You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বে সিলেটের মাধবপুর থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা জয়বাংলা (মাধবপুর, হবিগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বে সিলেটের মাধবপুর থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা জয়বাংলা (মাধবপুর, হবিগঞ্জ)

জয়বাংলা (মাধবপুর, হবিগঞ্জ) মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বে সিলেটের মাধবপুর থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকা। তৎকালীন সিলেট জেলার সিংহদ্বার ছিল মাধবপুর। সড়ক ও রেলপথে সিলেটে প্রবেশ করতে হলে মাধবপুরের বিকল্প ছিল না। সড়কপথে ঢাকা থেকে নিয়ে আসা সংবাদপত্র ও নানা ধরনের সংবাদ মাধবপুরের মানুষ সহজেই পেত। নেতারা ঢাকা-সিলেট যাতায়ত কালে মাধবপুরের নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও মতবিনিময় করতেন। এ ছাড়াও বিভিন্নভাবে মাধবপুর সদরে নানা সংবাদ দ্রুত পৌঁছে যেত। বিভিন্ন ইউনিয়নের আন্দোলনরত কর্মীরা প্রতিদিন মাধবপুর সদরে যাতায়ত করে ব্যক্তি উদ্যোগে তথ্য আদান-প্রদান করতেন। এই বাস্তবতার নিরিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত কয়েক জন ছাত্র আন্দোলনের নানা তথ্য সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দেবার লক্ষ্যে স্থানীয়ভাবে একটি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সর্বসম্মতিক্রমে পত্রিকার নামকরণ করা হয় ‘জয়বাংলা’। সংশ্লিষ্ট পত্রিকাটি প্রধানত পরিমল রায় ও সেলিম চৌধুরীর উদ্যোগ, আন্তরিকতা ও শ্রমেই প্রকাশিত হয়েছিল। এর সম্পাদক ছিলেন পরিমল রায় এবং ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন থানা আওয়ামী লীগ-এর সাধারণ সম্পাদক দুলাল চৌধুরীর ভ্রাতুষ্পুত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সেলিম চৌধুরী। পরিমল রায় ছিলেন পার্শ্ববর্তী সাতবর্গের (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) সন্তান (পরবর্তীতে আদাঐর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক)। উভয়েই তখন -ছাত্র ইউনিয়ন-এর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পত্রিকাটি প্রথমে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ছাপা হতো। সিও অফিসের সাইক্লোস্টাইল মেশিনটিই ছিল তাঁদের প্রথমে ভরসা। তৎকালীন সিও মমতাজুর রহমানের অনুমতি সাপেক্ষে অফিস সহকারী রতনের আন্তরিকতাপূর্ণ সহযোগিতায় প্রতিদিন পত্রিকাটির শতাধিক কপি ছাপা হতো। ছাত্ররা নিজেরাই বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে আগত রাজনৈতিক কর্মীসহ সর্বসাধারণের কাছে বিনামূল্যে এটি বিতরণ করতেন। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই এর সুনাম ছড়িয়ে পড়লে চাহিদা সামাল দিতে গিয়ে উদ্যোক্তারা প্রিন্টিং প্রেস থেকে ছাপার আবশ্যকতা বোধ করেন। এ পর্যায়ে ৯ই মার্চ থেকে নোয়াপাড়াস্থ সৈয়দ সঈদ উদ্দিনের মালিকানাধীন স্ট্যান্ডার্ড প্রিন্টিং প্রেস থেকে পত্রিকাটি মুদ্রিত হতে থাকে। কিন্তু প্রেসের কারিগরি ত্রুটির কারণে ছাপায় বিঘ্ন সৃষ্টি হলে ২১শে মার্চ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খালপাড়স্থ পপুলার প্রেস থেকে ছাপা হয়। সেলিম চৌধুরী এবং স্বপন বড়ুয়া প্রত্যহ একটি বেবিটেক্সি যোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া গিয়ে পত্রিকা ছাপিয়ে নিয়ে আসতেন। প্রসঙ্গত বলা আবশ্যক যে, মাধবপুর থানার তৎকালীন সেকেন্ড অফিসার সুভাসচন্দ্র বড়ুয়ার ছেলে ছিলেন স্বপন বড়ুয়া। গ্র্যাজুয়েশন করে তিনি তখন বেকার অবস্থায় স্বীয় মালিকাধীন একটি বেবিটেক্সি নিজেই চালাতেন। তিনিও পত্রিকাটির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং তার বেবিটেক্সি নিয়ে তিনি পত্রিকা ছাপানোর জন্য প্রত্যহ সেলিম চৌধুরীকে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়া-আসা করতেন।
২৯শে মার্চ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিমান হামলা হয়। এই হামলার ভয়ে সেখানকার অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট প্রিন্টিং প্রেসটিও ৪ঠা এপ্রিলের দিকে বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বোমা হামলার সময় জঙ্গি বিমানগুলো মাধবপুর হয়ে ফিরে যাওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষও বোমা হামলার আতঙ্কে ছিল। ২৯শে মার্চ মেজর খালেদ মোশাররফ ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে তেলিয়াপাড়ায় হেডকোয়ার্টার্স স্থাপনের পর এ আশঙ্কা আরো বৃদ্ধি পায়। এরূপ পরিস্থিতির কারণে ৪ঠা এপ্রিল থেকে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।
জয়বাংলা পত্রিকাটি ধূমকেতুর মতো সীমিত সময়ের জন্য আবির্ভূত হলেও মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বে জনমত সংগঠনে এর অবদান ছিল অপরিসীম। আন্দোলনের চরম পর্যায়ে স্থানীয় জনসাধারণ কেন্দ্রসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পরিস্থিতি জানতে যখন উন্মুখ, ঠিক তখন এ পত্রিকা স্থানীয়ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাধবপুরবাসী এর মাধ্যমে আন্দোলন সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা অর্জনের সুযোগ পায়। অনাগত পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ানোর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে মানুষ প্রেরণা পায়। আন্দোলনের মহামন্ত্রে উদ্বুদ্ধ সাধারণ মানুষ মুক্তি লাভের প্রত্যাশায় মাধবপুর থানার পুলিশ ও বিভিন্ন বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের নেতৃত্বে থানা সদরে সামরিক প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। ২৯শে মার্চ মেজর খালেদ মোশাররফের অধিনায়কত্বে ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট মাধবপুর আসার সঙ্গে-সঙ্গে তাদের সহযোগিতায় সর্বস্তরের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে। ৪ঠা এপ্রিল থেকে মেজর কে এম সফিউল্লাহর নেতৃত্বে তেলিয়াপাড়ায় শুরু হওয়া মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে হাজার-হাজার মানুষ অংশ নেয়। এসমস্ত বিষয়ে পত্রিকাটির ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড