You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.08 | ছিলোনীয়া যুদ্ধ (সেনবাগ, নোয়াখালী) - সংগ্রামের নোটবুক

ছিলোনীয়া যুদ্ধ (সেনবাগ, নোয়াখালী)

ছিলোনীয়া যুদ্ধ (সেনবাগ, নোয়াখালী) সংঘটিত হয় ৮ই অক্টোবর। নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলায় যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ছিলোনীয়া যুদ্ধ সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। এ-যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যাও সর্বাধিক।
ঘটনার দিন ভোরবেলা সেনবাগ উপজেলা সদরে অবস্থিত মিলিশিয়া ক্যাম্প থেকে রাজাকার ও মিলিশিয়া বাহিনীর ৭০-৮০ জন সদস্য ছিলোনীয়ায় অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প আক্রমণ করে। এ সময় ছিলোনীয়া বাজারের পার্শ্ববর্তী মানিকপুর, ইদিলপুর, নাজিরনগর, গোরকাটা, অম্বরনগর, বাতাকান্দি ও দড়ি গোরকাটা গ্রামে শতশত মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছিলেন। পোদ্দারপুকুর যুদ্ধের শেষে মুক্তিযোদ্ধারা অধিকতর নিরাপত্তার জন্য মইজদীপুর গ্রাম থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে ছিলোনীয়া বাজারের চারদিকে আশ্রয় নেন। বাজারের অতি সন্নিকটে একটি হিন্দু বাড়িতে আবদুল খালেক কমান্ডারের গ্রুপ অবস্থান করছিল পাকিস্তানি দালালদের দেয়া তথ্য মোতাবেক মিলিশিয়া ও রাজাকার বাহিনী আকস্মিকভাবে আবদুল খালেকের এ ক্যাম্প আক্রমণ করে। তারা কোনো প্রকার আওয়াজ না করে ক্যাম্পের দুজন সেন্ট্রিকে ঝাপটে ধরে। তাদের ধস্তাধস্তির শব্দ শুনে ক্যাম্পে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন এবং কেউ অস্ত্র নিয়ে কেউ-বা অস্ত্র ছাড়াই ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যান। যাঁদের কাছে অস্ত্র ছিল তাঁরা ফাঁকা গুলি করতে থাকেন। এই গুলির শব্দ পেয়ে উত্তর মানিকপুর থেকে মুক্তিযোদ্ধা তিতা মিয়া ফায়ার করতে-করতে ছিলোনীয়ার দিকে অগ্রসর হন। এদিকে সেন্ট্রিদুজন কৌশলে রাজাকারদের হাত থেকে ছুটে যান এবং তাঁদের একজন মমিনুল হক নিকটস্থ পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
ছিলোনীয়া বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রান্ত হওয়ার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা দলে-দলে এদিকে আসতে থাকেন। কেশারপাড় থেকে ফারুক ভূঞার (বিএলএফ- থানা কমান্ডার) দল, মতইন গ্রাম থেকে শৈলন্দ্র কুমার অধিকারীর দল, পশ্চিম দিক থেকে মনিরুজ্জামান মন্টু মিয়ার দল, গাজিরহাট এলাকা থেকে ভিপি জয়নাল, নবী ও জাহাঙ্গীরের দল এবং আরো কয়েকটি দল ছিলোনীয়া অভিমুখে রওনা হয়। শৈলেন্দ্র অধিকারী, গোলাম মোস্তফা লিটু, আবদুল ওহাব কমান্ডার, আবুল কালাম কমান্ডার (চেয়ারম্যান), হাজী ইদ্রিস ও রফিক বাতাকান্দি দিঘির পাড় থেকে গোলাগুলি শুরু করেন। পশ্চিম দিক থেকে মনিরুজ্জামান মন্টুর দল, উত্তর দিক থেকে ফারুক ভূঞার দল, তিতা মিয়া ও তাঁর সঙ্গী এবং দক্ষিণ দিক থেকে আবদুল খালেক কমান্ডারের মুক্তিযোদ্ধারা মিলিশিয়া বাহিনীকে আক্রমণ করেন। এতে ১০-১২ জন মিলিশিয়া নিহত হওয়ায় বাকিরা নিহতদের লাশ নিয়ে সেনবাগের দিকে পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে হাজী ইদ্রিস নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা হাতে গুলি লেগে আহত হন।
মিলিশিয়া বাহিনীর পরাজয়ের পর এদিনই বিকেলে পাকবাহিনী ছিলোনীয়া অভিমুখে অগ্রসর হয়। পথে বাতাকান্দি গ্রামের যেসব বাড়ির লোকজন মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন, সেসব বাড়িতে তারা আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে ইসমাইল মিয়ার (প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান) বাড়িতে ও মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিনের বাড়িতে ১৮টি পরিবারের ৩০- ৪০টি ঘর ভস্মীভূত হয়ে যায়। এ-সময় পাকবাহিনীর গুলিতে আজিজ উল্যা, সিরাজ মিয়া, আবদুর রব, আবদুল কাশেম ওরফে কাসিম আলী, লাল মিয়া ও শাহ আলম শহীদ হন। এদিকে পাকবাহিনীর আগমনের খবর শুনে শতশত মুক্তিযোদ্ধা ছিলোনীয়া থেকে বাতাকান্দির দিকে অগ্রসর হলে পাকবাহিনী দ্রুত সেনবাগের দিকে পালিয়ে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তির কথা জানতে পেরে সেদিনই তারা সেনবাগ ত্যাগ করে দাগনভূঞার আতাতুর্ক হাইস্কুলে ঘাঁটি স্থাপন করে। তবে সেনবাগ রাস্তার মাথায় রাজাকারদের একটি শক্ত ঘাঁটি তখনো ছিল। ১৯শে নভেম্বর রাতে জোনাল কমান্ডার রুহুল আমিন ভূঞার নেতৃত্বে এ ঘাঁটিটি আক্রমণ করা হয়।
ছিলোনীয়া যুদ্ধে সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, হাতিয়া ও ফেনীর মুক্তিযোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও একজন নিখোঁজ হন এবং ১৫-২০ জন পাকিস্তানি সৈন্য, মিলিশিয়া ও রাজাকার নিহত হয়। [মুহম্মদ আবু তাহের]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড