You dont have javascript enabled! Please enable it! ছনপাড়া-বাগহাটা কালভার্ট অপারেশন (নরসিংদী সদর) - সংগ্রামের নোটবুক

ছনপাড়া-বাগহাটা কালভার্ট অপারেশন (নরসিংদী সদর)

ছনপাড়া-বাগহাটা কালভার্ট অপারেশন (নরসিংদী সদর) পরিচালিত হয় আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে।
পাঁচদোনা ব্রিজে সংঘটিত যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সফলতা লাভ করা সম্ভব হয়নি। এর অন্যতম কারণ ছিল ঢাকা ও নরসিংদী উভয় দিক থেকে সহজ সড়ক যোগাযোগ। এ কারণে পাঁচদোনা ব্রিজে পাকবাহিনী আক্রান্ত হওয়ামাত্র তারা ওয়ারলেসের মাধ্যমে তাদের নরসিংদী হেডকোয়ার্টার্সে এবং পুরিন্দা ক্যাম্পে খবর পৌছে দিতে পারত। ফলে অতি সহজে তাদের সাহায্যার্থে ঐসব ক্যাম্প থেকে ট্রাকযোগে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাকসেনারা ঘটানস্থলে চলে আসত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ প্রতিহত করত।
পাঁচদোনা ব্রিজটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। তাই এ স্থানটিকে কীভাবে নিজেদের আয়ত্তে রাখা যায়, সে ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধারা ভাবতে থাকেন। অবশেষে ইউনিট কমান্ডার ন্যাভাল সিরাজ- ও কমান্ডার ইমাম উদ্দিন আলোচনা করে দুপার্শ্বের দুটি কালভার্ট ভেঙ্গে ফেলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কালভার্ট ভেঙ্গে ব্রিজে আক্রমণ করা হলে দুদিক থেকে পাকসেনারা আর আসতে পারবে না। ফলে পাঁচদোনা ব্রিজ সহজে দখল করা যাবে বিধায় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
পাঁচদোনা ব্রিজ থেকে ঢাকার দিকের কালভার্টটি ছিল ছনপাড়ায় এবং নরসিংদীর দিকের কালভার্টটি ছিল বাগহাটা মসজিদের উত্তর পার্শ্বে। কিন্তু সমস্যা ছিল এক্সপ্লোসিভের। কালভার্টদুটি ভাঙ্গার জন্য যে পরিমাণ এক্সপ্রোসিভের প্রয়োজন, তা তাদের ছিল না। তথাপি তারা দমলেন না। সিদ্ধান্ত হলো এ অপারেশনের দায়িত্ব পালন করবেন কমান্ডার ইমাম উদ্দিন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরেরদিন কালভার্টদুটি রেকি করা হয়। কী কৌশল অবলম্বন করলে কম এক্সপ্লোসিভ দিয়ে কালভার্টদুটি ধ্বংস করা যায় তা নিরীক্ষণ করা হয়। প্রথমে দুদিনে দুটি কালভার্ট ভাঙ্গার চিন্তা-ভাবনা করা হলেও পরে একই দিনে অপারেশনের পরিকল্পনা নেয়া হয়। কারণ একদিনে একটি কালভার্ট ভাঙ্গা হলে পরের দিন অন্যটিতে আর্মিরা পাহারা বসাতে পারে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি গ্রুপ তৈরি করা হয়। বাগহাটার কালভার্ট অপারেশনের জন্য ডেমোলিশন পার্টির ইব্রাহিমকে প্রধান দায়িত্ব দিয়ে তাঁর সঙ্গে সহযোগী হিসেবে তুলসীপুরের জামাল, নেহাবের শফি ও কালাম, বৈলানের রশিদ, আমজাদ এবং নলুয়ার নুরুল ইসলামকে পাঠানো হয়। এঁদের মধ্যে নুরুল ইসলাম ও রশিদকে রাইফেলসহ পেট্রোল পাম্পের কাছাকাছি জায়গায় এম্বুশ করে হানাদার বাহিনীর কোনো গাড়ি নরসিংদীর দিক থেকে আসলে তা প্রতিহত করার জন্য এবং অন্যদেরকে কালভার্ট অপারেশনের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। অপরদিকে ছনপাড়া কালভার্ট অপারেশনের দায়িত্ব কমান্ডার ইমাম উদ্দিন নিজেই পালন করেন। তাঁর সঙ্গে সহায়তাকারী হিসেবে ছিলেন বেলাবর তোরাব, কান্দাইলের শাজাহান, মাথরার সুলতান, নেহাব গ্রামের সাহাজ উদ্দিন, পুটিয়ার কবির, পাকুরিয়ার লতিফ ও সিরাজ। এঁদের মধ্যে শাজাহান, সাহাজ উদ্দিন, কবির ও সিরাজকে কালভার্ট থেকে কিছুটা পশ্চিম দিকে এম্বুশে রাখা হয় যাতে পুরিন্দা থেকে হানাদারের কোনো গাড়ি এলে সেটিকে বাঁধা দেয়া এবং নির্বিঘ্নে অপারেশন শেষ করা যায়।
কমান্ডার ইমাম উদ্দিন সিদ্ধান্ত দেন যে, দুটি অপারেশনই রাত তিনটায় সংঘটিত হবে। এজন্য আগে থেকেই নিজ-নিজ টিমকে অপারেশন স্থলের কাছাকাছি কোনো জায়গায় গিয়ে অবস্থান করতে হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঘটনার দিন রাত নয়টায় উভয় দল নিজ-নিজ গন্তব্যে চলে যায়। ইব্রাহিমের দল শীলমান্দি বিলের কাছাকাছি একটি বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। অন্যদিকে ইমাম উদ্দিন রাত দশটায় কান্দাইলের শওকতদের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। যথাসময়ে উভয় দলই নিজ-নিজ অপারেশন স্থলে পৌঁছে যায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী অতি অল্প সময়ের মধ্যে এক্সপ্লোসিভ লাগানোর কাজ শেষ করে কালভার্ট থেকে নিরাপদ দূরত্বে প্রাইমা কডের সুইসের গোড়ায় গিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সকলে অপেক্ষা করতে থাকেন। এরপর কমান্ডার ইমাম রাত তিনটায় সুইচ অন করার নির্দেশ দেন। সঙ্গে-সঙ্গে তোরাব তা করেন। দ্রিম- দ্রিম শব্দে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে যায়। ছনপাড়ার শব্দের পরপরই বাগহাটার আপারেশনের আওয়াজও শোনা যায়। বিস্ফোরণে ছনপাড়ার কালভার্টটি সম্পূর্ণ ভেঙ্গে গেলেও বাগহাটার কালভার্টটি পুরোপুরি ভাঙ্গেনি আংশিক ভেঙ্গেছিল। কালভার্ট দুটি ভেঙ্গে যাওয়ায় পাকসেনাদের যাতায়াত ভীষণভাবে বিঘ্নিত হয়। [মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন] ছনহারা গণহত্যা (পটিয়া, চট্টগ্রাম) সংঘটিত হয় ১৭ই মে। এতে ৯ জন নিরীহ গ্রামবাসী প্রাণ হারান। সেদিন -রাজাকার- ও পাকিস্তানি হানাদাররা গ্রামে নারীনির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে।
১৭ই মে ভোরে পটিয়া পিটিআই পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে একদল পাকিস্তানি সেনা স্থানীয় দোসরদের সঙ্গে নিয়ে ছনহারা গ্রাম আক্রমণ করে। তারা আক্রমণের শুরুতেই গুলি করে ৩ জন লোককে হত্যা করে। এ-সময় ৪ জন লোক গুরুতর আহত হন। আক্রান্ত হওয়ার পর প্রায় ২ শত লোক গ্রামের সন্নিকটস্থ খালের ধারে বিভিন্ন ঝোপে আশ্রয় নেয়। তাদের মধ্যে ছিলেন পটিয়া হাইস্কুলের শিক্ষক বনিক চন্দ্ৰ। তিনি একটি ঝোপে একটি ব্যাগ নিয়ে লুকিয়েছিলেন। ব্যাগে কিছু টাকা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু জিনিস ছিল। রাজাকাররা তাঁকে ধরে ফেলে এবং ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। তারা তাঁকে হত্যা করতে উদ্ধত হলে নিকটস্থ জালিয়াপাড়ার কিছু বয়স্ক লোক তাঁকে উদ্ধার করেন। বনিক চন্দ্র আবারো ঐ ঝোপে আশ্রয় নেন। এদিকে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা ছনহারা, চাটারা, গুয়াতলি, মঠপাড়া ও ধাউরডেঙ্গা গ্রামের প্রায় সকল বাড়িঘর লুণ্ঠন শেষে পুড়িয়ে দেয়। এ-সময় তারা ধাউরডেঙ্গা গ্রামের হিন্দুবাড়ির ৩ জনকে গুলি করে হত্যা করে। এসব গ্রামের অনেক নারীর ওপর তারা পাশবিক নির্যাতন চালায়। দুপুরের পর তারা ছনহারা গ্রামের বিভিন্ন ঝোপে লুকিয়ে থাকা লোকজনকে ধরে একটি জায়গায় জড়ো করে। তাদের মধ্য থেকে ৩ জনকে তারা হত্যা করে। পটিয়া পিটিআই পাকিস্তানি ক্যাম্পে যাওয়ার সময় তারা আরো ৩ জনকে গুলি করে হত্যা করে। এ গণহত্যায় নিহত মোট ৯ জনের মধ্যে ৩ জনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন- সারদাচরণ দে, গৌরাঙ্গ মল্লিক ও যোগেন্দ্রলাল মল্লিক। [শামসুল আরেফীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড