You dont have javascript enabled! Please enable it!

জর্জ হ্যারিসন

জর্জ হ্যারিসন (১৯৪৩-২০০১) পপ সঙ্গীতের জনপ্রিয় শিল্পী, গীতিকার, সুরকার, গিটারিস্ট, বিখ্যাত ব্যান্ড সঙ্গীত গ্রুপ ‘দ্যা বিটলস’-এর অন্যতম সদস্য, সঙ্গীত পরিচালক, রেকর্ড ও চলচ্চিত্র প্রযোজক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ কনসার্ট – আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ (মরণোত্তর) প্রাপ্ত ও বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু।
জর্জ হ্যারিসন ১৯৪৩ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যের ল্যাংশায়ের লিভারপুলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হ্যারোল্ড হাগ্রিভিস হ্যারিসন এবং মাতার নাম লুইসে ফ্রেন্স হ্যারিসন। জর্জ ছিলেন তাঁর পিতা-মাতার ৪ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় লিভারপুলের ডাবডেল প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি এ স্কুলে পড়াশুনা করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি লিভারপুল ইনস্টিটিউট ফর বয়েজ-এ ভর্তি হন এবং ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত সেখানে পড়াশুনা করেন। উল্লেখ্য, এ ইনস্টিটিউটটি বর্তমানে লিভারপুল ইনস্টিটিউট ফর পারফর্মিং আর্টস (Liverpool Institute for Performing Arts) নামে পরিচিত। এখানে জর্জ হ্যারিসন পড়াশুনার ফাঁকে-ফাঁকে গিটার বাজানো শিখতেন। লিভারপুল ইনস্টিটিউট ফর বয়েজ-এ পড়াশুনার সময় স্কুল বাসে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় একই স্কুলের ছাত্র পল ম্যাককাটর্নি-র সঙ্গে। পরবর্তীতে পল ম্যাককাটর্নি এবং তাঁর বন্ধু জন লেনন মিলে গঠন করেন ‘দ্যা কোয়ারিমেন’ নামে একটি ব্যান্ড দল। পরে ‘দ্যা কোয়ারিমেন’-ই ‘দ্যা বিটলস’ নামে বিশ্ব বিখ্যাত ব্যান্ড গ্রুপে পরিণত হয়। একজন কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে জর্জ হ্যারিসন এ দলে যোগ দেন ১৯৫৮ সালে এবং এক বছরের মধ্যেই লিড পারফরমার হিসেবে দলের অন্যতম প্রধান সদস্য ও লিড গিটারিস্ট হিসেবে স্থান পান।
১৯৬০ সাল থেকে জর্জ হ্যারিসন ও তাঁর ব্যান্ড গ্রুপ ‘দ্যা বিটলস’-এর নাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। জর্জ হ্যারিসন ছাড়াও এ গ্রুপের যাঁরা সদস্য ছিলেন, তাঁরা হলেন- জন লেনন, পল ম্যাককাটর্নি ও রিংগো স্টার। এ গ্রুপের হয়ে হ্যারিসন ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। স্টেজে গান পরিবেশন ছাড়াও এ দল বহু ব্যবসা সফল রেকর্ড ও এলবাম প্রকাশ করে। এ সকল এলবাম প্রকাশের মধ্য দিয়ে হ্যারিসন সঙ্গীত পরিচালক ও প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
১৯৬৬ সালে লন্ডনে বিখ্যাত ভারতীয় শাস্ত্রীর সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ সেতারবাদক পণ্ডিত রবি শংকর-এর সঙ্গে জর্জ হ্যারিসনের পরিচয় হয়। এ পরিচয়ের সূত্র ধরে ঐ বছরই তিনি ভারতে এসে শ্রীনগরে রবি শংকরের নিকট ছয় সপ্তাহ সেতারের তালিম নেন। এ-সময় তিনি ভারতীয় সঙ্গীত, আধ্যাত্মিকতা, ভারতীয় সংস্কৃতি, দর্শন এবং হিন্দুধর্মের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়েন। তারপর তিনি হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেন। ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য হলো— ‘সকল মতবাদই একটি বৃহৎ বৃক্ষের শাখা। তুমি তাকে কি নামে ডাকবে এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।’ উল্লেখ্য, হ্যারিসনের পক্ষে ভালো সেতারবাদক হওয়া সম্ভব না হলেও রবি শংকর ও তাঁর মধ্যে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক এবং গভীর বন্ধুত্ব সারা জীবন অব্যাহত ছিল।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু হলে মানুষ তাদের বাড়িঘর ফেলে পালাতে শুরু করে। প্রাণভয়ে প্রায় এক কোটি মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে শরণার্থী শিবির এ আশ্রয় নেয়। শরণার্থী শিবিরের জীবন এমনিতেই দুর্বিষহ, তার ওপর বিপুল জনগোষ্ঠীর ভরণ পোষণ করতে গিয়ে ত্রাণ সামগ্রীর অপ্রতুলতা দেখা দেয়। শরণার্থী শিবিরের করুণ অবস্থার কথা জেনে পণ্ডিত রবি শংকর খুবই ব্যথিত হন এবং সেখানকার বিপন্ন মানুষের জন্য কিছু একটা করার ইচ্ছা থেকে তাঁর বন্ধু ও শিষ্য জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে বাংলাদেশের গণহত্যা ও শরণার্থী শিবিরের মানবেতর অবস্থার কিছু তথ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্য সাহায্যের হাত বাড়ানোর অনুরোধ করেন। উল্লেখ্য, ১৯৭০ সালে বিটলস গ্রুপ ভেঙ্গে যাবার পর থেকে হ্যারিসন নিজস্ব এলবাম তৈরিতে মনোনিবেশ করেন। ১৯৭১ সালের জুন মাসে তিনি তাঁর রাগা এলবামের জন্য লস অ্যাঞ্জেলেসে নিজের রেকর্ডিং নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। বাংলাদেশের গণহত্যা ও শরণার্থী শিবিরে মানুষের দুঃখ- দুর্দশার খবর হ্যারিসনকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। পণ্ডিত রবি শংকরের প্রস্তাবে তিনি রাজি হন এবং তাঁরা ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি বেনিফিট কনসার্ট করার সিদ্ধান্ত নেন। ভেনু হিসেবে বেছে নেয়া হয় নিউ ইয়র্কের মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনকে, তারিখ ১লা আগস্ট ১৯৭১। জর্জ হ্যারিসন কীভাবে বাংলাদেশ কনসার্টে জড়িয়ে গেলেন এ বিষয়ে বিস্তারিত তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ I Me Mine-এ বর্ণনা করা হয়েছে। জর্জ হ্যারিসন সঙ্গে-সঙ্গেই বিটলস-এর তাঁর পুরনো সহশিল্পী ও সে সময়ের জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী বব ডিলান (পরবর্তীতে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত), এরিক ক্লাপটন, রিংগো স্টার, বিলি পেস্টন, লিওন রাসেল ও অন্যান্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ কনসার্টে অংশ নেয়ার অনুরোধ জানান।
যদিও রবি শংকর ও জর্জ হ্যারিসনের প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল এদিন একটি কনসার্ট অনুষ্ঠান করার, কিন্তু দর্শক-শ্রোতাদের বিপুল সাড়ার কারণে তাঁদের একই দিনে দুটি অনুষ্ঠান করতে হয়েছিল। প্রতিটি অনুষ্ঠান দুটি পর্বে বিভক্ত ছিল। প্রথম পর্বে ছিল পণ্ডিত রবি শংকর ও তাঁর দলের পরিবেশনায় বাংলাদেশের পল্লিগীতির সুরে ‘বাংলাদেশ ধুন’ নামে পণ্ডিত রবি শংকরের কম্পোজ করা একটি যন্ত্রসঙ্গীত। এতে অংশ নেন সেতারে রবি শংকর, সরোদে ওস্তাদ আলী আকবর খান, তবলায় ওস্তাদ আল্লা রাখা খান এবং তানপুরায় কমলা চক্রবর্তী। কনসার্টের দ্বিতীয় পর্বে জর্জ হ্যারিসন ও অন্যান্যদের অংশগ্রহণে পরিবেশিত হয় পশ্চিমা রক সঙ্গীত
বাংলাদেশ কনসার্টের মূল আকর্ষণ ছিলেন জর্জ হ্যারিসন ও বব ডিলান। অনুষ্ঠানে হ্যারিসন গেয়েছিলেন ৮টি গান, যার মধ্যে একটি বব ডিলানের সঙ্গে। বব ডিলান এ অনুষ্ঠানে গেয়েছিলেন পাঁচটি গান। রিংগো স্টার ও বিলি পেস্টন একটি করে গান পরিবেশ করেছিলেন। অনুষ্ঠানে লিওন রাসেল দুটি গান পরিবেশন করেন, যার একটি বিলি পেস্টনের সঙ্গে।
কনসার্টের শেষ পরিবেশনা ছিল বাংলাদেশকে নিয়ে লেখা জর্জ হ্যারিসনের নিজের কণ্ঠে অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক গান ‘রিলিজ দ্যা পিপল অব বাংলাদেশ’ (Release the People of Bangladesh)। গানটির (বাংলাদেশ বাংলাদেশ) গীতিকার ও সুরকার হ্যারিসন নিজে। এ গানের মূল আহ্বান ছিল বিশ্ববাসীকে মানবতার ডাকে বাংলাদেশের যুদ্ধপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর।
My friend came to me
With sadness in his eyes
He told me that he wanted help
Before his country dies
Although I couldn’t feel the pain
I knew I had to try
Now I’m asking all of you
To help us save some lives
Bangladesh, Bangladesh
Where so many people are dying fast
And it sure looks like a mess
I’ve never seen such distress
Now won’t you lend your hand and understand?
Relieve the people of Bangladesh
Bangladesh, Bangladesh
Such a great disaster, I don’t understand
But it sure looks like a mess
I’ve never know such distress
Now please don’t turn away
I want to hear you say
Relieve the people of Bangladesh
Relieve Bangladesh
Bangladesh, Bangladesh
Now it may seem so far from where we all are
It’s something we can’t neglect
It’s something I can’t neglect
Now won’t you give some bread
to get the starving fed?
We got to relieve Bangladesh
Relieve the people of Bangladesh
We got to relieve Bangladesh
Relieve the people of Bangladesh

রবি শংকর ও জর্জ হ্যারিসন ছাড়াও বব ডিলান, এরিক ক্লাপটন, রিংগো স্টার, বিলি পেস্টন ও লিওন রাসেলের মতো সে সময়ের জনপ্রিয় শিল্পীদের অংশগ্রহণে এক দিনেই সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা। বাংলাদেশ কনসার্টে সমবেত হয়েছিলেন ৪০ হাজার দর্শক- শ্রোতা। ইতিহাস সৃষ্টিকারী সেই কনসার্ট থেকে দুলক্ষ ৪৩ হাজার ৪১৮ ডলার ৫০ সেন্ট সংগৃহীত হয়েছিল, যার পুরোটাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও শরণার্থীদের কল্যাণের জন্য ইউনিসেফের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। এ কনসার্ট যে শরণার্থীদের জন্য শুধু অর্থই সংগ্রহ করেছে তা নয়, বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনের ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে জর্জ হ্যারিসন অস্ত্রহাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেননি সত্য, কিন্তু তাঁর কণ্ঠে গাওয়া গান বিশেষ করে বাংলাদেশ কনসার্ট আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি বাংলাদেশকে পরিচিত করেছেন বিশ্ববাসীর নিকট। এ গানের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে উন্মুক্ত হয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বারা বাঙালিদের ওপর চলা গণহত্যা ও নির্যাতনের বর্বরতম চিত্র। জর্জ হ্যারিসন সঙ্গীত ও পারফর্মিং আর্টস-এর ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য বহু সম্মাননা পেয়েছেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ব্রিটেনের রানির জন্মদিনে Order of the British Empire- এর সদস্যপদ লাভ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অব আর্টস এন্ড সায়েন্স থেকে আজীবন সম্মাননা সহ চারবার গ্রামি এওয়ার্ড পান। তার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশ কনসার্টের জন্য এলবাম অব দ্যা ইয়ার গ্রামি এওয়ার্ড (১৯৭২)। ২০১২ সালের ২৭শে মার্চ এ মহান শিল্পীকে বাংলাদেশের ‘মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক মাত্রা তৈরিতে ঐতিহাসিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ’ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। জর্জ হ্যারিসন ১৯৬৬ সালের ২১শে জানুয়ারি ব্রিটিশ জনপ্রিয় মডেল প্যাট্রিসিয়া অ্যান বয়েড-এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন; তবে ১৯৭৪ সালে তাঁদের ডিভোর্স হয়ে যায়। ১৯৭৮ সালে তিনি ডার্ক হর্স রেকর্ড কোম্পানির সেক্রেটারি অলিভিয়া আরিয়াস-এর সঙ্গে দ্বিতীয়বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ দম্পতির একমাত্র সন্তান ধ্যানি হ্যারিসনও একজন সঙ্গীত শিল্পী।
২০০১ সালের ২৯শে নভেম্বর আমেরিকার লস এঞ্জেলসে বন্ধু ও সহকর্মী পল ম্যাককাটর্নির বাড়িতে জর্জ হ্যারিসন মৃত্যুবরণ করেন। হ্যারিসনের মৃত্যুর পর তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর মরদেহ হলিউডে হিন্দু সমাধিক্ষেত্রে দাহ করা হয় এবং এর ভস্ম ভারতের বেনারসে গঙ্গা ও যমুনা নদীতে ছড়িয়ে দেয়া হয়। তাঁর নিকটজনেরা হিন্দুরীতিতে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন। [সাজাহান মিয়া]
তথ্যসূত্র: George Harrison, I Me Mine, Simon & Schuster 1981; সেলিম রেজা (সম্পা.), মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও গান, ঢাকা, অনুপম প্রকাশনী ১৯৮৮; হারুন হাবীব, মুক্তিযুদ্ধ : পালা বদলের ইতিহাস, ঢাকা, সালমা বুক ডিপো ২০১৩; ফকির আলমগীর, মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী বন্ধুরা, ঢাকা, অনন্যা ২০১৫

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!