতা জোনাদ আলী, লম্বাবাগ) এবং আমযত আলী (পিতা উজির আলী, দক্ষিণ কামলাবাজ)।
জামালগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সাচনা বাজারে শহীদ সিরাজুল ইসলামের নামে একটি শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে। সিরাজুল ইসলামের পৈতৃক বাড়ি ছিল কিশোরগঞ্জে। তাঁর নামে সাচনা বাজারের নাম “সিরাজনগর রাখা হয়েছিল। ‘৭৫-এর পরে তা পরিবর্তন করা হয়। [আকবর হোসেন]
তথ্যসূত্র: বজলুল মজিদ খসরু, রক্তাক্ত একাত্তর; গোলাম মর্তুজা, জামালগঞ্জের ইতিহাস; জামালগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড কর্তৃক প্রদত্ত তালিকা

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!