You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে জয়পুরহাট সদর উপজেলা

জয়পুরহাট সদর উপজেলা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর বিজয়ের পর ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এর বিরুদ্ধে সারাদেশের মতো জয়পুরহাটেও লাঠি মিছিল ও মশাল মিছিল কর্মসূচি শুরু হয়। ২রা মার্চ থেকে ৬ই মার্চ পর্যন্ত এ প্রতিবাদ বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর ২৩শে মার্চ জয়পুরহাটে আব্দুল মতলেব চৌধুরীর সভাপতিত্বে কাফেজ উদ্দিন আহমেদকে আহ্বায়ক ও মহাতাব উদ্দীন মণ্ডলকে যুগ্ম- আহবায়ক করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সংগ্রাম পরিষদের অন্য সদস্যরা হলেন- ডা. সাইদুর রহমান এমপিএ, আবুল হাসনাত চৌধুরী এমপিএ, আব্দুল মতলেব চৌধুরী, ডা. আবুল কাশেম, তোয়াব সওদাগর, মহিম চন্দ্র সরকার, শাকিল উদ্দিন আহমেদ, এমদাদুল বারী, সহনলাল বাজলা, বেলাল উদ্দিন সরদার, নূরুল হোসেন মণ্ডল, জালাল উদ্দিন মণ্ডল, আনিসুর রহমান প্রমুখ। সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারীদের কমিটিতে উপদেষ্টা হিসেবে রাখা হয়। এদিনই সরকারি ডাক্তারখানা মাঠে (বর্তমানে শহীদ ডা. আবুল কাশেম ময়দান) বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। সর্বদলীয়ভাবে গঠিত এ পরিষদ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, প্রশিক্ষণ পরিচালনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং কার্যক্রম চালাতে থাকে।
১৮ই মার্চ অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য শাকিল আহমেদের নেতৃত্বে জয়পুরহাট কলেজে প্রায় দেড়শতাধিক ছাত্র- যুবকদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রথম প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। সেখানে ক্যাপ্টেন আজিজুল বারী, আব্দুল কাদের এবং আব্দুল ওয়াদুদ সহযোগী প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রথমদিকে রাইফেল ছাড়াই বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলে। সংগ্রাম কমিটির সদস্যবৃন্দ এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা কাফেজ উদ্দিন আহম্মেদ, মহাতাব উদ্দীন (মহকুমা সেক্রেটারি, আওয়ামী লীগ), কে এম ইদ্রিস আলী (ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস), মির শহীদ মণ্ডল (মহকুমা সভাপতি; ন্যাপ- মোজাফ্ফর) ও খয়বর আলী (ন্যাপ, ভাসানী) প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের দিক-নির্দেশনা প্রদান করতেন। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে সহনলাল বাজলা খাবার সরবরাহ করতেন। কলেজ মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং পার্শ্ববর্তী আউসগাড়া স্কুল মাঠে মহড়া চলত। প্রশিক্ষণে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য মহাতাব উদ্দীন ও আনিছুর রহমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যান। পরবর্তীতে জয়পুরহাটের মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
জয়পুরহাটে মুক্তিযুদ্ধকালে কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন খন্দকার আসাদুজ্জামান বাবলু (বাঘা বাবলু), ক্যাপ্টেন আজিজুল বারী, জাকারিয়া হোসেন মন্টু, অনারারি ক্যাপ্টেন ইদ্রিস প্রমুখ।
জয়পুরহাট মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর শক্ত ঘাঁটি হওয়ার কারণে মুক্তিযোদ্ধারা এখানে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তেমন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি। রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য জয়পুরহাট স্টেশনের অদূরে উড়ি ব্রিজটি মুক্তিযোদ্ধারা ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করেন। ২৪শে এপ্রিল সান্তাহার থেকে ট্রেনযোগে এসে পাকবাহিনী জয়পুরহাট স্টেশনে অবস্থান নেয় এবং ক্যাম্প স্থাপন করে। ২৫শে এপ্রিল তারা জয়পুরহাট থানা দখল করে সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে এবং গাড়িয়াকান্ত, হাতিল বুলুপাড়া ও বুলুপাড়া মাঠে গণহত্যা চালায়। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তারা জয়পুরহাট কলেজে ক্যাম্প স্থাপন করে। কয়েকদিন পর তারা খঞ্জনপুর কুঠিবাড়ী ব্রিজ সংলগ্ন মিশন স্কুলসহ বৃহৎ এলাকা জুড়ে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করার পাশাপাশি পাগলা দেওয়ান, খাসপাহনন্দা ও জয়পুরহাট চিনিকলে ক্যাম্প স্থাপন করে। জয়পুরহাট ভারত সংলগ্ন হওয়ায় পাকবাহিনী এখানে শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করে। এর প্রমাণ পাগলা দেওয়ানে পাকবাহিনীর নির্মিত কংক্রিট বাংকার। জয়পুরহাটে পাকসেনাদের নেতৃত্বে ছিল মেজর আফজাল।
জামায়াতে ইসলামীর পূর্ব পাকিস্তান নায়েবে আমীর আব্বাস আলী খান এবং মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল আলীমের বাড়ি জয়পুরহাটে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আব্বাস আলী খান পাকিস্তানি তাবেদার মালেক সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। আবদুল আলীম স্বাধীনতা-উত্তর জেনারেল জিয়াউর রহমান সরকারের মন্ত্রী ছিল। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে উভয়ে জয়পুরহাটে শান্তি কমিটি, -রাজাকার- ও -আলবদর বাহিনী গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। আব্দুল আলীমের প্রত্যক্ষ মদদে সীমান্ত সংলগ্ন পাগলা দেওয়ান এবং কড়ই-কাদিপুর গ্রামে এক ভয়ঙ্কর গণহত্যা সংঘটিত হয়।
স্থানীয় কনভেনশন মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল আলীমকে (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল কর্তৃক আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত এবং বন্দি অবস্থায় ৩০শে আগস্ট ২০১৪ মৃত্যু) চেয়ারম্যান, জামালগঞ্জ রোডের আবুল কাশেমকে সেক্রেটারি এবং তোফাজ্জল হোসেন আকন্দকে কোষাধ্যক্ষ করে জয়পুরহাটে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সদস্যরা হলো- গোলাম মোতলেব চৌধুরী (সদর রোড), আশরাফ আলী সরদার (উত্তর-জয়পুর), সাদেক আলী মণ্ডল (ভেটী), মেহের উদ্দিন মাস্টার (বুলুপাড়া), ডা. মকবুল হোসেন (বিষ্ণুপুর), আহাদ আলী ডাক্তার, (বিষ্ণুপুর), আব্দুল মান্নান মৌলভী (বানিয়াপাড়া), খলিলুর রহমান (দেবীপুর), শামীম বিহারী, আতিকুল্লাহ বিহারী (জামালগঞ্জ সড়ক), আবু ইউসুফ মো. খলিলুর রহমান (বিএনপি-র সাবেক এমপি), হবিবর সরদার (থানা রোড), মোকলেসুর রহমান (ধানমন্ডি), মোজাফ্ফর মৌলভী (জোব্বার মণ্ডলপাড়া), গোলজার হোসেন (আরামনগর), কেরা বিশ্বাস (বিশ্বাস পাড়া), আকামুদ্দিন (তেঘর) প্রমুখ। এরা জয়পুরহাটের বিশিষ্ট সমাজসেবক ও ব্যবসায়ী সহনলাল বাজলার গদিঘরটি দখল করে শান্তি কমিটির অফিস হিসেবে ব্যবহার করে। এখানে বসেই কুখ্যাত রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধী আব্দুল আলীম নিরীহ বাঙালি হত্যা ও মহকুমাব্যাপী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দিত। খঞ্জনপুরের রাজাকার কমান্ডার সামসুল আলম ও শহীদুল্লাহ (স্বাধীনতার পরপর দালাল আইনে গ্রেপ্তার এবং উভয়ের যথাক্রমে ১০ বছর ও ৭ বছর কারাদণ্ড হয়। কিন্তু ৭৫-এর ১৫ই আগস্টের পর জেনারেল জিয়ার শাসনকালে তারা ছাড়া পায়)-র নেতৃত্বে রাজাকাররা জয়পুরহাটের পূর্ব বাজার এলাকায় অবস্থিত হাজারীমল আগরওয়ালার বাড়ি দখল করে সেখানে থাকত।
স্থানীয় রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যরা পাকসেনাদের সহায়তা দান ছাড়াও প্রাণভয়ে পালিয়ে যাওয়া লোকজনদের ঘরবাড়ি লুটপাট ও তাতে অগ্নিসংযোগ করে এবং এলাকায় একক আধিপত্য বিস্তার করে। তারা বিভিন্ন বাড়ি থেকে যুবতী মেয়েদের ধরে এনে মনোরঞ্জনের জন্য পাকসেনাদের হাতে তুলে দিত। এছাড়া রাজাকার সদস্যরা গরু-ছাগল ও হাস-মুরগি ধরে এনে পাকসেনা ক্যাম্পে সরবরাহ করত।
২৫শে এপ্রিল পাকসেনারা পৌর শহরের বুলুপাড়া মাঠে গণহত্যা চালায়। বুলুপাড়া মাঠ গণহত্যায় ১০ জন শহীদ হন। একই দিন তারা হাতিল বুলুপাড়া গ্রামের একই পরিবারের ৮ জনসহ ১৫ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে, যা হাতিল বুলুপাড়া গণহত্যা নামে পরিচিত। ঐদিনই তারা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি সংলগ্ন গাড়িয়াকান্ত এলাকায় অন্য এলাকা থেকে ধরে আনা ৩৬ জনকে গুলি করে হত্যা করে, যা গাড়িয়াকান্ত গণহত্যা – নামে পরিচিত। একই দিনে জয়পুরহাট সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ১নং গেটে প্রায় ৪০ জন সাধারণ মানুষকে তারা হত্যা করে, যা জয়পুরহাট সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ১নং গেট গণহত্যা নামে পরিচিত।
২৫শে এপ্রিল পাকসেনারা মাড়োয়ারী ব্যবসায়ী রাজ কুমার খেতানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ২৬শে এপ্রিল জয়পুরহাট শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার পূর্বদিকে বন্ধু ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত কড়ই-কাদিপুর গ্রামে শান্তি কমিটির সভাপতি আব্দুল আলীমের নির্দেশে পাকসেনারা নির্মম গণহত্যা চালায়। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে এখানে ৩৬১ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়, যা কড়ই-কাদিপুর গণহত্যা নামে পরিচিত।
আব্দুল আলীমের প্রত্যক্ষ মদদে সীমান্তবর্তী পাগলা দেওয়ান গ্রামে বিভিন্ন সময়ে ভারতগামী দশ সহস্রাধিক শরণার্থীকে পৈশাচিক কায়দায় পাকসেনারা হত্যা করে, যা পাগলা দেওয়ান গণহত্যা নামে পরিচিত।
৩০শে এপ্রিল আওয়ামী লীগ করার অপরাধে বিল্লাহ গ্রামের আব্বাস আলী মণ্ডলের (স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৮৬ সালে এমপি) পিতা ইয়াকুব আলীকে তারা নির্যাতনের পর জিপ গাড়ির সঙ্গে বেঁধে হত্যা করে। ১২ই মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক মজিবর রহমান দেবদাসকে (মহুরূল জয়পুরহাট) পাকবাহিনী ধরে নিয়ে বৈদ্যুতিক শক, রড দিয়ে পেটানো, স্পর্শ কাতর জায়গাগুলোতে সুঁই ঢোকানোসহ চরম নির্যাতন করে। অনেকদিন পর্যন্ত তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। মুসলমান হয়েও পাকহানাদার বাহিনীর মুসলমানের ওপর নির্মম নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড দেখে তিনি ঘৃণা আর ক্ষোভে পরবর্তীতে মজিবর রহমান নাম বাদ দিয়ে এফিডেফিট করে নাম রাখেন ‘দেবদাস’। স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীরা তাঁকে জীবন্ত শহীদ বুদ্ধিজীবী মজিবর রহমান দেবদাস (২০১৫ সালে একুশে পদকপ্রাপ্ত) বলে অভিহিত করেন। ৩১শে মে পাকসেনারা শহরের ইরাকনগরে নিজ বাড়ির সামনে আব্দুস সালামকে হত্যা করে। ৩রা জুন তারা শেরপুর কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে চাকরিরত প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মী মহসিন আলী দেওয়ানকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে। ১৭ই জুন সরদার পাড়ার ছাত্রলীগ কর্মী আলতাফ হোসেনকে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় তারা নির্মমভাবে হত্যা করে।
১৮ই জুন পাকসেনারা জুমার নামাজের পর পাগলা দেওয়ান গ্রামের মসজিদে গণহত্যা চালায়। পাগলা দেওয়ান মসজিদ গণহত্যায় স্কুল শিক্ষক বাহারউদ্দিন, সইমুদ্দিন, নাজিরউদ্দিন (পাহনন্দা), কাইমুদ্দিন, গানা সরদার, সিরাজুল, নিঝুম সরকার, মমতাজউদ্দিন, মোহাম্মদ আলীসহ প্রায় তিনশতাধিক মানুষ নিহত হয়।
স্টেডিয়ামের পূর্বপাশে বাঁশঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক মা তকিজন বিবি ও তার মেয়ে আনোয়ারা বেগমকে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে। তারা সেকেন্দার আলী (দোগাছী, ন্যাপ নেতা) ও আব্দুল মালেক (রাঘবপুর)-কে বাড়ি থেকে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় ধরে এনে কুঠিবাড়ি ব্রিজে নির্মমভাবে হত্যা করে। আওয়ামী লীগ নেতা ও বিশিষ্ট হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ডা. আবুল কাশেমকে তারা ধরে নিয়ে জয়পুরহাট স্টেশন এবং কলেজ ক্যাম্পে চরম নির্যাতন করে। এক পর্যায়ে তাঁর দুচোখ তুলে পেট্রোল দিয়ে আগুন দেয় এবং কুঠিবাড়ি ব্রিজের দক্ষিণ পার্শ্বে কোমর পর্যন্ত পুঁতে রেখে গুলি করে হত্যা করে। মল্লিকপুর গ্রামের বাড়ি থেকে এডভোকেট আব্দুল জোব্বারকে পাকবাহিনী জিপের সঙ্গে বেঁধে রাস্তার ওপর দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে জয়পুরহাট ক্যাম্প পর্যন্ত নিয়ে আসে এবং কলেজ মাঠে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করে। এখানে আওয়ামী লীগ কর্মী আলেফ উদ্দিন ও আমজাদকে নিমর্মভাবে হত্যা করা হয়। রেলগেটের লতিফ টি স্টলের মালিক লুৎফর রহমান ২৫শে মার্চের পর মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিল। ডান হাত অকেজো থাকায় বাম হাতে সে রাইফেল চালানো শেখে। এ কারণে স্থানীয় রাজাকাররা তাঁকে ধরে পাকসেনাদের হাতে তুলে দেয়। জয়পুরহাট স্টেশন পাকসেনা ক্যাম্পে অমানবিক নির্যাতন শেষে হাত পা বেঁধে ট্রেনের ইঞ্জিনের বয়লারে ফেলে তাঁকে জীবন্ত হত্যা করা হয়।
জয়পুরহাট চিনিকলে পাকসেনারা ২৭ জন সাধারণ মানুষকে বন্দি করে রাখে। তাদের মধ্যে ২৩ জনকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা জয়পুরহাট চিনিকল গণহত্যা- নামে পরিচিত। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালে এখানে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। সৃষ্টি হয় জয়পুরহাট চিনিকল বধ্যভূমি- নামে এক বৃহৎ হত্যাকাণ্ড স্থল। চিনিকল বন্দি শিবিরে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুল আলীম ও পাকসেনা কমান্ডার মেজর আফজাল নিয়মিত আসত এবং গণহত্যার নির্দেশ দিত। মুক্তিযোদ্ধা ফরিদুর রহমান বাবুলকে পাকসেনারা পাগলা দেওয়ান নির্যাতনকেন্দ্র (ফেরদৌস সাহেবের বাড়ি), জয়পুরহাট চিনিকল ও বগুড়া জেলখানায় নিয়ে নির্যাতন করে। পাগলা দেওয়ানের মোজাম্মেল হকের বাড়ি দখল করে পাকসেনারা ক্যাম্প স্থাপনের পাশাপাশি নারীনির্যাতন কেন্দ্রে পরিণত করে। শরণার্থীদের মধ্যে অল্পবয়স্ক মেয়েদের ধরে এ ক্যাম্পে এনে পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পর ভারত থেকে ফিরে এসে মোজাম্মেল হক তাঁর বাড়িতে মেয়েদের পরিধেয় কাপড়-চোপড়, চুরি, ফিতা, কানের দুল ও মাথার লম্বা চুল দেখতে পান।
খাসপাহনন্দা ক্যাম্প ও বন্দিশিবিরে মেয়েদের ধরে এনে বিবস্ত্র করে রাখা হতো। এখানে ৬২ জন শরণার্থীকে হত্যা করে পুঁতে রাখা হয়। এ ঘটনা খাসপাহনন্দা ক্যাম্প গণহত্যা- নামে পরিচিত এ ক্যাম্পে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ফজলুর রহমানের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। জয়পুরহাট কলেজ মাঠের পূর্বপার্শ্বের কাঁঠাল গাছে ঝুলিয়ে মুক্তিযোদ্ধাসহ স্বাধীনতার পক্ষের অসংখ্য ছাত্র-যুবকদের নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। এ কারণে ঐ স্থানটি জয়পুরহাট কলেজ মাঠ-সংলগ্ন বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত।
জয়পুরহাট চিনিকল ক্যাম্প, জয়পুরহাট কলেজ ক্যাম্প, খঞ্জনপুর কুঠিবাড়ি ব্রিজ সংলগ্ন ক্যাম্প, মিশন স্কুলের ছাত্রাবাস ক্যাম্প, খাসপাহনন্দা ক্যাম্প (ফেরদৌস সাহেবের বাড়ি), পাগলা দেওয়ান ক্যাম্প (মোজাম্মেল হকের বাড়ি) ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির।
মুক্তিযুদ্ধকালে পুরো জয়পুরহাটই ছিল একটি বধ্যভূমি। জয়পুরহাট চিনিকল, জয়পুরহাট কলেজ মাঠের পাশের বারোঘাটি পুকুর ছিল একটি বড় বধ্যভূমি। জয়পুরহাট কলেজ মাঠ সংলগ্ন বধ্যভূমি ছিল অপর একটি উল্লেখযোগ্য হত্যাকাণ্ডস্থল। শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সংলগ্ন পাগলা দেওয়ান গ্রাম ও পরিনণত হয়েছিল একটি বড় বধ্যভূমিতে। এখানে সহস্রাধিক শহীদের গণকবর রয়েছে। কড়ই-কাদিপুর গ্রাম দুটিও ছিল বধ্যভূমি। এখানে কয়েকটি গণকবর রয়েছে। এছাড়া খঞ্জনপুর কুঠিবাড়ি ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা ও চিনিকলের পূর্বপাশে গর্ত করে অনেক মানুষকে পুঁতে রাখা হয়।
পাগলা দেওয়ান পাকিস্তানি ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা একাধিকবার আক্রমণ করেন। কমান্ডার আবুল হোসেনের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল আগস্ট মাসের প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহে দুবার আক্রমণ চালান। এরপর ক্যাপ্টেন ইদ্রিসের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাগলা দেওয়ান পাকসেনা ক্যাম্প আক্রমণ করলে ৩ জন পাকসেনা নিহত এবং বেশকিছু অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। দুদিন পরে ক্যাপ্টেন ইদ্রিস এবং হাবিলদার মকবুলের নেতৃত্বে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ফার্সিপাড়ায় অভিযান পরিচালনা করলে পাকসেনাদের দোসর মুসলিম লীগ নেতা মোজাফফর হোসেন চৌধুরী নিহত হয়। পরবর্তীতে কমান্ডার আসাদুজ্জামান বাবলুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় পাগলা দেওয়ান পাকসেনা ক্যাম্প আক্রমণ করলে ৫২ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং অনেকগুলো অস্ত্র তাদের হস্তগত হয়। এটি পাগলা দেওয়ান পাকিস্তানি ক্যাম্প আক্রমণ হিসেবে এলাকায় পরিচিত। ১২ই ডিসেম্বর হিলি থেকে পলাতক পাকসেনাদের সঙ্গে গোপীনাথপুর, রায়কালী ইউনিয়নের গড়ম্বা ও কাশিড়াহাটের নিকট সম্মুখ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে দুজন পাকসেনা নিহত হয় এবং অনেকগুলো অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। সীমান্তবর্তী দুগোড় ও ঝাউলী বুড়িরঘাট এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে বহু পাকসেনা হতাহত হয়।
১৪ই ডিসেম্বর জয়পুরহাট হানাদারমুক্ত হয়। এদিন কমান্ডার খন্দকার আসাদুজ্জামান বাবলুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ডাকবাংলোয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। জয়পুরহাটে শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুর রশিদ (পিতা বশরত আলী, দক্ষিণ পশ্চিম জয়পুরহাট; ভারতীয় সীমানা সংলগ্ন পশ্চিম দিনাজপুরের হামজাপুর নামক স্থানে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), নায়েক আব্দুর রউফ (পিতা আব্দুর রশিদ খান, খেশবপুর, মোহাম্মদাবাদ), তফিজ উদ্দিন (পিতা শফির উদ্দিন, ছাওয়াল পাড়া, ভাদসা), নাজির হোসেন (পিতা আছির ফকির, কুজিশহর, মোহাম্মদাবাদ), আজিম উদ্দীন (পিতা রিয়াজ উদ্দিন সরকার, সাহাপুর, জামালপুর)। উপর্যুক্ত তিনজনই পাঁচবিবির গোহাটিতে পাকসেনাদের সঙ্গে প্রতিরোধযুদ্ধে শাহদত বরণ করেন।
শহীদ ডা. আবুল কাশেম স্মরণে জয়পুরহাট সরকারি ডাক্তারখানা মাঠের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ ডা. আবুল কাশেম ময়দান। সেখানে একটি শহীদ মিনার ও ৭১ ফুট উঁচু স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার প্রতিষ্ঠান জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন জয়পুরহাট জেলা শাখার উদ্যোগে পাগলা দেওয়ান গণকবরে হাজার শহীদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। কড়ই-কাদিপুর গ্রামে গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। শহীদ এডভোকেট আব্দুল জোব্বার স্মরণে মঙ্গলবাড়িতে একটি বালিকা বিদ্যালয় ও বগুড়া জলেশ্বরীতলা সড়কটি শহীদ আব্দুল জোব্বার সড়ক নামে নামকরণ করা হয়েছে। জয়পুরহাট স্টেশন রোড শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ স্মরণি, বাজার গলি শহীদ রাম কুমার স্মরণি, বড় মসজিদ রোড শহীদ আব্দুস সালাম স্মরণি, জামালগঞ্জ রোড শহীদ আলতাফ হোসেন স্মরণি, বানিয়াপাড়া মাদ্রাসা রোড শহীদ কবি মাহ্তাব উদ্দিন আহম্মেদ সড়ক নামে নামকরণ করা হয়েছে। বিল্লাহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নাম শহীদ ইয়াকুবীয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং দোগাছী প্রাথমিক স্কুলের দোগাছী শহীদ সেকেন্দার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া জয়পুরহাট শহরে শহীদ কবি মাহ্তাব উদ্দিন বিদ্যাপীঠ নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে। [শাহাদুল ইসলাম সাজু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!