ছয়পুকুরিয়া গণহত্যা (ফুলবাড়ী, দিনাজপুর)
ছয়পুকুরিয়া গণহত্যা (ফুলবাড়ী, দিনাজপুর) ঘটে মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে। দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার ছয়পুকুরিয়া (বাড়াইহাট বাজারের এক কিলোমিটার দক্ষিণে) গ্রামে শান্তি কমিটির সদস্য কেনান সরকার, কয়েকজন বিহারি ও পার্বতীপুরের বাচ্চু খানের লোকদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী এ গণহত্যা ঘটায়। এতে শতাধিক হিন্দু গ্রামবাসী শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর শান্তি কমিটি ও রাজাকার- বাহিনীর সহযোগিতায় গ্রামে-গ্রামে পাকবাহিনীর অত্যাচার বাড়তে থাকে। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চলে। হিন্দুরা দলে-দলে বাড়িঘর ছেড়ে পার্শ্ববর্তী ভারতে চলে যেতে থাকে। ফুলবাড়ী উপজেলার পূর্বপার্শ্বস্থ আফতাবগঞ্জ উপজেলা সংলগ্ন নবাবগঞ্জ উপজেলার আলদাদপুর মৌজার প্রামাণিক পাড়া, বটপাড়া, পূর্বপাড়া, উত্তর শাহজাদপুরের নাপিতপাড়া এবং পার্বতীপুর উপজেলার মন্মথপুরের হিন্দুরা ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে বা গরুর গাড়িতে করে এদিকে আসতে থাকে। ঘটনার একদিন আগে প্রামাণিক পাড়ার একদল হিন্দু নারী-পুরুষ ও শিশু ফুলবাড়ী উপজেলার রামভদ্রপুর গ্রামের কেনান সরকারের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কেনান সরকার তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছিল। পরদিন উপর্যুক্ত পাড়াগুলো থেকে আরো অনেকে আসার পর সকলে একসঙ্গে চলা শুরু করে। এদিকে কেনান সরকার ফুলবাড়ীস্থ পাকসেনা ক্যাম্পে খবর দিলে তারা এসে বাড়াইহাট এলাকায় সকলকে আটকে দেয়। পূর্ব-পশ্চিম দিনাজপুর ও ফুলবাড়ী হেরিংবোম রাস্তাকে ক্রস করেছে উত্তর-দক্ষিণমুখি একটি কাঁচা রাস্তা। এ রাস্তা ধরেই ভারতে যেতে হয়। পায়ে হাঁটা লোকজনদের প্রায় সকলে রাস্তাটি পার হয়ে গিয়েছিল। গরুর গাড়িগুলি পার হতে পারেনি। এ-সময় পাকসেনারা সকলকে নিরাপদে পার করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের থামতে বলে। কিন্তু তাদের বিশ্বাস না করে শরণার্থীরা দক্ষিণ দিকে দৌড়াতে থাকে। বৃদ্ধ ও মালপত্র বহনকারীরা দৌড়াতে পারেনি। এমতাবস্থায় পাকসেনারা ছয়পুকুরিয়া গ্রামের একটি পুকুরের কাছে সকলকে আটকে দেয়৷
পাকসেনারা প্রথমে সকলের মালপত্র, বিশেষ করে সোনাদানা ও টাকা-পয়সা কেড়ে নেয়। তারপর রাস্তার দুধারে সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে তাদেরই আনা চিড়া-মুড়ি খেতে দেয়। অতঃপর বড়দের এক লাইনে, ছোটদের এক লাইনে এবং মেয়েদের এক লাইনে মুখোমুখি দাঁড় করায়। আট থেকে দশ জন যুবতি নারীকে আলাদা করে (তাদের একজন প্রামাণিক পাড়ায় এখনো বেঁচে আছেন)। এরপর প্রতিটি লাইনের পেছন থেকে ব্রাশ ফায়ার করে। গুলিতে যারা মারা যায়নি, তাদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। শিশুসহ কয়েকজন আহত অবস্থায় বেঁচে যায়। এ-ঘটনার দু-তিন ঘণ্টা পর স্থানীয় কিছু লোক দেশত্যাগের উদ্দেশ্যে সেখানে এলে আহতরা তাদের সঙ্গে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যায়। সেদিন যারা বেঁচে গিয়েছিলেন, তাদের কয়েকজন হলেন— প্রদীপ চন্দ্ৰ প্রামাণিক (বেয়নেটের খোঁচায় আহত হয়, বুকের নিচে ও পিঠে এখনো দাগ রয়েছে), প্রফুল্ল চন্দ্র, রাধারাণী প্রমুখ। প্রদীপ প্রামাণিকের মা কুলোবালা, ভাই অনুকূল চন্দ্ৰ, পিতামহী মায়ারাণীসহ তাদের বাড়ির পাঁচজন শহীদ হন। প্রদীপ প্রামাণিক ভারতে গিয়ে বালুরঘাট হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হন। সেদিন শরণার্থীদের সংখ্যা ছিল শিশু-নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ মিলিয়ে প্রায় দেড়শ। তাদের মধ্যে একশ পঁচিশ জনেরও অধিক প্রাণ হারায়। কিন্তু সকলের পরিচয় পাওয়া যায়নি। এ গণহত্যার সবচেয়ে মর্মস্পর্শী ও পৈশাচিক বিষয় হলো, ছোট-ছোট শিশুদের দু-পা ধরে মাথার ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে ছুড়ে মারা হয়।
স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন এই পুকুরপাড়ে শহীদদের হাড়গোর পড়ে থাকতে দেখা যায়। এটি গণহত্যার একটি স্থান হিসেবে স্বীকৃত হলেও আজ পর্যন্ত এখানে কোনো স্মৃতিচিহ্ন স্থাপন করা হয়নি। বরং পুকুরের উঁচু পাড় কেটে সমান করে আবাদি জমি তৈরি করা হয়েছে। কালের সাক্ষী হয়ে শুধু জলাভূমিটুকুই পড়ে আছে। [আব্দুল জলিল আহমেদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড