You dont have javascript enabled! Please enable it! জগন্নাথদিঘি যুদ্ধ (চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা) - সংগ্রামের নোটবুক

জগন্নাথদিঘি যুদ্ধ (চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা)

জগন্নাথদিঘি যুদ্ধ (চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা) একাধিকবার সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এসব যুদ্ধে শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জগন্নাথদিঘি এলাকা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপর জগন্নাথদিঘিসহ চৌদ্দগ্রামের আশপাশের এলাকাগুলোতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধের প্রস্তুতি চলতে থাকে। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সারাদেশে আক্রমণ করলে প্রতিরোধ হিসেবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দসহ জনগণ ঢাকা-চট্টগাম মহাসড়কের চৌদ্দগ্রামের হায়দার ব্রিজ, জগন্নাথদিঘি ও আমজাদের বাজার ব্রিজ ভেঙ্গে ফেলে।
১৩ই এপ্রিল থেকে ডিমাতলী ওয়ার্কার্স ক্যাম্প নামে এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যক্রম শুরু হয়। সঠিক অপারেশনের জন্য গোয়েন্দা রিপোর্ট ও রেকির ব্যবস্থা করা হতো এ ক্যাম্প থেকে। এ ক্যাম্পের সদস্যরা অবজারভেশন পোস্ট (ওপি) হিসেবেও কাজ করতেন এবং অন্যান্য মুক্তিসেনা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। বিলোনিয়া সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম, লে. মাহবুব, লে. ইমাম-উজ-জামান, সুবেদার মাহাবুব, নায়েব সুবেদার কালাম ও ভারতীয় ক্যাপ্টেন আগরওয়ালের সক্রিয় সহযোগিতায় এ ক্যাম্প ক্যাম্প থেকে গেরিলা পদ্ধতিতে অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয়।
২৬শে মে রাত ১১টায় লেফটেন্যান্ট ইমাম-উজ-জামানের প্লাটুন জগন্নাথদিঘি এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়ে ১৯ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করে। ৩০শে জুলাই সকাল ৭টায় ইমাম-উজ-জামানের একটি প্লাটুন জগন্নাথদিঘির কাছে হানাদার বাহিনীর একটি টহল জিপ এম্বুশ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগানের গুলিতে জিপের ড্রাইভার আহত হয়। ৬ জন পাকিস্তানি সৈন্য জিপ থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ে, কিন্তু তারা মুক্তিযোদ্ধা এম্বুশ দলের গুলিতে নিহত হয়। একজন মৃত পাকিস্তানি সৈন্যের পকেট থেকে একটি চিঠির মাধ্যমে জানা যায় নিহত পাকিস্তানি সৈন্যরা ২৯ বালুচ রেজিমেন্টের ‘চার্লি’ কোম্পানির সদস্য। এ-সময় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে একজন পাকিস্তানি সৈন্য বন্দি এবং অনেকগুলো অস্ত্র তাঁদের হস্তগত হয়। এ খবর পেয়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে আরো পাকিস্তানি সৈন্য ঘটনাস্থলে আসে এবং সারারাত মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ করে মর্টার ও কামানের গোলা নিক্ষেপ করে।
৩১শে জুলাই সকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি কোম্পানি চৌদ্দগ্রাম থেকে এবং আরেকটি কোম্পানি জগন্নাথদিঘি থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের দুশ গজের মধ্যে পৌঁছায়। ঠিক তখনই মুক্তিযোদ্ধাদের এম্বুশ থেকে তাদের ওপর অতর্কিতে গুলি চালানো হয়। এতে ২৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়।
২০শে সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গেরিলা দল চট্টগ্রাম-কুমিল্লার রাস্তায় জগন্নাথদিঘির কাছে বাজানকরা সেতুটি উড়িয়ে দিয়ে সেতু থেকে খানিকটা উত্তরে ১০ জন গেরিলা ও নিয়মিত বাহিনীর সদস্য পাকিস্তানি সৈন্যদের অপেক্ষায় এম্বুশ করেন। সেতুটি ধ্বংসের সংবাদ পেয়ে ফেনী থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি শক্তিশালী দল সেতুর দিকে অগ্রসর হয়। সেতুতে পৌঁছার আগেই পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের এম্বুশে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। এতে হানাদার বাহিনীর একজন অফিসারসহ ২৫ জন সৈন্য নিহত হয়। এরপর পাকিস্তানি সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে ফেনীর দিকে পালিয়ে যায়।
১১ই নভেম্বর রাত ১২টার দিকে জগন্নাথদিঘি এলাকার বেতিয়ারা নামক স্থানে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর একটি দলের সঙ্গে হানাদার বাহিনীর যুদ্ধে গেরিলা বাহিনীর ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন (দেখুন বেতিয়ারা যুদ্ধ)। এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পরপরই মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে জগন্নাথদিঘির দক্ষিণপাড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন জং-এর ঘাটিতে দূরপাল্লার বোমা বর্ষণ শুরু করে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়। ২৭শে নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে শেষ রাতে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন জং তার জীবিত ও মৃত সৈন্যদের নিয়ে ফেনীর দিকে পালিয়ে যায়।
২৮শে নভেম্বর সকাল ১০টায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জগন্নাথদিঘি ডাকবাংলো ক্যাম্প দখল করেন এবং জগন্নাথদিঘি এলাকা হানাদারমুক্ত ঘোষণা করেন। এর প্রাক্কালে সমবেত জনতার উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন চৌদ্দগ্রাম এলাকার এমপিএ ও ডিমাতলী ক্যাম্পের সভাপতি মীর হোসেন চৌধুরী ও মুক্তিযোদ্ধা জসীম উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন জং-এর কার্যালয় ও ইপিআর ক্যাম্পে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। [মোতাহার হোসেন মাহবুব]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড