জলাবাড়ি গণহত্যা (স্বরূপকাঠি, পিরোজপুর)
জলাবাড়ি গণহত্যা (স্বরূপকাঠি, পিরোজপুর) ২১শে মে থেকে ৩রা জুন পর্যন্ত সংঘটিত হয়। ১৪ দিনব্যাপী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ গণহত্যায় কয়েকশ মানুষ নিহত হয়।
১৮ই এপ্রিল থেকে পাকিস্তানি বাহিনী বরিশাল শহরে বোমা হামলা চালায়। ২৫শে এপ্রিল তারা বরিশাল শহর দখল করে নিলে বরিশাল এবং ঝালকাঠি এলাকার অসংখ্য মানুষ প্রাণ বাঁচাতে জলাবাড়ি ইউনিয়নের ইদিলকাঠি, কামারকাঠি, জলাবাড়ি, আরামকাঠি, জামুয়া মাদ্রা (ঝালকাঠি) প্রভৃতি গ্রামে আশ্রয় নেয়। ২১শে মে শর্ষিনার রাজাকার বাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদাররা জলাবাড়ি ইউনিয়নে অভিযান চালায়। পাকিস্তানি সৈন্যরা গানবোটযোগে সন্ধ্যা নদী পাড় হয়ে নাপিতখালি খালের ভেতর দিয়ে ইদিলকাঠি বাজারের পুলের নিকট অবস্থান নেয়। শর্ষিনার রাজাকার বাহিনী স্বরূপকাঠি-শেখেরহাট রাস্তা দিয়ে পায়ে হেঁটে কামারকাঠি, ইদিলকাঠি, পূর্ব জলাবাড়ি, আরামকাঠি, মাদ্রা ও। জামুয়ায় গিয়ে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। অন্যদিকে হানাদার বাহিনীর অপর একটি দল গানবোটে করে গাবখান খাল হয়ে এখানে আসে। হানাদারদের ৩টি দল একত্রিত হয়ে ১৪ দিন অবস্থান করে বিরতিহীনভাবে এসব এলাকায় লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, নারীনির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালায়। তারা পায়ে হেঁটে ও স্পিডবোটে কামারকাঠি, ইদিলকাঠি, পূর্ব জলাবাড়ি, আরামকাঠি, মাদ্রা, জামুয়া গ্রামে আক্রমণ করে এবং কয়েকশ মানুষকে হত্যা করে। যারা হত্যার শিকার হয় তাদের বড় একটি অংশ বরিশাল এবং ঝালকাঠি থেকে আশ্রয় নিতে আসা মানুষ। পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের সহযোগী রাজাকাররা নিরীহ মানুষদের ধরে বেঁধে ইদিলকাঠি স্কুলের সামনে এনে পুলের দক্ষিণ পাড়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। জলাবাড়ি গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা নিরঞ্জন হালদার (সহকারী অধ্যাপক, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ কলেজ, কুড়িয়ানা) ও মাদ্রা গ্রামের নিশিত মিস্ত্রী।
গণহত্যার প্রথম দিনে হানাদাররা মাদ্রা (ঝালকাঠি) গ্রামের ৩টি শিশু— অঞ্জনা রায়, কালা সমদ্দার ও কমল মণ্ডলকে জলে নিক্ষেপ করে হত্যা করে। পূর্ব জলাবাড়ি গ্রামের কেশব মিস্ত্রীকে হানাদার বাহিনী হত্যা করলে তার পিতা লক্ষ্মণ মিস্ত্রী একমাত্র ছেলের মৃত্যুশোক সহ্য করতে না পেরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। পূর্ব জলাবাড়ি গ্রামের নগেন মিস্ত্রী হানাদারদের প্রতিরোধ করতে একটি বড় দা সঙ্গে রাখতেন। একদিন হানাদাররা নগেন মিস্ত্রীর দা দিয়েই তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। কেদারনাথ মিস্ত্রীর ছেলে তারাপ্রসন্ন মিস্ত্রীকে রাজাকাররা কুঠার দিয়ে কুপিয়ে ২২ টুকরো করে হত্যা করে। তারা মাদ্রা গ্রামের দুটি ঘর ব্যতীত সবগুলো ঘর জ্বালিয়ে দেয়। মাদ্রা পশ্চিম পাড়ার সুধীর মিস্ত্রী ও সুরেন মিস্ত্রী এবং ব্যাসকাঠির চিত্ত সূতারকে স্বরূপকাঠি থানায় নিয়ে নির্যাতন শেষে হত্যা করা হয়। পূর্ব জলাবাড়ি গ্রামের বৃদ্ধ অক্ষয় মিস্ত্রী ও রতিকান্ত মিস্ত্রীকে তারা ধরে নিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য আদায়ের জন্য তাদের গানবোটে উঠিয়ে নির্মম নির্যাতন শেষে গুলি করে নদীতে ফেলে দেয়। কিন্তু তারা ঘটনাক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। এছাড়া এ গণহত্যায় রবি হাওলাদার (মাদ্রা, ঝালকাঠি) এবং ধীরেন মিস্ত্রী (আর কাঠি) গুলিবিদ্ধ হয়ে শেষ পর্যন্ত বেঁচে যান।
জলাবাড়ি গণহত্যায় কয়েকশ মানুষ শহীদ হয়, যাদের অধিকাংশই ছিল দূর-দূরান্তের। ফলে সকল শহীদদের পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। এ গণহত্যার শিকার ৭৫ জনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন- পূর্ব জলাবাড়ির কেশব লাল মিস্ত্রী, নগেন্দ্র নাথ মিস্ত্রী, বিপিন মিস্ত্রী, বিশ্বেশ্বর মিস্ত্রী, নিশিকান্ত মাঝি, রাজেন্দ্র নাথ মিস্ত্রী, পীযূষ সরকার, যজ্ঞেশ্বর বড়াল, নগেন বড়াল, রাজেন্দ্র নাথ মণ্ডল, নগেন মণ্ডল, মহেন্দ্র সিকদার, মুক্তিযোদ্ধা নির্মল হালদার, লক্ষ্মণ মিস্ত্রী (পুত্রের মৃত্যুতে আত্মহত্যা), মনোরঞ্জন মিস্ত্রী, ক্ষীরদা সুন্দরী মণ্ডল, ঝালকাঠি জেলার মাদ্রা গ্রামের তারা প্রসন্ন মিস্ত্রী, সুধীর মিস্ত্রী, সুরেশ মিস্ত্রী, স্বরস্বতী মিস্ত্রী, কানন বালা, হরকুমার মণ্ডল, অতুল মণ্ডল, অঞ্জনা মণ্ডল (শিশু), কালা সমদ্দার (শিশু), কমল মণ্ডল (শিশু), সুরেন্দ্রনাথ মণ্ডল, স্বর্ণকুমার মণ্ডল, ক্ষীরদা সুন্দরী (আগুনে পুড়িয়ে), রবি হাওলাদার (ইদিলকাঠি বধ্যভূমিতে), গণপতিকাঠি গ্রামের শ্রীনাথ রায়, রণজিৎ রায়, মালতি মিস্ত্রী, গোপাল হালদার, কালিপদ রায়, আতা গ্রামের হরিবর মণ্ডল, জামুয়ার গোপাল ঘরামী, ইদিলকাঠির ধীরেন্দ্রনাথ মণ্ডল, জীতেন্দ্রনাথ বড়াল, নিতাই মিস্ত্রী, কামারকাঠির ধীরেন্দ্রনাথ চন্দ, অমর চন্দ, বিজয় চন্দ, মনু লাল ঘোষ, ধীরেন্দ্রনাথ সমদ্দার, কালিকান্ত বড়াল, মো. আব্দুস সালেক, অধীর রঞ্জন বড়াল, অমূল্য মিস্ত্রী, বিমল বড়াল, কৃষ্ণকান্ত মিস্ত্রী, কৃষ্ণকান্ত মিস্ত্রী-২, ভুবন মিস্ত্রী, দেবেন মিস্ত্রী, জিতেন মিস্ত্রী, শান্তি ঘরামী (ধর্ষিতা হয়ে মৃত্যু), জলাবাড়ির গোপাল হালদার, মন্টু হালদার, কুট্টি হালদার, বিপিন রায়, জয়ন্ত বড়াল, অতুল মিস্ত্রী, রসিক মিস্ত্রী, যোগেশ চন্দ্র বড়াল, নীরদ ঘরামী, গণেশ দেবনাথ, হরলাল কর্মকার, ঘোষাল কর্মকার, গণপতিকাঠির মনসা মণ্ডল, আরামকাঠির ধীরেন মিস্ত্রী, গীতা হালদার, উপেন্দ্রনাথ হালদার, ইন্দ্রভূষণ হালদার, রমেশ মিস্ত্রী ও প্রফুল্ল হালদার। [হাবিবুল্লাহ রাসেল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড