বীর বিক্রম জগৎজ্যোতি দাস
জগৎজ্যোতি দাস, বীর বিক্রম (১৯৪৯-১৯৭১) খেতাবপ্রাপ্ত শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও দাস বাহিনীর প্রধান। ১৯৪৯ সালের ২৬শে এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ থানার জলসুখা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম জিতেন্দ্র দাস এবং মাতার নাম হীরামতি দাস। দুই ভাই আর দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন তিনি। তাঁর পিতা এবং বড় ভাই পেশায় ছিলেন রাজমিস্ত্রী। জগৎজ্যোতি দাস- এর ডাক নাম শ্যাম। নিজ গ্রামে পাঠশালা পর্যন্ত পড়াশোনার পর তিনি আজমিরীগঞ্জের বীরচরণ হাইস্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন। প্রতিবাদী স্বভাবের জগৎজ্যোতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় থেকেই বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। পিতার আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে পিতৃব্য ননীগোপালের আসামের বাসায় থেকে সেখানকার নওগা কলেজ থেকে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তাঁর চাকরি হয়, কিন্তু প্রশিক্ষণ শেষে চাকরিতে যোগ না দিয়ে তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। আর্থিক অভাব-অনটনের কারণে বিএ ক্লাসে ভর্তির জন্য তিনি হবিগঞ্জের বৃন্দাবন কলেজে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। সাময়িকভাবে লেখাপড়া স্থগিত রেখে জগৎজ্যোতি জলসুখা কৃষ্ণগোবিন্দ পাবলিক হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। এক বছর চাকরি করে পরবর্তীতে সুনামগঞ্জ কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। কলেজে থাকাকালে পিকিংপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন-এর সঙ্গে যুক্ত হন এবং মহকুমা শাখার সদস্যপদ লাভ করেন। এক পর্যায়ে স্থানীয় এক জমিদারের দখলে থাকা খাস জমি উদ্ধারের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে তিনি হামলার শিকার হন। জলসুখায় শিক্ষকতা করার সময় জগৎজ্যোতি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মার্চের ← অসহযোগ আন্দোলন-এ ভূমিকা রাখেন। কলেজে অধ্যয়নকালে তাঁর বয়স ছিল ২১ বছর। এ বয়সেই তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। একাত্তরের দিনগুলোতে সারা দেশের মতো সুনামগঞ্জও ছিল আন্দোলনে উত্তাল। সুনামগঞ্জ শহরে সকল আন্দোলন কর্মসূচিতে জগৎজ্যোতি অগ্রভাগে ছিলেন। ২৭শে মার্চ পাকবাহিনীর একটি ছোট দল সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউসে এসে অবস্থান নিলে স্থানীয় জনতা সেখান থেকে তাদের বিতাড়িত করতে রাজপথে নামে। তাদের তীব্র প্রতিরোধে পাকবাহিনী সে-সময় সুনামগঞ্জ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এর পরে স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদ মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত ও প্রশিক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং দুটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে। এ প্রক্রিয়ায় জগৎজ্যোতির ভূমিকা সকলের প্রশংসা অর্জন করে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে সুনামগঞ্জ শহর পাকবাহিনীর দখলে চলে যাবার পর স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ও মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের বালাট চলে যান। সেখান থেকে প্রথমে ১১৪ জনের একটি দলকে শিলংয়ের গভীর অরণ্যে প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করা হয়। আসামে পড়ার সুবাদে হিন্দি ও ইংরেজি ভাষা সম্পর্কে ভালো ধারণা ছিল জগৎজ্যোতির। ফলে উক্ত দলের নেতৃত্বে দেয়া হয় জগৎজ্যোতিকে। ভারতে মেজর বাট্ট ও ক্যাপ্টেন বার্মার তত্ত্বাবধানে এ দলটি ইকো-১ ট্রেনিং সেন্টারে ৩২ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে অপারেশনের উদ্দেশ্যে বালাট দিয়ে টেকেরঘাট পৌঁছায়। জগৎজ্যোতির নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের এ দলটি পরবর্তীকালে ভাটি অঞ্চলে দাস পার্টি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
৫ নং সেক্টরের টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের অধীন এলাকা ছিল জগৎজ্যোতির যুদ্ধক্ষেত্র। এই সাব-সেক্টরের অধীন এলাকা ছিল ভাটি অঞ্চল হিসেবে খ্যাত দিরাই, শাল্লা, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, ছাতক ও আংশিকভাবে কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার কিছু অংশ। ভাটি অঞ্চলের সঙ্গে ভৌগোলিকভাবে হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ ও লাখাই থানাও অন্তর্ভুক্ত। এলাকাটি ৩নং সেক্টরের অধীন থাকা সত্ত্বেও যোগাযোগ সমস্যার কারণে ঐ অঞ্চলে সংশ্লিষ্ট সেক্টর থেকে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি।
এতদঞ্চলের বিভিন্ন যুদ্ধে জগৎজ্যোতি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের প্রায় প্রতিটি থানা তাঁর নেতৃত্বে শত্রুমুক্ত হয়। তাহিরপুর থেকে জামালগঞ্জ, দিরাই, খালিয়াজুড়ী, মদন, আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং, বাহুবল হয়ে আশুগঞ্জ পর্যন্ত দেশী নৌকা নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি ছুটে বেড়াতেন। এলাকা তাঁর নেতৃত্বে শত্রুমুক্ত হয়। জগৎজ্যোতি কুশিয়ারা নদীতে একটি কার্গো ডুবিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে তাঁর অভিযান শুরু করেন। এরপরে পাকবাহিনীর বহু নৌযান তাঁরা ধ্বংস করেন। গ্রামাঞ্চলে পাকবাহিনী ও তাদের দোসর কর্তৃক নির্যাতনের জবাব দিয়ে এ অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তিশালী উপস্থিতি জানান দেন জগৎজ্যোতি দাস। তাঁর অভিযানের মধ্যে ভেড়ামোহনায় কার্গো কনভয় ধ্বংস, বদলপুর ব্রিজ ধ্বংস, আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং, জামালগঞ্জ, খালিয়াজুড়ী, দিরাই ও শাল্লা থানা আক্রমণ, পাহাড়পুর, শ্রীপুর, রানীগঞ্জ ও কাদিরগঞ্জ অপারেশন উল্লেখযোগ্য। এ সকল অভিযানে তিনি তাঁর যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখেন। জগৎজ্যোতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অপারেশন হচ্ছে বদলপুর যুদ্ধ। তাঁর অন্য একটি দুঃসাহসিক অপারেশন ছিল সাচনা বাজার ক্যাম্প ও বাংকার অপারেশন। অকুতোভয় বীর সেনানী জগৎজ্যোতির অন্যতম সহযোদ্ধা ছিলেন জামালগঞ্জের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব আলী। তাঁর আস্থাভাজন ও সর্বকনিষ্ঠ সহযোদ্ধা ছিলেন ১৮ বছরের ইলিয়াছ চৌধুরী। জীবন বাজী রেখে অসীম সাহস নিয়ে পাকবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন জগৎজ্যোতি ও তাঁর দলের মুক্তিযোদ্ধারা। দিরাই শত্রুমুক্ত করার পেছনে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় জগৎজ্যোতিকে দেখলে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা সাহস আর অনুপ্রেরণা পেতেন। মার্কুলীর কাছে পাকআর্মির জাহাজ ডুবিয়ে দেয়ার কৃতিত্ব ছিল সম্পূর্ণ তাঁর। জগৎজ্যোতির দলের ভয়ে এক পর্যায়ে পাকসেনারা ভৈরব থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত নদীপথে যান চলাচল বন্ধ করতে বাধ্য হয়। পাকবাহিনী তাঁকে টার্গেট করে এয়ারর্ফোস সার্পোটসহ কমান্ডো টিম পাঠায়। ১৬ই নভেম্বর হবিগঞ্জের বানিয়াচরের বদলপুর যুদ্ধ-এ তিনি শহীদ হন। এরপরে তাঁর লাশ প্রদর্শনীর জন্য পাকসেনারা আজমিরীগঞ্জ বাজারে নিয়ে গিয়ে একটি বিদ্যুতের খুটির সঙ্গে বেঁধে পেরেকবিদ্ধ করে রাখে। অগণিত জনতার সামনে একটানা তিনদিন এই লাশের ওপর নানাভাবে নির্যাতন চালাতে থাকে। অবশেষে বর্বরতার সাক্ষী হিসেবে জগৎজ্যোতির ছবি তুলে হানাদাররা তাঁর লাশ ভেড়ামোহনা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। নদীতে ভাসমান জগৎজ্যোতির লাশ একসময় অথৈ পানির তলে হারিয়ে যায়। হারায়নি কেবল তাঁর স্মৃতি। ভাটি অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথায় ‘জগৎজ্যোতি’ নামটি আজো ভেসে বেড়ায় মানুষের মুখে-মুখে।
জগৎজ্যোতি দাস হবিগঞ্জ জেলার সন্তান হলেও তাঁর গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলো ছিল সুনামগঞ্জ-নির্ভর। তাঁর স্মৃতিকে ধারণ করার জন্য সুনামগঞ্জবাসী সুনামগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরির নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করেছে ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি স্মৃতি পাঠাগার’। এছাড়া নিজ থানা আজমিরীগঞ্জ উপজেলা কমপ্লেক্স থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত সড়কের নাম ‘শহীদ জগৎজ্যোতি দাস বীর বিক্রম সড়ক’ রাখা হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে অসাধারণ অবদান ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করে।
হবিগঞ্জ জেলা পরিষদের সামনে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ ‘দুর্জয়’-এর পার্শ্ববর্তী শহীদ বেদীর ফলকে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের নামের সঙ্গে জগৎজ্যোতি দাস বীর বিক্রম’ নামটি স্থান পেয়েছে। [আকবর হোসেন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড