জয়মনিরহাট যুদ্ধ (ভুরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম)
জয়মনিরহাট যুদ্ধ (ভুরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম) জয়মনিরহাটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর একাধিক যুদ্ধ হয়। সেসব যুদ্ধে পাকবাহিনীর অনেক সৈন্য নিহত হয়। সর্বশেষ ১৪ই নভেম্বরের যুদ্ধে পাকবাহিনী পরাজিত হলে জয়মনিরহাটে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
সুবেদার মাজহারুল ইসলামের ‘জি’ কোম্পানি ইপিআর সদস্যসহ ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গঠিত ছিল। ভারতের অভ্যন্তরে ছিটমহল কালমাটিতে তাদের হেডকোয়ার্টার্স ছিল। এ দল ভুরুঙ্গামারীর জয়মনিরহাট ও আন্ধারীরঝাড় এবং নাগেশ্বরীর রায়গঞ্জ এলাকায় কাভারিং পার্টি হিসাবে কাজ করত।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যাতে ভুরুঙ্গমারী যেতে না পারে সেজন্য মুক্তিযোদ্ধারা ফুলকুমার নদীর দুই পাড়ে ডিফেন্স নিয়ে রাস্তা ব্লক করে দিতেন। এখান থেকে ৩০০ গজের মধ্যে পাকিস্তানিদের বাংকার ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা এলএমজি পোস্টে গুলি চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ব্যস্ত রাখতেন। উভয় পক্ষে গোলাগুলি বিনিময় হতো, আর এর ফাঁকে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা ভুরুঙ্গামারী, জয়মনিরহাট, আন্ধারীরঝাড় ও নাগেশ্বরীর রায়গঞ্জ এলাকায় অপারেশ পরিচালনা করতেন। এ পথে মুক্তিযোদ্ধারা বেশি চলাফেরা করতেন। তাঁরা ভুরুঙ্গামারীর রাস্তায় মাইন পেতে রাখতেন। এর ফলে প্রায়ই ভুরুঙ্গামারীর রাস্তায় পাকিস্তানিদের জিপ উড়ে রাস্তার নিচে পড়ত। এখানে একজন ক্যাপ্টেনসহ পাকিস্তানিদের অনেক সেনা নিহত হয়।
কালমাটির মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প থেকে বগনি ব্রিজ অতিক্রম করে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিদিন পেট্রলিং-এ যেতেন। রেললাইন ও রেললাইনের দুধারের গহীন জঙ্গল ধরে জয়মনিরহাট হাইস্কুল, মেইন ব্রিজ হয়ে তেলখাওয়া ব্রিজ ইত্যাদি এলাকা পর্যন্ত তাঁরা পেট্রল দিতেন। পেট্রলের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনাদের গুলি বিনিময় হতো। আগস্ট মাসের প্রথম দিকে পাকবাহিনী টহলরত মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা তেলখাওয়া ব্রিজের পশ্চিম দিকে অবস্থান নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করেন। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ১০-১২ জন পাকসেনা তেলখাওয়া ব্রিজের ওপর থেকে পানিতে পড়ে গেলে তাদের সলিল সমাধি হয়।
১৪ই আগস্ট জয়মনিরহাট ক্যাম্পের পাকসেনারা তাদের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দেবে এমন সময় মুক্তিযোদ্ধারা পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক অতর্কিতে আক্রমণ করেন। এতে ১০ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। তাদের অনুষ্ঠান পণ্ড হয়।
জয়মনিরহাটস্থ ক্যাম্প থেকে পাকসেনারা মাঝে-মাঝে রাস্তায় টহল দিত। ২৭শে সেপ্টেম্বর ভুরুঙ্গামারী রাস্তার পাশে ভুরুঙ্গামারী-জয়মনিরহাট টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য দুজন মুক্তিযোদ্ধা দুটি টেলিফোন পোস্টে ওঠেন। তাঁরা সেখান থেকে পাকিস্তানিদের একটি পেট্রল দলকে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখেন। ইপিআর হাবিলদার আনিস মোল্লার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান এবং শামসুল ইসলাম তাঁদের হাতে থাকা এলএমজি ও অনান্য অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণ করেন। এ আক্রমণে টহল গাড়িতে থাকা ৬-৭ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিরাপদে নিজেদের ক্যাম্পে ফিরে আসেন।
মুক্তিযোদ্ধারা প্রায়ই জয়মনিরহাটস্থ পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে আক্রমণ করতেন। এসব আক্রমণের পর পাকসেনারা আবার পার্শ্ববর্তী এলাকা দখল করে নিত। ১৪ই নভেম্বর বিকেলে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা চূড়ান্তভাবে জয়মনিরহাট আক্রমণ করেন। এ আক্রমণের পর জয়মনিরহাট মুক্ত হয়। ১৪ই নভেম্বর সকালে ভুরুঙ্গামারী ও বিকেলে জয়মনিরহাট মুক্ত হয় এবং উভয় স্থানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এদিন পাকিস্তানিদের পেঁতে রাখা মাইনে মিত্রবাহিনীর একজন কর্মকর্তাসহ ৩ জন সৈনিক শহীদ হন। [এস এম হারুন অর রশীদ লাল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড