You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে চৌগাছা উপজেলা (যশোর) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে চৌগাছা উপজেলা (যশোর)

চৌগাছা উপজেলা (যশোর) একটি সীমান্তবর্তী উপজেলা। ১৯৭৭ সালে কালীগঞ্জ উপজেলার ৩টি, মহেশপুর উপজেলার ৩টি ও ঝিকরগাছা উপজেলার ২টি ইউনিয়নকে ৫টি ইউনিয়নে বিভক্ত করে মোট ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে চৌগাছা থানা গঠিত হয়। পরে এ থানা উপজেলায় রূপান্তরিত হয়। এ উপজেলার পূর্বে যশোর সদর, দক্ষিণে ঝিকরগাছা, দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর-পশ্চিমে মহেশপুর, উত্তরে কোটচাদপুর এবং উত্তর- পূর্বে কালীগঞ্জ উপজেলা অবস্থিত। ১৯৭১ সালে চৌগাছার সীমান্তজুড়ে মাশিলা, হিজলী, আন্দুলিয়া ও বর্নি নামে ৪টি সীমান্ত ফাঁড়ি ছিল। মুক্তিযুদ্ধে এ অঞ্চল ৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) খন্দকার নাজমুল হুদা।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর থেকে চৌগাছা থানার বিভিন্ন ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ-এর নেতৃত্বে যুব সমাজ সংগঠিত হতে থাকে। উপজেলার জগদীশপুর গ্রামে মার্চ মাসের প্রথম থেকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মহড়া চলছিল। ২৯শে মার্চ ফুলসারা-পাশাপোল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান কবিরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মহড়ায় থাকা ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) হাফিজকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে না ফিরে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুরোধ করেন। তিনি ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান। ৩০শে মার্চ চুয়াডাঙ্গার ইপিআর (বর্তমান বিজিবি) হেডকোয়ার্টার্স থেকে সেনা কর্মকর্তা মেজর আবু ওসমানের নেতৃত্বে এক দল ইপিআর সদস্য সলুয়া বাজারে অবস্থান নিয়ে ক্যান্টনমেন্টকে লক্ষ্যে রেখে পাকসেনাদের প্রতিরোধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের অনেকে ভারতে মুক্তিযুদ্ধের লিয়াজোঁ অফিস স্থাপন, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ছাত্র-যুবকদের প্রেরণ, প্রশিক্ষণের আয়োজন এবং যুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। তাঁদের মধ্যে তবিবর রহমান সরদার এমপিএ, আওয়ামী লীগ নেতা মো. হাফিজুল্লাহ কানন, মহেশপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন মল্লিক, দপ্তর সম্পাদক দেবাশীষ দাস (ভারতের বাগদাহে অবস্থান নেন), চৌগাছা-সিংহঝুলি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ওয়ালিউল্লাহ (ভারতের কুরুলিয়ায় অবস্থান নেন) প্রমুখ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান মধু অর্থ সংগ্রহ ও জনসংযোগের দায়িত্ব পালন করেন। ইপিআর ও মুজাহিদ বাহিনীর অনেক বাঙালি সদস্য পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে আওয়ামী লীগ স্থাপিত লিয়াজোঁ অফিসে যোগাযোগের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
ভারতের বনগাঁয় ১নং টালীখোলা থেকে ৫নং টালীখোলা ও চাঁপাবাড়িয়া নামক স্থানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। কেউ-কেউ ভারতের বীরভূম জেলার চাকুলিয়ায় ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ নেন। পরে তাঁদের অনেককে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য উত্তরাখণ্ডের রাজধানী দেরাদুনের টান্ডুয়া, আসামের হাফলং প্রভৃতি ক্যাম্পে পাঠানো হয়। এসব ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন।
চৌগাছা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী মো. নুর বক্স (উজিরপুর), ফুলসারা পাশাপোল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মহাসীন আলী মিয়া (ফুলসারা) ও সাধারণ সম্পাদক মো. শাহজাহান কবির (ফুলসারা), মো. শামছুজ্জামান মিয়া (সিংহঝুলি), জগদীশপুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফ হোসেন আশা (বুদো ষ্টাটার), পাতিবিলা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা মো. সামসুল আলম (পুড়াহুদা), যাত্রাপুর-হাকিমপুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা নিতাই চন্দ্র সরকার (যাত্রাপুর), শার্শা থানার প্রফেসর আমিরুল আলম খান (শিববাস) প্রমুখ।
৩১শে মার্চ ইপিআর বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা স্বাধীনতাকামী জনতার সহযোগিতায় ইপিআর-এর পাকিস্তানি সদস্যদের হতাহত করে চৌগাছা সীমান্তের মাশিলা, হিজলী, আন্দুলিয়া ও বর্নি ইপিআর ক্যাম্প দখল করেন। এসব ক্যাম্পের বাঙালি সদস্যরা পাকিস্তানি ইপিআর সদস্যদের প্রতিরোধ করতে এবং ক্যাম্পগুলোতে নিজেদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় বিশেষ উদ্যোগ নেন। প্রাথমিক প্রতিরোধ চেষ্টায় মুক্তিযোদ্ধারা সফল হন। প্রাথমিকভাবে বাঙালিরা ইপিআর ক্যাম্পগুলো দখলে নিলেও শেষ পর্যন্ত চৌগাছার ওপর পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
২০শে এপ্রিল যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকবাহিনীর একটি দল ছোট সিংহঝুলি (বর্তমান মশিউর নগর) ও সিংহঝুলি গ্রামে গণহত্যা চালায়। সিংহঝুলি গণহত্যায় ১৩ জন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন। এছাড়া হানাদাররা ব্যাপক অগ্নিসংযোগ এবং পুরো এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে চৌগাছায় প্রবেশ করে। এদিন পাকবাহিনী চৌগাছায় একজন নিরীহ ব্যক্তিকে হত্যা এবং অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যায়। পাকিস্তানি হানাদাররা ২৬শে এপ্রিল পুনরায় চৌগাছায় প্রবেশ করে চৌগাছা শাহাদৎ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও জেলা পরিষদের ডাকবাংলোয় প্রধান ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিল মেজর আব্বাস উদ্দিন। এছাড়া এ ক্যাম্পের অধীনে মাশিলা, হিজলী, আন্দুলিয়া, বর্নি ইপিআর ক্যাম্প, দশপাকিয়ার দত্তের পুকুরপাড়, সাঞ্চাডাঙ্গার কচুবিলার মাঠ, হাকিমপুরের আমবাগান, আড়পাড়ার ভূমি অফিসসহ বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনী ও রাজাকার-রা ক্যাম্প ও ঘাঁটি স্থাপন করে।
চৌগাছায় স্বাধীনতাবিরোধী দল বা সংগঠন হিসেবে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং এসব সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দ্বারা গঠিত শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী সক্রিয় ছিল। এরা পাকবাহিনীকে সর্বপ্রকার সহযোগিতা করত।
উপজেলায় পাকবাহিনীর সহযোগীদের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। উপজেলার শীর্ষস্থানীয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের মধ্যে ছিল হাজী মো. মফেজ উদ্দিন (কয়ারপাড়া), হাজী মো. শাহাজান আলী মিয়া (পাতিবিলা), মো. আবুল হোসেন (মাধবপুর), মো. কাদের মৃধা (কংশারীপুর), মো. আবুল হোসেন, মো. ওয়াজেদ মিয়া (চাঁদপাড়া), মো. সোলাইমান হোসেন খান (হাকিমপুর), মো. দিয়ানত আলী খান (যাত্রাপুর), রবিউল ইসলাম (লস্কারপুর), মো. কাজেম আলী (সৈয়দপুর), মো. এ টি এম মুছা (রায়নগর), মো. আদর আলী (সিংহঝুলি), মো. তবিবর রহমান (সিংহঝুলি), আব্দুল গফুর খান (দক্ষিণ সাগর) প্রমুখ। ডাকবাংলোয় প্রতি রবিবার শান্তি কমিটির সদস্যদের সঙ্গে মিটিং করে পাকসেনারা যুদ্ধের ও নির্যাতনের নতুন- নতুন পরিকল্পনা করত।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মো. মশিউর রহমান এমএনএ-এর গ্রাম মনে করে ছোট সিংহঝুলি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। অগ্নিকাণ্ডে সাধারণ মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হয়। হানাদার বাহিনী গ্রামের অনেক নিরীহ মানুষকে নির্যাতন করে।
পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প স্থাপনের পর জেলা পরিষদের ডাকবাংলোর পেছনে স্থানীয় অসংখ্য মানুষকে জোরপূর্বক ধরে এনে নির্যাতন ও হত্যা করে। চৌগাছা ডাকবাংলো বধ্যভূমি-তে ২২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বিভিন্ন সময়ে হত্যা করা হয়। ইছাপুর গ্রামের বিডি (বেসিক ডেমোক্রেসি) মেম্বার মো. আক্কাচ আলী বিশ্বাসের ওপর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য পাকসেনারা চাপ সৃষ্টি ও চরম ভয়ভীতি দেখায়। এক পর্যায়ে তিনি বিষপানে আত্মহত্যা করেন। এ এলাকার অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে পাক হানাদাররা জীবিত কবর দেয়। মাঝে-মাঝে কংশারীপুর ও পাঁচনামনা গ্রাম থেকে গভীর রাতে নির্যাতিত মানুষের আর্তনাদ শোনা যেত।
৩১শে মে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা প্রদান ও ডিসপেনসারিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী রাখার দায়ে ডা. বজলুর রহমানকে বন্দি করে পাকসেনারা যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। এখান থেকে তারা আরো ৩ জনকে আটক করে। নির্যাতন শেষে ১৩ই জুন ডা. বজলুর রহমান ব্যতীত আটককৃত অন্য ৩ জনকে পাকসেনারা মুক্তি দেয়। পাকবাহিনীর নির্মম নির্যাতনে ডা. বজলুর রহমান নিহত হন। তিনি এ এলাকার প্রথম শহীদ। সীমান্তবর্তী অঞ্চলের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগের জন্য পাকবাহিনী চৌগাছার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ নদের ওপর কাঠের ব্রিজ নির্মাণ করে। এ ব্রিজ নির্মাণের সময় তারা গ্রামবাসীদের মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করে মাটি কাটিয়ে রাস্তা নির্মাণ করতে বাধ্য করে। এছাড়া অন্যান্য ক্যাম্পেও অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়।
পাকবাহিনী চৌগাছা ডাকবাংলো, চৌগাছা শাহাদৎ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাশিলা, হিজলী ও বর্ণী ইপিআর ক্যাম্প, দশপাকিয়ার দত্তের পুকুরপাড়, সাঞ্চাডাঙ্গার কচুবিলার মাঠ, হাকিমপুরের আমবাগান, আড়পাড়ার ভূমি অফিসে নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির স্থাপন করে।
চৌগাছার বহু বধ্যভূমি ও গণকবরে পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। চৌগাছা জেলা পরিষদের ডাকবাংলোর উত্তর পাশ, বর্তমান উপজেলা পরিষদের সম্মুখভাগ, আড়পাড়া বাজার সংলগ্ন জায়গা, মাশিলা ফকির শাহের আখড়া, সাঞ্চাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উত্তর পাশ, বর্ণি ইপিআর ক্যাম্পের উত্তর পাশ, বর্ণি ইপিআর ক্যাম্পের পশ্চিম পাশ, হাকিমপুর ফকির চানের আমবাগান, পুড়াপাড়া ব্রিজের পাশের টেরীতলা, হাজরাখানা পালপাড়া প্রভৃতি স্থানে বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে।
২৫শে জুন ভারতীয় বাহিনীর সমর্থনে মুক্তিযোদ্ধারা বর্ণি ইপিআর ক্যাম্প দখলের উদ্দেশ্যে আক্রমণ পরিচালনা করেন। ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা এতে নেতৃত্ব দেন। ভারতীয় বাহিনী পাকসেনাদের ওপর মর্টারের শেল নিক্ষেপ করলে পাকবাহিনী বাংকার থেকে বের হয়ে মিত্রবাহিনীর ওপর আক্রমণ করবে, এ সুযোগে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীকে লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করবেন, এরূপ কৌশল নির্ধারণ করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতীয় বাহিনী মর্টারের শেল নিক্ষেপ করে, কিন্তু শেলগুলো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ফলে শত্রুসেনারা বের না হয়ে বাংকারের ভেতর থেকেই গুলিবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা গুলি চালালে দুপক্ষের মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে চান্দাআফরা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম শহীদ হন।
চৌগাছায় ২১ ও ২২শে নভেম্বর বিমান যুদ্ধ, ট্যাংকের গোলা বর্ষণ ও হাতাহাতি যুদ্ধের ঘটনা ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চৌগাছায় এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ-যুদ্ধের স্থান ছিল চৌগাছার জগন্নাথপুরের (বর্তমানে মুক্তিনগর) আমবাগান। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ-যুদ্ধকে গরীবপুরের যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। মূলত এটি ছিল দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখলের যুদ্ধ। এ-যুদ্ধ মিত্রবাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে সংঘটিত হয়। যুদ্ধে পাকসেনারা পরাজিত হয়। এখানে ৭৬ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং তাদের অনেক ট্যাংক ধ্বংস হয়।
এছাড়া বুড়িন্দিয়া দত্তপুকুরের পাড়, মাশিলার ফকির শাহের আখড়া, বর্ণি ইপিআর ক্যাম্প, সাঞ্চাডাঙ্গার কচুবিলা, হাকিমপুরের আমবাগানেও পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যুদ্ধ হয়। অনেক মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ মানুষ ও পাকসেনা এসব যুদ্ধে হতাহত হয়। ঝিকরগাছা থানার <মুজিব বাহিনী-র ডেপুটি কমান্ডার আব্দুল আলিমের নেতৃত্বে আব্দুস সাত্তার, আমিরুল আলম খান, রফিকুল ইসলাম প্রমুখ মুজিব বাহিনীর সদস্য বিভিন্ন স্থানে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
৩রা ডিসেম্বর পাকবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর মধ্যে আড়পাড়া মাঠ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ-যুদ্ধে ৩৬ জন মিত্রসেনা শহীদ হন। অপরপক্ষে ১১ জন পাকসেনা নিহত ও পাকবাহিনী পরাজিত হয়। ৩রা ডিসেম্বর চৌগাছা হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- নূরুল ইসলাম, বীর বিক্রম- (পিতা শফি উল্লাহ, আফরা চন্দরপুর, শলুয়া বাজার), হাজারীলাল তরফদার, বীর প্রতীক- (পিতা রসিকলাল তরফদার, রানীয়ালী)।
চৌগাছার ৮ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন- নুরুল ইসলাম, বীর বিক্রম (৫ই আগস্ট চৌগাছা বিওপি ক্যাম্প আক্রমণে শহীদ), মো. জয়নাল আবেদীন (পিতা হোসেন মিয়া, যাত্রাপুর), মো. মোজাহার আলী (পিতা ইব্রাহিম আলী, চন্দ্রপাড়া), মো. খাইরুল ইসলাম (পিতা মহর আলী, কোটালীপাড়া), মো. সুজাউদ্দৌলা (পিতা আব্দুর রহমান, জগন্নাথপুর), মো. গোলাম কবির (পিতা জাহাব আলী, রামকৃষ্ণপুর), মো. সিরাজুল ইসলাম (পিতা কটাই মণ্ডল, উজিরপুর) এবং মো. মনির হোসেন (পিতা শফিউল্লাহ মৃধা)।
মো. মশিউর রহমান এমএনএ-এর গ্রাম মনে করে ছোট সিংহঝুলি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য এ গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে মশিউর নগর। গ্রামের প্রবেশপথে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে।
সিংহঝুলি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নাম দেয়া হয়েছে শহীদ মশিউর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়। জগন্নাথপুর গ্রাম মুক্ত হলে এ গ্রামের নামকরণ হয় মুক্তিনগর। মুক্তিনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে একটি বিদ্যালয় এখানে স্থাপন করা হয়েছে। বুড়িন্দিয়ার দত্তপুকুরের পাড়ে সংঘটিত যুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। ২০১০ সালের ১৬ই ডিসেম্বর চৌগাছা শহরের প্রাণকেন্দ্রে স্বাধীনতার স্মৃতিভাস্কর্য ‘দুর্জয় দুর্গ’ নির্মাণ করা হয় ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেছেন শিল্পী মো. আতিয়ার রহমান। [মো. মোস্তানিছুর রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড