জলঢাকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় নির্যাতনকেন্দ্ৰ (জলঢাকা, নীলফামারী)
জলঢাকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় নির্যাতনকেন্দ্ৰ (জলঢাকা, নীলফামারী) নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলা সদরে অবস্থিত। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় পাকিস্তানি বাহিনী জলঢাকায় স্থায়ীভাবে ঘাঁটি স্থাপন করে। জলঢাকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ছিল তাদের প্রধান ক্যাম্প। এ ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি সেনারা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে অবস্থানরত রাজাকার ক্যাম্পগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করত এবং রাজাকারদের পরামর্শ ও নির্দেশনা মোতাবেক অপারেশন চালাত। তারা এলাকার লোকজনদের ক্যাম্পে ধরে এনে নির্যাতন শেষে হত্যা করত। এতে নেতৃত্ব দিত পাকবাহিনীর দোসর রাজাকার জবান উদ্দিন ও জলঢাকা উপজেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হাজী আফতাব উদ্দিন। ক্যাম্পে ৭০-৮০ জন রাজাকার সবসময় অবস্থান করত।
জলঢাকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্পটি একটি নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। হাজী আফতাব উদ্দিনের নেতৃত্বে রাজাকাররা আশপাশের এলাকা থেকে লোকজন ধরে আনত। তার অনুকম্পা পেলে কেউ- কেউ পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে রক্ষা পেত। তার তালিকায় যাদের নাম উঠত, তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চলত এবং মৃত্যু ছিল নিশ্চিত। হাজী আফতাব উদ্দিনের পরামর্শে পাকিস্তানি সেনারা মতিয়ার রহমানকে (মতি মাস্টার) ধরে গুলি করে হত্যা করার পর তাঁর লাশ নিয়ে স্কুলের পশ্চিম পাশে পুঁতে রাখে। তিনি মুক্তিবাহিনীকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করতেন বলে পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে হত্যা করে জলঢাকার বিভিন্ন ইউনিয়ন এবং কিশোরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রাম থেকে বহু লোককে ধরে এনে ক্যাম্পের পেছনে নিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার আগে বন্দিদের ওপর বিভিন্নভাবে অত্যাচার করা হতো।
জলঢাকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি তেঁতুল গাছ ছিল। সেখানে বন্দিদের পা রশি দিয়ে বেঁধে উল্টো দিক করে ঝুলিয়ে রাখা হতো। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের কাছ থেকে তথ্য বের করার জন্য গরম পানির মধ্যে তাদের মাথা ডুবাত। তাদের নির্দেশে রাজাকাররা শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে দিত এবং কাটা অংশে লবণ ও মরিচের গুঁড়া লাগাত। চোখ বেঁধে অন্ধকার ঘরে অনেক মানুষকে গাদাগাদি করে রাখত এবং দিনের পর দিন তাদের খাবার দিত না। বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে আনা পুরুষদের গুলি করে হত্যার হুমকি দিয়ে ঐসব পরিবারের নারীদের দিনের পর দিন ধর্ষণ করত। এ অপকর্মে সহযোগিতা করত রাজাকাররা। শুধু তাই নয়, নিজেরাও এ অপকর্মে লিপ্ত হতো। ঐসব পরিবার যাতে পালিয়ে না যায় এবং তাদের ওপর নির্যাতনের কথা যাতে বাইরে না বলে সেজন্য তাদের সতর্ক করে দেয়া হতো। কেউ নির্যাতনের কথা বাইরে বললে তার ওপর নেমে আসত কঠোর নির্যাতন এবং শেষে নিশ্চিত মৃত্যু। জলঢাকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্যাম্পটি নারীনির্যাতনের একটি সেল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। জলঢাকার এপথ দিয়ে শরণার্থীরা পালিয়ে যাওয়ার সময় পুরুষদের হত্যা করে তাদের সঙ্গে থাকা নারীদের ধরে নিয়ে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা নির্যাতন করত। এখান থেকে নারীদের রংপুর ও দিনাজপুরে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে সরবরাহ করত। জলঢাকার বিভিন্ন ইউনিয়নের লোকদের ধরে নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা মাটি কাটাত। তাদের বাঙ্কার তৈরির কাজে লাগাত। তারাও পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। পাকসেনাদের ভয়ে এখানকার অধিকাংশ লোক ভারতে পালিয়ে যায় এবং অনেকে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে তাতে লুকিয়ে থাকে। [আহম্মেদ শরীফ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড