জাগীর ব্রিজ অপারেশন (মানিকগঞ্জ সদর)
জাগীর ব্রিজ অপারেশন (মানিকগঞ্জ সদর) পরিচালিত হয় আগস্ট মাসের শেষদিকে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মানিকগঞ্জ জেলা বাসস্ট্যান্ড থেকে ঢাকার দিকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে জাগীর ব্রিজের অবস্থান। এ ব্রিজে বিহারি ও স্থানীয় রাজাকার এবং কিছু ইপিআর সদস্য পাহারায় থাকত। মুক্তিযোদ্ধারা এ ব্রিজে অপারেশন পরিচালনা করলে বিহারি রাজাকাররা নিহত এবং ইপিআর সদস্য ও স্থানীয় রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে।
জাগীর ব্রিজ স্থানীয়ভাবে ধলেশ্বরী ব্রিজ নামে পরিচিত। ১৯৭১-এ এ ব্রিজের অপরিসীম গুরুত্ব ছিল। উত্তরবঙ্গে যাবার একমাত্র রাস্তায় এ ব্রিজের অবস্থান ছিল। পাকবাহিনী মানিকগঞ্জ শহর ও অন্যান্য থানা এলাকা দখল করে নিলেও প্রথমদিকে এ ব্রিজে পাহাড়া বসায়নি। ঢাকা-আরিচা সড়কের নয়াডিঙ্গী ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর পাকবাহিনী জাগীর ব্রিজে ইপিআর ও রাজাকারদের পাহারায় বসায়। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে প্রয়োজনীয় অস্ত্র আসার পর তাঁরা ছোট-ছোট অপারেশন চালানোর চেষ্টা করেন। জাগীর অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের ২-৩টি গ্রুপ এ ব্রিজে আক্রমণের পরিকল্পনা করে ও পাহারারত রাজাকারদের শক্তি সম্বন্ধে ধারণা নেয়। বিশেষ করে যেসব রাজাকার পাহারায় থাকত, তাদের আত্মীয়-স্বজন মারফত আত্মসমর্পণ করার প্রস্তাব দেয়া হয়। রাজাকারদের ভয়ও দেখানো হয় এবং তাদের বোঝানো হয় যে, তাদের সময় শেষ। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। বিভিন্নভাবে মানসিক চাপও সৃষ্টি করা হয়।
আগস্টের শেষদিকে ১০-১২ জন মুক্তিযোদ্ধা রাতে দুদিক থেকে জাগীর ব্রিজ আক্রমণ করলে স্থানীয় রাজাকাররা অস্ত্র ফেলে ব্রিজ থেকে নদীতে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে যায়। পরে তারা পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এ ঘটনা এত সহজে হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। ঘটনার খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের মনোবল দুর্বল হয়ে পড়ে। ২-৩ দিন পর পাকসেনারা আবার কয়েকজন ইপিআর সদস্য, বিহারি রাজাকার ও স্থানীয় রাজাকারকে পাহারায় বসায়। তারা ব্রিজের ওপর বাস থামিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা কেড়ে নিত ও তাদের মারধর করত। এরপর আবার স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায় যে, ইপিআর সদস্যরা বাঙালি এবং অনেকে আহত। তবুও তাঁদের জোর করে ডিউটিতে পাঠানো হয়। বিহারি কয়েকজন রাজাকারকে ঢাকার মিরপুর থেকে আনা হয়। সেদু নামের এক রাজাকারের সঙ্গে আলোচনা করে আক্রমণের দিন ঠিক করা হয়। কিন্তু নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বেশ কয়েকবার দিন বদলানো হয়। ওখান থেকে রাজাকারদের পালাতে দিলে কীভাবে কোন দিকে যাবে এসবও আলোচনায় ঠিক করা হয়। এরপর তিন দিক থেকে ৩০-৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা জাগীর ব্রিজে আক্রমণ চালান। আক্রমণের খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিহারি রাজাকাররা নিহত হয়। আহত ইপিআর সদস্য ও স্থানীয় রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে।
জাগীর ব্রিজ অপারেশন থেকে অনেক অস্ত্র পাওয়া যায়। এরপর জাগীর ব্রিজে পাকসেনা বা তাদের সহযোগীদের আর দেখা যায়নি। এ ব্রিজ অপারেশনে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এখানে কেউ কমান্ডার অথবা নেতা ছিলেন না। সবাই বাস্তবতা বুঝে এ অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। এ-যুদ্ধ ছিল অনেকটা মানসিক কৌশলের। কৌশল করেই জয়লাভ করা হয়। এ অপারেশনে আব্দুস সালাম বুলু, মোজাম্মেল হক পাখী ও অন্য অনেক মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। [মো. শহীদুল ইসলাম ফারুক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড