You dont have javascript enabled! Please enable it!

ছাতক যুদ্ধ (ছাতক, সুনামগঞ্জ)

ছাতক যুদ্ধ (ছাতক, সুনামগঞ্জ) সংঘটিত হয় ১৩-১৭ই অক্টোবর। এতে ২ শতাধিক পাকসেনা নিহত ও সমপরিমাণ আহত হয়। অপরদিকে ৭০-৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও শতাধিক আহত হন।
মুক্তিযুদ্ধে ৫ নম্বর সেক্টরের অধীনে সেলা সাব-সেক্টরে যে- কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তন্মধ্যে ছাতক যুদ্ধ অন্যতম। ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে পাকবাহিনী শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করে। সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ও শহর এলাকায় ছিল ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সেনা। তাছাড়া এদের সঙ্গে ছিল ১২ একেএফ (আজাদ-কাশ্মীর ফোর্স), ইপিসিএএফ (ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স) এবং রাজাকার বাহিনীর দুই কোম্পানির সমান জনবল। ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ঘিরে টিলাগুলোর ওপর পাকসেনারা আরসিসি ঢালাই করা বাংকার তৈরির মাধ্যমে অবস্থান নেয়। অক্টোবর মাসের পূর্বেই বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠিত হলেও মুক্তাঞ্চলে কোনো বিমান ঘাঁটি মুক্তিবাহিনীর দখলে ছিল না। মূলত ছাতককে মুক্ত করে পরবর্তীতে সালুটিকর বিমান বন্দরটি দখলে নেয়ার উদ্দেশ্যে এবং আন্তর্জাতিকভাবে ইফেক্ট সৃষ্টি করার জন্য অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানিগুলোকে ছাতক আক্রমণ করার নির্দেশ দেয়া হয়। তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘এ’ কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন, ‘বি’ কোম্পানির ক্যাপ্টেন আকবর হোসেন, ‘সি’ কোম্পানির ক্যাপ্টেন মোহসিন উদ্দিন আহমেদ, ‘ডি’ কোম্পানির লেফটেন্যান্ট এস আই এম নূরুন্নবী খান এবং ‘ই’ কোম্পানির লেফটেন্যান্ট মনজুর আহমেদ। এ রেজিমেন্টের 5 অধিনায়ক ছিলেন মেজর শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রম। ১১ই অক্টোবর তৃতীয় বেঙ্গল তাদের বিশাল কনভয় নিয়ে সেলা সাব-সেক্টরে এসে বাঁশতলা ক্যাম্পে অবস্থান গ্রহণ করে। ৫ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর মীর শওকত আলী মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন এ এস হেলাল উদ্দিনকে তৃতীয় বেঙ্গলের সঙ্গে মিলিত হয়ে ছাতক আক্রমণের নির্দেশ দেন। সেক্টর কমান্ডার ১০ই অক্টোবর থেকে বাঁশতলা ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে ছাতকে পাকবাহিনীর অবস্থান রেকি করান। তাঁর নির্দেশে ক্যাপ্টেন আনোয়ারের নেতৃত্বে ‘এ’ কোম্পানি ও মুক্তিবাহিনীর ‘ইয়াঙ্কি’ কোম্পানি ইদ্রিস আলীর নেতৃত্বে বালিউড়া বাজারে এবং ক্যাপ্টেন আকবরের নেতৃত্বে ‘বি’ কোম্পানি ও মুক্তিবাহিনীর সুবেদার খুরশেদের নেতৃত্বে ‘গল্ফ’ কোম্পানি জয়নগর টিলায় অবস্থান নেয়। ‘সি’ কোম্পানির ক্যাপ্টেন মোহসিন উদ্দিন আহমেদকে দোয়ারাবাজারে এবং ‘ডি’ কোম্পানির লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবীকে ছাতক-সিলেট রোডের গোবিন্দগঞ্জ নামক স্থানে অবস্থান নিতে বলা হয়। অর্থাৎ সুনামগঞ্জ ও সিলেট থেকে যাতে পাকসেনারা ছাতক অভিমুখে অগ্রসর হতে না পারে সেজন্য ‘ডি’ কোম্পানিকে ‘কাট-অফ-পার্টি’ হিসেবে গোবিন্দগঞ্জে অবস্থান নিতে নির্দেশ দেয়া হয়। লেফটেন্যান্ট মনজুর আহমেদ ‘ই’ কোম্পানি নিয়ে কোম্পানিগঞ্জের বিপরীতে রাধানগরে অবস্থান নেন। এছাড়াও শহীদ চৌধুরীর ‘ফক্সটট’ কোম্পানি, উজির মিয়ার ‘পাইওনিয়ার’ কোম্পানি, শামসুদ্দিনের ‘পাপা’ কোম্পানি, আমিরুল ইসলামের ‘রোমিও’ কোম্পানি ও নূরুল হকের ‘জুলিয়েট’ কোম্পানি তাদের সুবিধামতো স্থানে অবস্থান নেয়। ক্যাপ্টেন আনোয়ার ও ক্যাপ্টেন আকবরের কোম্পানিকে ছাতক আক্রমণ করার দায়িত্ব দেয়া হয়।
১৩ই অক্টোবর রাতে ক্যাপ্টেন এ এস হেলাল, ক্যাপ্টেন আনোয়ার ও ক্যাপ্টেন আকবর তাঁদের কোম্পানিগুলো নিয়ে ছাতকে তীব্র আক্রমণ চালান। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকসেনারা ঐ রাতেই ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ক্যাম্প থেকে পালিয়ে গিয়ে সুরমা নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থান নেয়। এ সুযোগ মুক্তিযোদ্ধারা সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে স্থাপিত হানাদার ক্যাম্প দখল করে নেন এবং সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ক্যাপ্টেন আনোয়ার সিমেন্ট ফ্যাক্টরির ভেতরে শক্ত অবস্থান নেন। অপরদিকে ক্যাপ্টেন হেলাল তাঁর এফএফ কোম্পানি নিয়ে সিমেন্ট ফ্যাক্টরির চারপাশে সুদৃঢ় প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলেন। এদিকে ইদ্রিস আলীর নেতৃত্বে ‘ইয়াঙ্কি’ কোম্পানি ও ‘বি’ কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা সুরমা নদীর তীরে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে। সিলেট থেকে ছাতকের দিকে আসা পাকসেনা ও রাজাকার বহনকারী একটি লঞ্চ ইদ্রিস আলীর নেতৃত্বে ‘ইয়াঙ্কি’ কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা রকেট লাঞ্চার নিক্ষেপ করে ডুবিয়ে দেন। এতে ঐ লঞ্চে থাকা ৯ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। ১৪টি রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। অপরদিকে ক্যাপ্টেন মোহসিন রাতে তাঁর সৈন্যদের নিয়ে দোয়ারাবাজারে অবস্থান নিতে কয়েকটি নৌকাযোগে হাওড় পাড়ি দিচ্ছিলেন। ১৪ই অক্টোবর অতি প্রত্যুষে তিনি দোয়ারাবাজারের ৫০ গজের মধ্যে প্রবেশ করতেই অতর্কিতভাবে পাকসেনারা বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করতে থাকে। তাদের বিরামহীন গুলিবর্ষণে ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। ক্যাপ্টেন মোহসিন অবস্থা বেগতিক দেখে অন্যান্য সহযোদ্ধাসহ পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন৷ বিপর্যস্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাঁর কোম্পানি। অনেকে আহত অবস্থায় ক্যাম্পে ফিরে আসে। ক্যাপ্টেন মোহসিন দুদিন পর কিছু সৈন্যসহ বাঁশতলা ক্যাম্পে ফিরে আসেন। এদিকে গোবিন্দগঞ্জে পাকসেনাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবী তাঁর সৈন্য নিয়ে কোম্পানিগঞ্জের দিকে পিছু হটেন। ফলে পাকসেনাদের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও দোয়ারাবাজার থেকে ছাতকের দিকে অগ্রসর হতে কোনো বাধা থাকেনি।
ক্যাপ্টেন হেলাল ও ক্যাপ্টেন আনোয়ারের কোম্পানিগুলোর ওপর পাকসেনারা গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে অনবরত শেলিং করতে থাকে। তাঁরা পেছনের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেন। তাছাড়া ক্যাপ্টেন মোহসিনের ‘সি’ কোম্পানি ও লেফটেন্যান্ট নূরন্নবীর ‘ডি’ কোম্পানির অবস্থান ত্যাগের বিষয়টি তাঁদের অজানা ছিল।
১৬ই অক্টোবর পাকবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ও ফ্রন্টিয়ার কনস্টেবলারি দোয়ারাবাজার থেকে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির উত্তর দিক দিয়ে গিয়ে পেছন দিক থেকে ছাতকে অবস্থানে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর প্রতিআক্রমণ করে। জয়নগরে অবস্থানে থাকা ক্যাপ্টেন আকবর বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তিনি রাতে বিল সাঁতরে সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে গিয়ে ক্যাপ্টেন আনোয়ারকে প্রকৃত অবস্থা অবগত করেন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে ক্যাপ্টেন আনোয়ার সারারাত বিলের মধ্য দিয়ে সাঁতরে তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে ১৭ই অক্টোবর ভোরে বালিউড়া এলাকায় পৌছাতে সক্ষম হন। ১৩-১৭ই অক্টোবর পর্যন্ত সংঘটিত ছাতক যুদ্ধে ২ শতাধিক পাকসেনা নিহত ও সমপরিমাণ আহত হয়। অপরদিকে ৭০-৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও শতাধিক আহত হন। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা ছাতক দখলে রাখতে না পারলেও তাঁদের এ আক্রমণ ছিল খুবই সাহসিকতাপূর্ণ। [শফিউদ্দিন তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!