You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধকালে নওগাঁ থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা জয় বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধকালে নওগাঁ থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা জয় বাংলা

জয় বাংলা (নওগাঁ সদর) মুক্তিযুদ্ধকালে নওগাঁ থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকা। ৩০শে মার্চ থেকে এর প্রকাশনা শুরু হয়ে ২২শে এপ্রিল নওগাঁ শহর শত্রুমুক্ত থাকা পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। এ সময় শহরটির নিয়ন্ত্রণ ছিল জনগণের হাতে। মুক্তিকামী জনগণের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ। সংগ্রাম পরিষদ এলাকার রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। বাঙালি পুলিশ ও ইপিআর সদস্যরা প্রতিরোধ ব্যবস্থার পাশাপাশি উদ্যমী যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেন।
সমস্ত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রতিদিন জয় বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এর সম্পাদক ছিলেন এম জি হায়দার রহমতুল্লাহ। দুই পৃষ্ঠার ট্যাবলয়েড আকারের পত্রিকাটি মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধে নিবেদিত মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা সৃষ্টিতে অনন্য অবদান রাখে। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় এটি প্রকাশিত হতো। স্বেচ্ছায় তরুণ কর্মীরা পত্রিকাটি নিমেষে শহরের ঘরে-ঘরে এবং পার্শ্ববর্তী হাট- বাজারে পৌঁছে দিত। নিরাপত্তা রক্ষীদের গাড়িতে করে দূর অঞ্চলের গ্রামে-গঞ্জেও পত্রিকাটি পৌঁছে যেত। প্রকাশের দিন থেকেই পত্রিকাটি ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। সঙ্কটকালে নিজেদের প্রাণের কথাগুলো ছাপার অক্ষরে পাঠ করে মুক্তিকামী জনতা অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত হয়। উৎসুক চোখে আগ্রহী পাঠক প্রতীক্ষা করেন পরবর্তী সংখ্যার জন্য। উদ্দীপনামূলক নিবন্ধ, বাণী, গান, কবিতা, করণীয়, দায়িত্ব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। ৩০শে মার্চ থেকে নওগাঁ শহরে শত্রুসেনা প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত একটানা (২২শে এপ্রিল) জয় বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
পত্রিকার সম্পাদক হায়দার রহমতুল্লাহ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র। তিনি উনসত্তরের ছাত্র-গণ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। দেশপ্রেমের তাগিদ থেকেই তিনি পত্রিকা প্রকাশে উদ্বুদ্ধ হন। জয় বাংলা পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় সম্পাদকীয় লেখা হয়— ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়, দাসত্ব-শৃঙ্খল কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়…। জয় বাংলা নওগাঁর জনসাধারণের পক্ষ হইতে সংগ্রাম পরিষদের উপর পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করিতেছে। স্বাধীন বাংলার সরকারের পক্ষ হইতে প্রদত্ত সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশাবলী অমান্য করা চলিবে না।’একই সংখ্যায় ‘জনগণের প্রতি আবেদন’ শিরোনামে লেখা হয়— ‘গুজবে কান দিবেন না। লুঠ-তরাজের চেষ্টাকে সর্বশক্তি দিয়া বাধা দিবেন। মনে রাখিবেন লুটেরাদের কোনো জাত নাই, ধর্ম নাই। কোনো প্রকার আত্মকলহকে প্রশ্রয় দিবেন না। জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি করিবেন না। প্রয়োজনের অতিরিক্ত দ্রব্য ক্রয় করিবেন না। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করিবেন। বাংলার বীর সেনানী বাংলার রাইফেল বাহিনী, পুলিশ, আনসার, স্বেচ্ছাসেবকদের সহিত পূর্ণ সহযোগিতা করুন। মনে রাখিবেন শত্রুকে কাবু করিতে না পারিলে কাহারও নিস্তার থাকিবে না। পরম করুণাময় সর্বশক্তিমান বিশ্ব প্রভুর উপর ভরসা রাখিবেন।’
নওগাঁ শহরের কাজীপাড়া এলাকায় টিনের চালা ঢাকা ও মুলি বাঁশের বেড়ায় ঘেরা অপরিসর একটি ঘরে একটি লেটার প্রেস। পায়ে চালানো একটি ট্রেডল মেশিন এবং কম্পোজের কিছু টাইপ কেস এই হলো এ প্রেসের সম্বল। প্রেস মালিক ছিলেন কাজী শাহ মাহমুদ এমপিএ। এই প্রেসেই ছাপা হয় জয় বাংলা পত্রিকা। পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলোর মূল কথা ছিল দেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছে, এখন একে ত্বরান্বিত করা; সকল শ্রেণির জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন ও অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা, অহেতুক আতঙ্ক সৃষ্টি ও গোলযোগের সুযোগে দুষ্কৃতিকারীরা যাতে তৎপর হতে না পারে সেদিকে মনোযোগ দেয়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর সরবরাহ নিশ্চিত ও নিয়ন্ত্রণ করা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও সংগ্রাম পরিষদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, সর্বদলীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, অভ্যন্তরীণ অনুচরদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা, মুক্তাঞ্চলে বেতার কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ ও তা সকলকে শোনার আহ্বান জানানো, যে-কোনো মূল্যে ঐক্য অটুট রেখে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া এবং বিজয় অর্জন পর্যন্ত কৃতসংকল্প থাকা ইত্যাদি। [আইয়ুব হোসেন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড