জগৎপুর গণহত্যা (ঝিনাইগাতী, শেরপুর)
জগৎপুর গণহত্যা (ঝিনাইগাতী, শেরপুর) সংঘটিত হয় ৩০শে এপ্রিল। এখানে ৫৮ জন নারী-পুরুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা কামারুজ্জামান ও স্থানীয় দালালদের সহায়তায় পাকবাহিনী এ গণহত্যা সংঘটিত করে। এ গ্রামে সেদিন লুণ্ঠন চলে এবং শতাধিক বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
২৫শে মার্চের কালরাতের পর সারাদেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও জগৎপুর ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম। এখানকার হিন্দু- মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পূর্ব থেকে সম্প্রীতি ছিল। তাই এ গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন দেশ ত্যাগ করতে চাইলেও মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। রাত জেগে পাহারা দিয়ে তাদের নিরাপত্তা বিধান করে। শুধু এ গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনই নয়, আরো ৫ শতাধিক হিন্দু পরিবারের মানুষ নিরাপদ ভেবে জগৎপুরে আশ্রয় নেয়। এ গ্রামের মানুষও তাদের আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করে। কিন্তু শেরপুরে পাকহানাদার বাহিনী আস্তানা গড়ার এক সপ্তাহের মাথায় পাকিস্তানি দালালরা এখানে সক্রিয় হয়ে ওঠে ৷ বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ধন-সম্পদ ও জমি-জমার ওপর তাদের দৃষ্টি পড়ে। ফলে ৩০শে এপ্রিল সকাল ৮টায় গ্রামের মানুষ যখন গৃহস্থালির কাজে ব্যস্ত, তখন জামায়াত নেতা কামারুজ্জামান, সালদা গ্রামের আজিজুর রহমান, গোপালখিলা গ্রামের কদর খলিফাসহ স্থানীয় দালালরা পাকসেনাদের নিয়ে গ্রামে প্রবেশ করে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই তারা অবিরাম গুলিবর্ষণ শুরু করে। বিভিন্ন বাড়ির সব মালামাল লুটে নিয়ে বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। অনেক বাড়ি ভস্মীভূত হয়। ভয়ে আত্মরক্ষার্থে লোকজন যে যেদিকে পারে পালাতে থাকে। অনেকে গ্রামের পার্শ্ববর্তী রংগা বিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তবুও তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। যারা চোখের সামনে পড়ে তাদেরই হায়েনার দল গুলি করে হত্যা করে। সেদিন এ গ্রামে ৫৮ জন নারী ও পুরুষ নিহত হয়। নিহতদের ৪২ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের।
জিতেন্দ্র চন্দ্র দত্ত নামের একজন পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন এ গ্রামের বিত্তবান কৃষক মানিক ফকিরের বাড়িতে। পাকসেনারা সেখানে গিয়ে তাকে ধরে ফেলে। জানতে চায় তিনি মুসলমান না হিন্দু। তাকে বাঁচানোর জন্য মানিক ফকির জিতেন্দ্রকে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দেন। কিন্তু বিশ্বাস হয়নি তাদের। তারা জিতেন্দ্রকে উলঙ্গ করে নিশ্চিত হয় তিনি হিন্দু। এরপর মানিক ফকির ও জিতেন্দ্রকে এক সঙ্গে দাঁড় করিয়ে পরপর ৪ রাউন্ড গুলি করে হত্যা করে। গ্রামের ধরণী মোহন দে তালুকদার, তার স্ত্রী সুভাষিনী দে, তার ভাই দেবীচরণ দে তালুকদার-সহ ৪ জনকে হত্যা করে বাড়ির উঠোনে। বানিয়াচান্দি পাড়ার গঙ্গাচরণ, তার স্ত্রী ও কন্যাকে হত্যা করা হয় বাড়ির পাশের ঝোপ থেকে বের করে এনে। প্রায় ৩ ঘণ্টা তাণ্ডব চালিয়ে হায়েনার দল মণীন্দ্র চন্দ্র দে, সরোজিনী, ভজন চন্দ্র দে, হাসেন বাইন্যা, সাদর আলী, রশীদের স্ত্রী, আলতা বাইন্যা, আছিম উদ্দিন, আছিমদ্দিন সোনারু, আয়েত উল্লাহর ভাই, রফদ উল্লা প্রমুখকে হত্যা করে। গিরিবালা দে, স্বপ্না দে, হরিপদ, হরিপদ দে, মালতি রাণী দে, জমশেদ আলী, কুলু রাণী দে, শ্যামল চন্দ্র দে, নীলু চন্দ্র দে-সহ অর্ধ শতাধিক মানুষ মারাত্মকভাবে আহত হয়। পুড়ে ছারখার হয় শতাধিক ঘরবাড়ি।
পাকহানাদার ও তাদের দোসররা গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সারা গ্রামে নিথর লাশগুলো পড়ে থাকে। সেদিন পথেঘাটে ও বিলের পানিতে পড়েছিল লাশ। ছোপ-ছোপ রক্তের ওপর পড়েছিল অনেকের অসার দেহ। বাড়িগুলো জ্বলছিল। চারপাশে ছিল ভীতিকর পরিবেশ। এর মধ্যে ধরণী মোহন দে তালুকদার, তার স্ত্রী সুভাষিনী দে, ভাই দেবীচরণ দে তালুকদার-সহ ১৫ জনের লাশ পুকুরপাড়ে খড় দিয়ে মুখাগ্নি করা হয়। অধিকাংশ লাশের ভাগ্যে সৎকার জোটেনি। জগৎপুরে এখনো কোনো স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়নি। [এম এ হাকাম হীরা ও কোহিনূর রুমা]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড