You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.09 | জামালপুর সদর যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক

জামালপুর সদর যুদ্ধ

জামালপুর সদর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৯ই ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর নেতৃত্বে। এ-যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন আজিজ এবং মিত্রবাহিনী-র নেতৃত্ব দেন ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লেয়ার। যুদ্ধে পাকবাহিনীর বহু সৈন্য হতাহত ও ৬১ জন বন্দি হয় এবং তিনশতাধিক সৈন্য যৌথবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। অপরদিকে যৌথবাহিনীর ১২ জন সৈন্য শহীদ এবং ৮ জন আহত হন। ৪ঠা ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্তিশালী কামালপুর ঘাঁটির পতনের পর যৌথবাহিনী দুটি কলামে বিভক্ত হয়ে জামালপুরের দিকে অগ্রসর হয়। একটি কলামে ছিল ১ মারাঠা রেজিমেন্ট, অপর একটি কলামে ছিল ১৩ গার্ড রেজিমেন্ট। যৌথবাহিনী জামালপুর সদরকে দুদিক থেকে ঘেরাও করে ঢাকাগামী পথে অবরোধ সৃষ্টি করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার কৌশল গ্রহণ করে।
১ মারাঠা রেজিমেন্টের দলটি কামালপুর থেকে জামালপুরের দিকে মার্চ করে ৪নং চরে আসার পর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল অরোরা আসেন এবং প্রয়োজনীয় ব্রিফিং দেন। এরপর মারাঠা রেজিমেন্টের দলটি ব্রহ্মপুত্র নদ অতিক্রম করে ভাবকি নামক গ্রামে এসে পৌঁছায়। এদিকে পাকিস্তানি বাহিনী পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদকে সামনে রেখে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে। সীমান্তবর্তী সকল ঘাঁটি থেকে সরে আসা পাকিস্তানি সেনারা জামালপুরে সমবেত হওয়ায় জামালপুরের প্রতিরক্ষা অত্যন্ত জোরালো হয়ে ওঠে। জামালপুরে মোতায়েন ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান মাহমুদ প্রতিরোধ যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করে। সে ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ তীর বরাবর প্রায় নান্দিনা পর্যন্ত স্থানে-স্থানে বাঙ্কার তৈরি করে অগ্রসরমাণ যৌথবাহিনীকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা চালায়।
জামালপুরে পাকিস্তানিদের মূল দুর্গটি ছিল পিটিআই ভবন। সীমান্তবর্তী সকল ঘাঁটি থেকে হটে এসে পিটিআই-তে জমা হয়েছিল এক ব্যাটালিয়নেরও বেশি পাকিস্তানি সৈন্য। ৮ই ডিসেম্বরের মধ্যে ১ মারাঠা রেজিমেন্ট ও ১৩ গার্ড রেজিমেন্ট পিটিআই-র চারদিকে বেষ্টনী গড়ে তোলে এবং পিটিআই-র আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
এদিকে ৮ই ডিসেম্বর বিকেলের দিকে মারাঠা রেজিমেন্টের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার কর্নেল ব্রারকে সঙ্গে নিয়ে একটি হেলিকপ্টারে করে মিত্রবাহিনীর অবস্থানে এসে পৌঁছান। সঙ্গে আরো ছিল ১১নং সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল তাহেরের ভাই মুক্তিযোদ্ধা আবু ইউসুফ খান। ৯ই ডিসেম্বর বিকেলে ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার পিটিআই ক্যাম্পে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান মাহমুদের কাছে আত্মসমপর্ণের আহ্বান জানিয়ে একটি চিঠি পাঠান এবং চিঠির জবাব সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার মধ্যে দেয়ার জন্য তাতে উল্লেখ করেন। পিটিআই ক্যাম্পে চিঠিটি নিয়ে যায় কৃষকের ছদ্মবেশে মুক্তিযোদ্ধা মুন্সী জহুরুল হক।
চিঠি পেয়ে লে. কর্নেল সুলতান মাহমুদ ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। চিঠি বহনের অপরাধে মুন্সী জহুরুল হকের ওপর নেমে আসে ভয়াবহ নির্যাতন। লে. কর্নেল সুলতান মাহমুদ আত্মসমপর্ণের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে এবং যুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারের চিঠির জবাব দেয়। চিঠির জবাব পাঠায় পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনে আহত মুন্সী জহুরুল হকেরই মাধ্যমে। ঐ চিঠির সঙ্গে একটি চাইনিজ বুলেটও মুড়ে দেয়।
চিঠির জবাব পাওয়ার পরই মিত্রবাহিনীর দুটি মিগ বিমান ওয়াপদা রেস্টহাউস ও পিটিআই-র ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। যৌথবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে পরাজয় অনিবার্য বুঝতে পেরে লে. কর্নেল সুলতান মাহমুদ রাতের অন্ধকারে যৌথবাহিনীর বেষ্টনী ভেদ করে ঢাকার পথে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সে ৩১ বালুচ বাহিনীকে দুটি গ্রুপে ভাগ করে। প্রথম গ্রুপে থাকে সে নিজে। গ্রুপটি তিনটি কলামে অগ্রসর হতে থাকে। এদিকে মারাঠা রেজিমেন্টের জওয়ানরা রাস্তার কাছে পজিশন নিয়ে অবস্থান করছিলেন। রাতের অন্ধকারে তাদের দেখা যায়নি। অগ্রসরমাণ বালুচ গ্রুপটি তাদের আক্রমণের সীমার মধ্যে গিয়ে পড়ামাত্র শুরু হয় মিত্রবাহিনীর প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও পাল্টা গুলি চালায়। প্রচুর গোলাগুলির পর ভোর চারটার দিকে যুদ্ধ শেষ হয়। এ-যুদ্ধে ২৩৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত, ২৩ জন আহত, আর মিত্রবাহিনীর হাতে ৬১ জন বন্দি হয়। তবে কর্নেল সুলতান মাহমুদ কিছু সংখ্যক সৈন্য নিয়ে ঢাকার পথে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। তার গ্রুপের পরাজয়ের পর পিটিআই-তে অবস্থানকারী ৩১ বালুচের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ৩৭৬ জন সৈন্য নিয়ে যৌথবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। এ-যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর ১ জন মারাঠা সৈন্য, লাইন ইনফ্যান্ট্রির ১০ জন ও ১৩ গার্ড রেজিমেন্টের ১ জন সৈন্য শহীদ এবং ৮ জন সৈন্য আহত হন। ১০ই ডিসেম্বর জামালপুর শত্রুমুক্ত হয়। পরদিন ১১ই ডিসেম্বর ভোরে ফয়েজুর কোম্পানি চন্দ্রার ঘুন্টি অতিক্রম করে জামালপুর শহরে প্রবেশ করে এবং যৌথবাহিনীর সামরিক কর্তাব্যক্তিদের উপস্থিতিতে কোম্পানি কমান্ডার ফয়েজুর রহমান জামালপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। [আহমদ আজিজ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড