You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.20 | ছাতিয়ানবাড়ি গণহত্যা (রাজৈর, মাদারীপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

ছাতিয়ানবাড়ি গণহত্যা (রাজৈর, মাদারীপুর)

ছাতিয়ানবাড়ি গণহত্যা (রাজৈর, মাদারীপুর) সংঘটিত হয় ২০শে মে। এতে মাদারীপুর জেলার রাজৈর থানার খালিয়া ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত ছাতিয়ানবাড়ি, উল্লাপাড়া, পলিতা, সেনদিয়া ও খালিয়া গ্রামের অনেক মানুষ নিহত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। তারা বহু বাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং অনেক নারীকে ধর্ষণ করে। পাকসেনা ও রাজাকাররা এসব গ্রামে নির্বিচারে লুণ্ঠনও চালায়।
ঘটনার দিন সকালে টেকেরহাট থেকে লঞ্চবোঝাই করে -রাজাকার- ও পাকিস্তানি সেনারা এসব গ্রামে আসে। তারা প্রথমে গোপালগঞ্জের ভেন্নাবাড়ি গ্রামের নদীর ঘাটে লঞ্চ থেকে নামে। ভেন্নাবাড়ি থেকে হেঁটে পাকসেনা ও রাজাকাররা রথবাড়ি, কদমবাড়ি ও ফুলবাড়ি গ্রামে গিয়ে অনেক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পরে ফুলবাড়ি গ্রামের উত্তর পাশের গজারিয়া ও মহিষমারী গ্রাম হয়ে ছাতিয়ানবাড়ি গ্রামে যায়। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে কিছুক্ষণ অবস্থান করে। স্কুলের সামান্য দূরে ছিল একটি আখক্ষেত। পাকবাহিনীর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য অনেকে আখক্ষেতে আগে থেকেই গর্ত খুঁড়ে রেখেছিল। সকালে প্রচণ্ড গুলির শব্দ শুনে গ্রামবাসী দৌড়ে আখক্ষেতে আশ্রয় নেয়। স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার মনি হাওলাদার আখক্ষেতের মধ্যে লোকজন লুকিয়ে আছে আঁচ করতে পেরে পাকিস্তানি সেনাদের ডেকে আনে। পাকিস্তানি সেনাদের এগিয়ে আসতে দেখে ভয়ার্ত নারী-পুরুষদের অনেকে কান্নাকাটি শুরু করে। এসব মানুষকে লক্ষ করে হানাদারদের মেশিনগান ও অটোমেটিক চাইনিজ রাইফেল গর্জে ওঠে। বেপরোয়া ব্রাশ ফায়ারে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায় অসংখ্য নারী, শিশু ও বৃদ্ধের শরীর। আখক্ষেতের গর্তের মধ্যে যারা লুকিয়ে ছিল, তাদের অনেককে গর্তের মধ্যেই গুলি করে, কাউকে চুল ধরে টেনে বের করে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করা হয়। প্রাণভয়ে যারা আখক্ষেতের পশ্চিমে জলাভূমির ধানক্ষেতে দৌড়ে পালাচ্ছিল, তাদের গুলি করে হত্যা করে। অধন্য বারিকদারের মেয়ে আয়নামতি ও ধন্য বারিকদারের ছেলে যতিনকে দৌড়ে পালানোর সময় পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে।
সেদিন হানাদার পাকসেনা ও তাদের সহযোগী রাজাকাররা ছাতিয়ানবাড়ি গ্রামে যাদের হত্যা করে, তাদের মধ্যে ৫১ জনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন- লেমু মল্লিক (স্বামী রতিকান্ত মল্লিক), মালতী মল্লিক (পিতা রতিকান্ত মল্লিক), সুমী মল্লিক (পিতা রতিকান্ত মল্লিক), পাঁচি মল্লিক (স্বামী যতীশ মল্লিক), বিরাট মল্লিক (পিতা যতীশ মল্লিক), সাধু মল্লিক (পিতা অভিশাপ মল্লিক), কুরি মল্লিক (পিতা অভিশাপ মল্লিক), কুটী মল্লিক (স্বামী বন্টা মল্লিক), অনি মল্লিক (স্বামী কেশব মল্লিক), স্বরসতী মল্লিক (পিতা সারদা মল্লিক), মধুমালা মল্লিক (স্বামী ললিত মল্লিক), ভুবন মল্লিক (পিতা দ্বারিক মল্লিক), ক্ষ্যান্ত মল্লিক (পিতা মতি মল্লিক), সূর্যকান্ত মল্লিক (পিতা কাশীশ্বর মল্লিক), কুটিবুড়ি মল্লিক (স্বামী কাশীশ্বর মল্লিক), সুধা কীর্তনীয়া (স্বামী ছত্রধর কীর্তনীয়া), রাজু বাড়ৈ (পিতা কালু বাড়ৈ), পুলিন বাড়ৈ (পিতা বাশিনাথ বাড়ৈ), অনন্ত বাড়ৈ (স্বামী বাশিনাথ বাড়ৈ), মঙ্গল বাড়ৈ (পিতা বাশিনাথ বাড়ৈ), কুটি রানী বাড়ৈ (স্বামী দেবনাথ বাড়ৈ), দশরথ বাড়ৈ (পিতা পঞ্চ বাড়ৈ), রামচন্দ্র বাড়ৈ (পিতা গদাধর বাড়ৈ), পাগলী বাড়ৈ (স্বামী রসিক বাড়ৈ), মাখন বাড়ৈ (পিতা রাজকুমার বাড়ৈ), মনিমালা বাড়ৈ (স্বামী রাজকুমার বাড়ৈ), সৌদা বাড়ৈ (পিতা মাখন বাড়ৈ), রসিক বাড়ৈ (পিতা নগরবাসী বাড়ৈ), সুমতি বৈদ্য (স্বামী ধর্ম নারায়ণ বৈদ্য), জৈলাশী গোলদার (স্বামী কোহা গোলদার), কোকারাম গোলদার (পিতা রামচন্দ্র গোলদার), সুরেন বৈরাগী (পিতা শীতল বৈরাগী), চিত্র বৈরাগী (পিতা সুরেন বৈরাগী), কমলা মল্ল (পিতা পূর্ণ মল্ল), জগদীশ বারুরী (পিতা রাজবিহারী বারুরী), গোপাল বারুরী (পিতা গৌর বারুরী), ঐমুনা বারুরী (স্বামী প্রতাপ বারুরী), যামিনী বারুরী (স্বামী নরেন্দ্রনাথ বারুরী), মৃত্যুঞ্জয় রায় (পিতা বিশেশ্বর রায়), রাজ্যেশ্বর রায় (পিতা বাবুরাম রায়), মইফুল রায় (স্বামী রাজ্যেশ্বর রায়), জগবন্ধু বালা (পিতা পার্শ্বনাথ বালা), পাচু বালা (পিতা জগবন্ধু বালা), রঞ্জন বালা (পিতা দ্বিজেন বালা), ফুলমালা বালা (স্বামী দ্বিজেন বালা), ভ্রান্ত বেপারী (স্বামী সুরেন বেপারী), পরিমল বেপারী (পিতা সুরেন বেপারী), আনন্দ বেপারী (পিতা সুরেন বেপারী), নারায়ণ বেপারী (পিতা সুরেন বেপারী), আয়নামতি (পিতা অদন্য বারিকদার) ও যতিন বারিকদার (পিতা ধন্য বারিকদার)। [শেখ নাছিমা রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড