You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.02 | জান্দী গণহত্যা (ভাঙ্গা, ফরিদপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

জান্দী গণহত্যা (ভাঙ্গা, ফরিদপুর)

জান্দী গণহত্যা (ভাঙ্গা, ফরিদপুর) সংঘটিত হয় ২রা মে পাকবাহিনী কর্তৃক। ভয়াবহ এ গণহত্যায় ৪০ জনের মতো মানুষ শহীদ হন।
জান্দী ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার তুজারপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম। ২২শে এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী ফরিদপুর থেকে ঢাকা-বরিশাল সড়ক ধরে ৩০ কিমি পথ অতিক্রম করে সকাল ১১টায় ভাঙ্গায় প্রবেশ করে। ভাঙ্গায় প্রবেশের পূর্বে তারা ভাঙ্গা থেকে উত্তরে ৪ কিমি দূরে হামিরদী গ্রামে গাড়ি বহর থামিয়ে অবিরাম গুলিবর্ষণ করে ও সড়কের দুই পাশে অবস্থিত গ্রামের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এরপর হানাদার বাহিনী ভাঙ্গা সদরে কুমার নদের দুই পাশের বাজার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। এ-সময় তারা ৭-৮ জন লোককে গুলি করে হত্যা করে। পাকবাহিনী ভাঙ্গায় সিও অফিস ও থানায় স্থায়ীভাবে ক্যাম্প স্থাপন করে। তারা স্বাধীনতাবিরোধী মুসলিম লীগ পন্থীদের নিয়ে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে। মন্নু মিয়া (কাপুড়িয়া সদরদির) এবং শাহজাহান মাস্টার (নুরপুর) ছিল শান্তি কমিটির আহ্বায়ক এবং রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার। শান্তি কমিটির অন্যতম সদস্য ছিল এমদাদ কাজী ওরফে ইংগু কাজী (নওপাড়া) এবং রাজাকার বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিল সিরাজ (বাইশাখালী)। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর ভাঙ্গায় আওয়ামী লীগ-এর নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। টনিক সেন ও ডা. হারুনার রশিদ ছিলেন সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি কর্তৃক পরিচালিত প্রতিরোধ যুদ্ধের আর্থিক পৃষ্ঠপোষক। টনিক সেনের গাড়ির ব্যবসা ছিল। তাঁর বাবা উপেন সেন ছিলেন কম্পাউন্ডার। ভাঙ্গা পাইলট হাইস্কুলের সঙ্গেই ছিল উপেন সেনের বাসা এবং কম্পাউন্ডার কাজের ল্যাবরেটরি। তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লাগোয়া ঘরটি ছিল পাকবাহিনীর দোসর শান্তি কমিটির সদস্য এমদাদ কাজীর। এমদাদ কাজী পেশায় ছিল সনদবিহীন গ্রাম্য ডাক্তার। সেও ঐ ঘরে বসে চিকিৎসা করত। এমদাদ কাজীর সঙ্গে উপেন সেনের ছিল পেশাগত ঈর্ষা। ভাঙ্গায় পাকবাহিনী প্রবেশের পরপরই উপেন সেন নিরাপত্তার জন্য সপরিবারে জান্দি গ্রামের প্রফুল্ল সেনের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। এ খবর এমদাদ কাজীর জানা ছিল। এমদাদ কাজীসহ শান্তি কমিটির সদস্যরা পাকবাহিনীর অধিনায়কের কাছে টনিক সেনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগ দায়ের করে ও তাঁর পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য পরিকল্পনা করে। ২রা মে রাত ৩টায় একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে শতাধিক পাকসেনা জান্দি গ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়। এমদাদ কাজী ভাঙ্গা থেকে জান্দির পোদ্দার বাজারে তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। পোদ্দার বাজারে (জান্দি গ্রামের মাঝখানে অবস্থিত একটি ছোট বাজার) হানাদার বাহিনী কমান্ড স্থাপন করে গ্রামের চারদিক ঘিরে ফেলে। এরপর এমদাদ কাজীর সহায়তায় হানাদার বাহিনী সেনবাড়িতে যায় এবং সেনবাড়ি ঘিরে ফেলে। সেন বাড়িটি ছিল পুরাতন একটি একতলা ভবন এবং কিছু টিনের ঘরের সমষ্টি। টনিক সেনের পরিবারসহ সেন বাড়ির লোকজন ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। ভবনের পূর্বদিকের কোনো এক অংশে সংরক্ষিত ছিল শুকনো পাটের স্তূপ। হানাদার বাহিনী ভবনের দরজা ভেঙ্গে শুকনো পাটের গুদামে আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে লোকজনের ঘুম ভেঙ্গে যায় এবং তারা ভবন থেকে বের হতে চেষ্টা করে। এমদাদ কাজীর সহায়তায় হানাদারবাহিনী টনিক সেন ও তাঁর পিতাকে ধরে বেঁধে ফেলে। টনিক সেনের ভাগ্নে সুকেশকে ভবনের সামনেই গুলি করে হত্যা করে। সে ছিল ভাঙ্গা ফুটবল দলের বিখ্যাত গোলরক্ষক। তার লাশ দুটি খেজুর গাছের মাঝখানে পড়েছিল। বাকি ২০-২৫ জনকে ধরে নিয়ে সেনবাড়ি থেকে অনতিদূরে একটি কালী মন্দিরের সামনে জড়ো করে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে লাশ স্তূপ করে রাখে। উপেন সেনকে সেনবাড়ির উত্তরদিকে কিছু দূরে পুকুরহাটি নদীর তীরবর্তী খালি মাঠে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তাঁর লাশ ক্ষেতের আইলে পড়ে ছিল। তাঁর পরনে ছিল সাদা ধবধবে ধুতি যা রক্তে ভিজে গিয়েছিল হানাদাররা ঐ বাড়ি থেকে টনিক সেনকে বেঁধে সেনবাড়ি থেকে অল্প দূরে পোদ্দার বাজার সেনা কমান্ড সেন্টারে নিয়ে যায়। ৭৫-ঊর্ধ্ব বয়সী জান্দি গ্রামের বাসিন্দা শেখ সিদ্দিক মোল্লা (পিতা শেখ ছয়রুদ্দিন) ও শেখ নুরুল ইসলাম (পিতা শেখ আব্দুল আজিজ) এ দুজন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। পাকসেনারা টনিক সেনকে বাজারের ভেতর একটি বেলগাছের সঙ্গে বেঁধে রাইফেলের বাট দিয়ে পেটায়। এক পর্যায়ে বেলগাছের সঙ্গে দুই পা ওপরের দিকে বেঁধে ঝুলিয়ে গাছের সঙ্গে দেহকে আঘাত করে। নির্যাতনের পর হানাদাররা পায়ের বাঁধন খুলে তাঁকে বাজার সংলগ্ন পুকুর ঘাটের সিঁড়িতে নিয়ে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। তাঁর লাশ ঘাটের সিঁড়িতে পড়ে ছিল। হানাদার বাহিনী পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সকাল ১০টায় ভাঙ্গার উদ্দেশে জান্দি গ্রাম ত্যাগ করে। এরপর গ্রামবাসী বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা লাশগুলো একত্রিত করে সেনবাড়ির উত্তর পাশে গণকবর দেয়।
২০০৬ সালের ২৬শে আগস্ট সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়, যা ‘জান্দি স্বাধীনতা স্তম্ভ’ নামে পরিচিত। এটি উদ্বোধন করেন কাজী জাফর উল্যা এম. পি। স্বাধীনতা স্তম্ভে গণহত্যার শিকার শহীদদের নাম খোদাই করা আছে। গণহত্যায় শহীদ যাদের নাম জানা গেছে, তারা হলেন— কালীপদ চক্রবর্তী, গোবিন্দ চন্দ্র চন্দ, জীবনকৃষ্ণ সেন, মঙ্গলচরণ সেন, উপেন্দ্রনাথ সেন, ননীগোপাল সেন, কালাচান সেন, সোমেশ্বর সেন, পঞ্চানন ধুপা, টনিক সেন, সুধির সেন, সৃষ্টিধর সেন, নিত্তগোপাল সেন, মধুসূদন সেন, শংকর সেন, বিনয় সেন, নঈদা দত্ত, মাধব দত্ত, শ্রীমন্ত দত্ত, ধীরেন সেন, সতীশ সাধু, পানা সাধু, সুকেশ সেন, পল্টু সেন ও পঁচা সেন। ভুক্তির লেখকদ্বয় নিজেরাও বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা লাশগুলো দেখতে পান। [মীর ইউসুফ আলী, বাবুল আশরাফ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড