You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে জকিগঞ্জ উপজেলা (সিলেট)

জকিগঞ্জ উপজেলা (সিলেট) ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণের প্রভাব সারা দেশের মতো জকিগঞ্জেও পড়ে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে উপজেলার সর্বত্র অসহযোগ আন্দোলন – শুরু হয়। ২৫শে মার্চ ঢাকায় পাকবাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে ২৮শে মার্চ রাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ- নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে থানার ইপিআর ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনা হত্যার মধ্য দিয়ে জকিগঞ্জে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য আব্দুল লতিফ এমপিএ এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় এলাকার যুবকদের ভারতে পাঠানো হয়। তারা ভারতের বারপুঞ্জি, লোহারবন্দ, চাকুলিয়া, দেরাদুনসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
জকিগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃস্থানীয় সংগঠকরা হলেন- -দেওয়ান ফরিদ গাজী- এমএনএ, আব্দুল লতিফ এমপিএ, আব্দুল আজিজ (কোটুলা আজি), আব্দুল রহিম সরপঞ্চ, নিসার আলী মোক্তার, আব্দুল মজিদ (বলই মিয়া), ডা. করুণা শর্মা, স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুর রহমান মাস্টার প্রমুখ। ছাত্রনেতাদের মধ্যে ছিলেন এম সি কলেজের ভিপি আকরাম আলী, মাহতাব আহমদ, আব্দুল বাইস, বদরুল হক, আলী হায়দর প্রমুখ। দেওয়ান ফরিদ গাজী ৩রা এপ্রিল ভারতের করিমগঞ্জ গিয়ে আসাম সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশী শরণার্থীদের থাকা-খাওয়া এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহের ব্যবস্থা করেন।
১৯শে মে পাকবাহিনী জকিগঞ্জে প্রবেশ করে এবং ডাকবাংলোতে প্রধান ক্যাম্প স্থাপন করে। পরে তারা আটগ্রাম ডাকবাংলো, আটগ্রাম চৌমুহনী ও শরিফগঞ্জ বাজারে আঞ্চলিক ক্যাম্প স্থাপন করে।
পাকবাহিনী জকিগঞ্জে প্রবেশের পর উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির তবারক আলী (খলাছড়া), মুসলিম লীগ-এর সভাপতি এডভোকেট শামসউদ্দিন (মাইজকান্দি), মাহমুদুর রহমান, আব্দুল লতিফ, এডভোকেট সামছুল ইসলাম, হারুনুর রশিদ, তছদ্দর আলী (ইউপি চেয়ারম্যান), আফতাব উদ্দিন (ইলাবাজ), আইনুল হক (ইলাবাজ) প্রমুখ তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এরা পাকসেনাদের সহায়তার উদ্দেশ্যে শান্তি কমিটি -, – রাজাকার -, আলবদর- ও -আলশামস বাহিনী গঠন করে। হাইদ্যাবন্ডের প্রভাবশালী ব্যক্তি মাহমুদুর রহমানকে সভাপতি করে শান্তি কমিটি এবং ফুলতলীর ইসলামী নেতা আব্দুল লতিফকে প্রধান করে প্রায় পাঁচশ সদস্যবিশিষ্ট রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠিত হয় আফতাব উদ্দিনের নেতৃত্বে। জকিগঞ্জে আলবদর বাহিনী “খনতি বাহিনী’ নামে পরিচিত ছিল। এ বাহিনীর সদস্যরা ছিল খুবই ভয়ঙ্কর।
১৯শে মে পাকবাহিনী জকিগঞ্জ বাজারে প্রবেশ করে ফরিদ নামে পিরেরচক গ্রামের এক শিশুকে গুলি করে হত্যা করে। পরের দিন ২০শে মে তাদের দালাল ছখই মিয়ার প্ররোচনায় তারা বিলেরবন্দ গ্রামের রহমান আলীকে হত্যা করে। অপর এক দালাল কুটু মিয়া মাছাইর চকের রুয়াব আলীকে হত্যা করে। বর্তমান উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার আব্দুল মোতালেব মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কারণে তাঁর পিতা মুজম্মিল আলীকে মতছিন আলী (রাজাকার কমান্ডার), খলিল উদ্দিন খান, আসাদ উদ্দিন খান ও আফতাব উদ্দিন বাড়ি থেকে রাজাকার ক্যাম্পে ধরে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এরপর ১৯শে আষাঢ় (জুন মাসের শেষদিকে) জকিগঞ্জ পৌর শহরের পালপাড়ায় সুধীর পালের বাড়িতে এনে পৌর এলাকার জল্লাদ মস্তু মিয়া তাকে (মুজম্মিল আলী) গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া খলিলুর রহমান, মতি মিয়া ও শফি মিয়া এবং মুদরিছ আলী পাকসেনাদের সহায়তায় এলাকার অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। পালবাড়িতে উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে এনে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ ঘটনা পালবাড়ি গণহত্যা নামে পরিচিত।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আব্দুর রকিব, মুদরিছ আলী, আব্দুল মান্নান প্রমুখ উপজেলার সোনাসার, মানিকপুর, দরিয়াপুর প্রভৃতি এলাকায় নারীনির্যাতন করে। মন্তইন গ্রামের হুসনু বেগমের ওপর পাকসেনারা নির্যাতন চালায়। তিনি একজন বীরাঙ্গনা। ১৯শে মে জকিগঞ্জে প্রবেশের পর পাকবাহিনী রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল লতিফ এমপিএ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুর রহমান মাস্টার, আব্দুল আজিজ (কোটুলা আজি), আব্দুল রহিম সরপঞ্চ, নিসার আলী মোক্তার, আব্দুল মজিদ (বলই মিয়া), ডা. করুণা শর্মা, নূর উদ্দিন মেম্বার ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সদস্য আনোয়ার হোসেন (সোনাউল্লাহ)-এর বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পরের দিন ২০শে মে মদন মোহন কলেজ ছাত্রলীগ কর্মী এবং বর্তমান উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাজী খলিল উদ্দিনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়া স্বাধীনতার পক্ষের আরো অনেকের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বাবুল আহমদের নেতৃত্বে উপজেলা সদরের মতছিন আলী, কুটু মিয়া, ফয়জুল হক (বরই মিয়া), লিয়াকত আলী (বসু মিয়া), নজির আহমদ ফাখই, মঈন উদ্দিন, ছখাই মিয়া প্রমুখ এলাকার হিন্দুদের এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের বাড়িঘর লুট করে। জকিগঞ্জ থানা ও ডাকবাংলোয় ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। এখানে উপজেলার বিভন্ন অঞ্চল থেকে নিরীহ লোকদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো।
জকিগঞ্জ পৌর শহরের পালবাড়ি এলাকার সতীশ পাল, সুধীর পাল ও করুণা পালের বাড়িতে অনেক লোককে হত্যা করা হয়। হত্যার আগে তাদের দিয়ে কবর খুঁড়িয়ে সেই কবরেই তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। এ এলাকার বাইরে শহীদ ৯ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ আরো কয়েকজনকে এখানে কবর দেয়া হয়। হত্যা ও কবরের স্থান তিনটি একত্রে পালবাড়ি বধ্যভূমি ও গণকবর নামে পরিচিত। এছাড়া পশ্চিম লোহারমহলে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী গণহত্যা চালায়।
২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনীর বর্বর গণহত্যার প্রতিশোধ নেয়ার উদ্দেশ্যে ২৮শে মার্চ রাতে জকিগঞ্জের মেকাই মিয়া, চুনু মিয়া, আসাইদ আলী, ওয়াতির মিয়া, তজমিল আলী, মশুর আলী, হাবিলদার খুরশিদ, করনিক আব্দুল ওয়াহাব, সিগনালম্যান আব্দুল মোতালেব প্রমুখ জকিগঞ্জ ও মানিকপুর ইপিআর ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এতে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। এটাই ছিল জকিগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম অপারেশন। পরবর্তীকালে সুষ্ঠুভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হলে জকিগঞ্জ ৪নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন মেজর সি আর দত্ত, বীর উত্তম-। তাঁর নির্দেশনায় জকিগঞ্জে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে আটগ্রাম, গোটারগ্রাম, শরিফগঞ্জ ও সোনাপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর একাধিক যুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন বর্তমান উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাজী খলিল উদ্দিন। কিন্তু সোনাপুর যুদ্ধে পাকসেনাদের ছোড়া মর্টারের গোলায় আহত হয়ে তিনি ১৪-২২শে নভেম্বর পর্যন্ত আসামের করিমঞ্জ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। জকিগঞ্জে দুটি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হলো আটগ্রাম যুদ্ধ ও জকিগঞ্জ থানাযুদ্ধ। আটগ্রাম যুদ্ধ হয় তিনবার নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দুবার এবং এ মাসেরই ২০ তারিখ। এতে পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং প্রায় একশ পাকসেনা নিহত হয়। জকিগঞ্জ থানাযুদ্ধ সংঘটিত হয় ২০শে নভেম্বর। এদিন মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী যৌথভাবে জকিগঞ্জ থানা আক্রমণ করে। পাকবাহিনীর সঙ্গে তাদের ১২ ঘণ্টাব্যাপী তুমুল যুদ্ধ হয়। শেষপর্যন্ত যৌথবাহিনীর সঙ্গে না পেরে পাকবাহিনী পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে বহু লোক হতাহত হয়। কয়েকজন পাকসেনা বন্দি হয়। এ-সময় ভারতীয় বাহিনীর মেজর চমন লাল ও তাঁর দুই সহযোগী জকিগঞ্জ কাস্টমস ঘাট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন।
জকিগঞ্জ থানাযুদ্ধে পরাজিত হয়ে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা আটগ্রামে জড়ো হলে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে তাদের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে অর্ধশতাধিক পাকসেনা ও রাজাকার হতাহত হয় এবং অনেকে বন্দি হয়। অবশিষ্ট পাকসেনা ও রাজাকাররা কানাইঘাটের দিকে পালিয়ে যায়। ফলে ২১শে নভেম্বর জকিগঞ্জ হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- ফজলুল হক, বীর প্রতীক- (পিতা আরজদ আলী, খাদিমান)।
জকিগঞ্জের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- ফরিদ আলী (পিতা রইছ আলী, আমলশীদ; পালবাড়ি গণকবরে সমাহিত), আব্দুছ সালাম (পিতা কুতুব আলী, পিল্লাকান্দি; পালবাড়ি গণকবরে সমাহিত), আব্দুল করিম (পিতা মির্জান আলী, আমলশীদ; মৌলভীবাজারের শেরপুর এলাকায় শহীদ), মো. আনোয়ার হোসেন (পিতা হাজী ইব্রাহীম আলী, চারিগ্রাম; জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর পেট্রোবাংলার পাশে সমাহিত), মন্তাজ আলী (পিতা আব্দুল গফুর, চারিগ্রাম; কানাইঘাট উপজেলায় সুরমা নদীর তীরে সমাহিত), ইপিআর আব্দুল হামিদ খাঁন (পিতা ইমদাদ আলী খাঁন, পাঠানচক; সুনামগঞ্জের মঙ্গলকাটি গ্রামে শহীদ), মো. বদরুল হক (পিতা মাওলানা নজরুল হক, চারিগ্রাম; জৈন্তাপুর উপজেলার চিকনাগুল এলাকায় শহীদ), একরাম আলী (পিতা কটাই মিয়া, নওয়াগাঁও), নূরুল ইসলাম (পিতা মো. মকদম আলী, বুরহানপুর; সেনাসদস্য, কানাইঘাট উপজেলার উত্তরে ভারতের মুক্তাপুরে সমাহিত), ইপিআর বজলুল করিম (পিতা এমদাদুর রহমান, পীরনগর; চট্টগ্রামে চাকরিরত অবস্থায় শহীদ), ল্যান্স নায়েক কামাল হোসেন (ইপিআর সদস্য), সিপাহি কাজী আব্দুল খালেক (পিতা কাজী আব্দুর রকিব, উত্তরকুল; সেনাসদস্য, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে শহীদ) এবং ল্যান্স নায়েক আব্দুল গনি (ইপিআর সদস্য)।
জকিগঞ্জে পালবাড়ি গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে জকিগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে একটি স্মৃতিফলক এবং আটগ্রাম যুদ্ধে তিনজন শহীদের কবরের পাশে একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। তাছাড়া, পশ্চিম লোহারমহলে গণহত্যার শিকার শহীদদের নামফলকসহ গণকবর রয়েছে। [আল হাছিব তাপাদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!