You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে নির্মিত সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ভাস্কর্য জাতীয় স্মৃতিসৌধ (সাভার, ঢাকা)

জাতীয় স্মৃতিসৌধ (সাভার, ঢাকা) মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে নির্মিত সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ভাস্কর্য। সাভার উপজেলার নবীনগরে এটি অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ স্থানটি ছিল জঙ্গলাকীর্ণ এবং এখানে ছিল কয়েকটি ছোট- ছোট টিলা আকৃতির মাটির ঢিবি। এখানে কোনো বধ্যভূমি বা গণকবর ছিল না। স্মৃতিসৌধের অভ্যন্তরে একটি কৃত্রিম গণকবর রয়েছে।
বাংলাদেশের আপামর জনগণ এক রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মাধ্যমে মহান স্বাধীনতা অর্জন করে। এ-অর্জনে ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মদান, কয়েক লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম, প্রাণ বাঁচাতে এক কোটি লোকের দেশত্যাগ, দেশের অভ্যন্তরে জনগণের ওপর নির্মম নির্যাতন, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে বাড়িঘর ছারখার করার মতো ঘটনার পরও অকুতোভয় বীর বাঙালিরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়। বিশ্বমানচিত্রে প্রতিষ্ঠা পায় স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধোত্তর ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের গৌরবান্বিত অধ্যায় জাতীয় জীবন ও বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রস্থল থেকে ৩৬.৬ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে সাভার উপজেলার নবীনগরের দক্ষিণ দিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে ১০৮.৭ একর জমির ওপর জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। স্থানটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ও দৃষ্টিনন্দন হওয়ায় বীর শহীদদের সর্ব্বোচ্চ ত্যাগের পুণ্যস্মৃতির পাদপীঠ হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়। ১৯৭২ সালের জুলাই মাস থেকে এর কার্যক্রম শুরু হয় এবং একই বছর ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বঙ্গবন্ধু এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। তিনি ঐদিনই বীর শহীদদের আত্মদানের পুণ্যময় স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মৃতিসৌধের বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্দেশ্যে ৫৭ জন বরেণ্য স্থপতির নিকট থেকে নকশা আহ্বান করা হয়। তন্মধ্যে স্থপতি সৈয়দ মঈনুল হোসেন (১৯৫২-২০১৪)-এর নকশাটি অনুমোদিত হয়। ত্রিভুজাকৃতির সাতটি স্তম্ভ ৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন পর্যন্ত ঘটনাবলি ধারাবাহিকভাবে স্বতন্ত্র মহিমায় স্মৃতিসৌধের মূল বেদির পেছন দিক থেকে সম্মুখ দিকে ছোট থেকে ক্রমান্বয়ে বড়টি স্থাপিত হয়েছে এবং প্রতিটি স্তম্ভ ক্রমান্বয়ে সরু হয়ে আকাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। স্মৃতিসৌধের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সর্বোচ্চ স্তম্ভটির দিকে তাকালে একের ভেতর বহু রূপ প্রকাশ পায়। স্মৃতিসৌধটির শীর্ষবিন্দু ভূমি থেকে ১৫০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত।
১৯৭২ সালের জুলাই থেকে ১৯৮৮ সালের জুনের মধ্যে তিনটি পর্বে ১২৫১.৬৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে স্মৃতিসৌধের নির্মাণ শেষ হয়। এর মূল বেদির সামনে একটি কৃত্রিম হ্রদ রয়েছে। সাঁকো পার হয়ে স্মৃতিসৌধে যেতে হয়। এখানে রয়েছে ১০টি গণসমাধি। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় দেশের সর্বত্র মুক্তিকামী মানুষদের হত্যা করা হয়। প্রতীক হিসেবে তাদের কয়েকজনের দেহাবশেষ সংগ্রহ করে স্মৃতিসৌধের গণসমাধিতে সমাহিত করা হয়েছে। সমাধির পার্শ্ববর্তী প্রাচীর গাত্রে ম্যুরালের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও যুদ্ধের ইতিহাসের প্রতিফলন ঘটেছে।
স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণের চতুষ্পার্শ্ব পরিবেষ্টনকারী ২৪ একর জায়গায় বিভিন্ন রকমের বৃক্ষ দিয়ে এক সবুজ বলয় সৃষ্টি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে এক দৃষ্টিনন্দন ও ভাবগম্ভীর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। এখানে অভ্যর্থনা কেন্দ্র, মুক্তমঞ্চ, সবুজ ঘর, হেলিপ্যাড ও গাড়ি পার্কিং-এর সুবিধা রয়েছে। স্মৃতিসৌধ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে গণপূর্ত বিভাগ। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে এখানে শহীদদের উদ্দেশে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। এছাড়া সারা বছরই দেশী-বিদেশী পর্যটকরা স্মৃতিসৌধ দর্শনে আসেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে যে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ হয়, তাতে আপামর জনসাধারণের বীরত্বপূর্ণ লড়াই ও মাতৃভূমির জন্য অকুতোভয় বীর শহীদদের সর্ব্বোচ্চ আত্মত্যাগের গৌরবান্বিত স্মৃতিবিজড়িত এ স্মৃতিসৌধের পাদপীঠে দাঁড়ালে বিনম্র শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। [খন্দকার ম. হামিদ রঞ্জু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!