জাঠিভাঙ্গা গণহত্যা (ঠাকুরগাঁও সদর)
জাঠিভাঙ্গা গণহত্যা (ঠাকুরগাঁও সদর) সংঘটিত হয় ২৩শে এপ্রিল। ঠাকুরগাঁও সদর থানার শুখানপুখরী ইউনিয়নের জাঠিভাঙ্গা গ্রামে পাকবাহিনী এ ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত করে। সমগ্র দেশের মধ্যে অন্যতম বৃহৎ ও নৃশংস এ গণহত্যায় প্রায় ৩ হাজার নারী-পুরুষ নিহত হন। কয়েক শত নারী এখানে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। এ গণহত্যায় যারা পাকবাহিনীকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে, সেই মানবতাবিরোধীদের এখনো বিচার হয়নি।
ঠাকুরগাঁও-এ অনুপ্রবেশের পর পাকবাহিনী একের পর হত্যাকাণ্ড চালিয়ে পুরো এলাকাকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে। হানাদারদের কবল থেকে বাঁচার জন্য সাধারণ মানুষ প্রত্যন্ত গ্রামে আশ্রয় নিতে থাকে। অনেকে বিভিন্ন গ্রামের ঝোপ-ঝাড় ও জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। কিন্তু তারপরও যখন প্রাণরক্ষা সম্ভব হচ্ছিল না, তখন সবকিছু ফেলে অনেকে দেশত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জগন্নাথপুর, চকহলদি, সিঙ্গিয়া, চণ্ডিপুর, আলমপুর, বাসুদেবপুর, গৌরীপুর, মিলনপুর, খামার ভোপলা, শুখানপুখরী, ঢাবঢুড প্রভৃতি গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার অসহায় মানুষ দেশান্তরী হতে হেঁটে সীমান্তের দিকে রওনা দেয়। সীমান্তের দিকে যাওয়ার পথে জাঠিভাঙ্গার কাছে ২২শে এপ্রিল কিছু দালাল তাদের বাধা দেয়। তারা ভারতে যাওয়া চলবে না বলে হুমকি দেয়। এ অবস্থায় তারা কোনোরকমে রাত কাটানোর জন্য জাঠিভাঙ্গা গ্রামে আশ্রয় নেয়। কিন্তু স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে খবর পেয়ে ঠাকুরগাঁও ইপিআর ক্যাম্পের সেনাছাউনি থেকে দুই লরি বোঝাই সশস্ত্র পাকসেনা এসে ২৩শে এপ্রিল ভোরে তাদের ওপর হামলা করে। পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রথমে তাদের ঘেরাও করে ফেলে। পরে বাড়িঘর থেকে পুরুষদের বের করে এনে পাথরাজ নদীর চরায় লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ হত্যাযজ্ঞ চলতে থাকে বিকেল পর্যন্ত। এরপর তারা নারীদের ধর্ষণ করে। পাকসেনা ও রাজাকাররা হত্যা ও ধর্ষণের নারকীয় উল্লাসে মেতে ওঠে। সারাদিনে পাকসেনারা এখানে প্রায় ৩ হাজার মানুষকে হত্যা করে। শিশুরাও বাদ যায়নি হত্যাযজ্ঞ থেকে। অনেকে গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হয়। তৃপানন নামে একজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মৃতের ভান করে লাশের ওপর পড়েছিল। পরে পালিয়ে জীবন রক্ষা করে।
সেদিন যাদের প্রত্যক্ষ মদদে এত নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারায়, তাদের চিহ্নিত করা হয়নি। দেশের অনেক গণহত্যার বিচার শুরু হলেও ঠাকুরগাঁওয়ের জাঠিভাঙ্গা গণহত্যার জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা হয়নি। ৩৫০ জন বিধবা এ গণহত্যার বিচারের দাবি উত্থাপন করেছেন। এখানে পরে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। [মনতোষ কুমার দে]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড