জয়দেবপুর রাজবাড়ি গণহত্যা (গাজীপুর সদর)
জয়দেবপুর রাজবাড়ি গণহত্যা (গাজীপুর সদর)জয়দেবপুর রাজবাড়ি গণহত্যা (গাজীপুর সদর) সংঘটিত হয় ৯ই এপ্রিল। এদিন হানাদার বাহিনী প্রায় ৩৫০ জন মানুষকে হত্যা করে।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বরুদার টুঙ্কার পুত্র রমিজ উদ্দীন শহীদ হন। পাকিস্তানি সৈন্যরা ৩০০ ছাত্র-যুবকের একটি দল ও জয়দেবপুর, টঙ্গী, কালিয়াকৈর, শ্রীপুর, ত্রিশাল, ভালুকা, কাপাসিয়া, কালীগঞ্জ ও মির্জাপুরের কিছু লোককে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বা কাউকে-কাউকে জোরপূর্বক জয়দেবপুর রাজবাড়িতে নিয়ে আসে এবং হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ছাত্রদের বেশিরভাই ছিল দ্বাদশ শ্রেণির। তাদের অনেকে রোভার স্কাউট, আনসার এবং সিভিল ডিফেন্স জাতীয় কিছু প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিল। যেহেতু তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, সেহেতু তারা হানাদারদের ভীতির কারণ ছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর ধারণা ছিল, যদি তারা বেঁচে থাকে তাহলে তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে। এ ধারণা থেকে হানাদার বাহিনী এ সকল হতভাগ্যকে ধরে এনে হত্যার জন্য জয়দেবপুর রাজবাড়িতে জড়ো করে। এ সময় সন্দেহজনক আরো কিছু লোককে ধরে এনে তাদের সঙ্গে রাখা হয়। তাদের সকলকে বন্দি করে রাজবাড়ির উত্তর-পূর্ব পার্শ্বস্থ প্রাসাদে রাখা হয়। সেখানে স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেককে উত্তর দিকের ডোবার পাড়ে এবং ক্লাবের পূর্বপাশে বেঁধে রাখা হয়। অনাহারে, অনিদ্রায় এবং অমানবিক শারীরিক নির্যাতনে এমনিতেই তারা ছিল ক্লান্ত-বিপর্যস্ত। তাদের পক্ষে কোনোরকম প্রতিরোধ কিংবা আত্মরক্ষার চেষ্টা করা সম্ভব হয়নি। ৯ই এপ্রিল দুপুর ১২টার দিকে ন্যাশনাল গার্ড বাহিনীর সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেমসহ ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের (ন্যাশনাল সার্ভিস) দেড় শতাধিক সৈন্যকে ৩টি ট্রাকে করে জয়দেবপুর রাজবাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সেখানে পূর্ব থেকে ধরে আনা আরো অনেককে বন্দি। অবস্থায় রাখা ছিল। এদিন দুপুরবেলা বন্দিদের ওপর এক সঙ্গে কয়েকটি গ্রেনেড ছুড়ে মারা হয়। শতশত মানুষের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে ছিটকে পড়ে এখানে-সেখানে এবং নিকটবর্তী ডোবায়। ডোবার জল রক্তবর্ণ ধারণ করে। মুক্তিযোদ্ধা কাজী আলিমউদ্দীন বুদ্দিন, আবুল কাশেম এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। গ্রেনেড হামলায় মারাত্মক আহত হয়ে তারা বেঁচে যান। একদিনইে প্রায় ৩৫০ জন বাঙালি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার শিকার হন।
ডোবার মধ্যে কয়েকজন নারীর লাশও দেখা যায়। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প হিসেবে ঐ প্রাসাদের মধ্যে নারীনির্যাতন চালানো হতো। এসব নারীদের হত্যা করে এ ডোবায় ফেলে দেয়া হতো। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হবার অব্যবহিত পরই গাজীপুরের জনতা এ ডোবায় উদ্ধার অভিযান চালায়। হত্যাযজ্ঞ ও নারীনির্যাতনের বিপুল পরিমাণ আলামত সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়। সেখানে মানব দেহের অসংখ্য হাড়- গোড়, জামা-কাপড়-ব্লাউজ, পেটিকোট, লুঙ্গি, বুলেট, বুলেটের খোসা, পরিত্যক্ত আগ্নেয়াস্ত্র ও গলিত লাশ পাওয়া যায়।
গাজীপুরের ইতিহাসে জয়দেবপুরের এ গণহত্যা পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর নির্মমতার এক করুণ দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। স্বাধীনতার পরে এ গণহত্যায় শহীদ রওশনের নামে চান্দনা চৌরাস্তার কাছে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। গণহত্যার দিনটি প্রতিবছর ‘জয়দেবপুর শহীদ দিবস’ এবং ‘জয়দেবপুর গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। [মনিরুজ্জামান শাহীন ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড