You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা (কুমিল্লা) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা (কুমিল্লা)

চৌদ্দগ্রাম উপজেলা (কুমিল্লা) কুমিল্লা জেলার দক্ষিণ- পূর্বদিকে অবস্থিত। কুমিল্লা সেনানিবাসের সঙ্গে নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের যোগাযোগ এবং রসদ সরবরাহের ক্ষেত্রে এ উপজেলা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিকট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাছাড়া ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী হওয়ায় এ এলাকা পাকবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী উভয়ের জন্যই ছিল সমান গুরুত্বপূর্ণ।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এ উদ্বুদ্ধ হয়ে চৌদ্দগ্রামের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। থানা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এলাকার বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ ও বক্তৃতা প্রদানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেন। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় গণহত্যার পর পাকবাহিনী ২৬শে মার্চ কুমিল্লার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে এবং কুমিল্লা বিমানবন্দর দখল করে নেয়।
২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর দেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। চৌদ্দগ্রাম উপজেলার মানুষও এর জন্য প্রস্তুত হয়। সেরু মুন্সী (কৃষক), আমীর হোসেন মনু, আবদুল আজিজ আফিন্দি প্রমুখের বাড়িতে বোমা বানানো এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন ছাত্রনেতা আনিসুর রহমান নাজাত (সদস্য, কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি, কুমিল্লা জেলা শাখা), কাজী গোলাম মাওলা (ছাত্র), সেরু মুন্সী ও মুহম্মদ ইসহাক মিয়া (কৃষক)। প্রশিক্ষণের জন্য চিওড়া ও আশপাশের গ্রাম থেকে ৭-৮টি বন্দুক সংগ্রহ করা হয়। ২৬শে মার্চ বিকেলে জগন্নাথদিঘি ডাকবাংলোর সামনে এক জনসভায় আফসার উদ্দিন চৌধুরীকে সভাপতি এবং সাকী চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে দক্ষিণ চৌদ্দগ্রাম আঞ্চলিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।
সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে এলাকার জনগণ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গাছের গুঁড়ি, পিচের ড্রাম, ইট ও বাস-ট্রাক ফেলে ব্যারিকেড তৈরি করে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন ধ্বংস করে রেল যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ২৬শে মার্চ রাত ১টার দিকে ২৪ ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্স রেজিমেন্ট ও ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারদের একটি অংশ এবং ১২০ মিলিমিটার মর্টারবাহী শতাধিক গাড়ির একটি কনভয় ময়নামতি সেনানিবাস থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দিলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শুয়াগাজি এলাকায় গাছের গুঁড়ি, পিচের ড্রাম ও ইট ফেলে স্থানীয় জনগণ ব্যারিকেড তৈরি করে। ফলে, পাকবাহিনী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়।
২৭শে মার্চ বেলা আড়াইটার দিকে জগন্নাথদিঘি এলাকার উত্তর-পশ্চিম কোণে মহাসড়কের কাঠের সেতুটি এলাকাবাসী আগুন দিয়ে ধ্বংস করে এবং দিঘির পাড় কেটে দেয়, যাতে পাকবাহিনী ময়নামতি সেনানিবাস থেকে ফেনী বা চট্টগ্রামে যেতে না পারে। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক রাতে কাজী আফতাবুল ইসলাম গেদু মিয়া ও আনিসুর রহমান নাজাতের নেতৃত্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে চলাচলকারী পাকবাহিনীর এক কনভয়ের ওপর বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এসব বোমা বানানোর রসদ ফেব্রুয়ারি- মার্চ মাসে ঢাকা থেকে চিওড়া গ্রামের প্রতিরোধ সংগ্রামীদের নিকট সরবরাহ করা হয়।
৩রা এপ্রিল জসিমউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী (নারায়ণকরা)-র উদ্যোগে পাকবাহিনীর জগন্নাথদিঘি ক্যাম্পের নিকটবর্তী ভারতীয় সীমান্তের ভেতরে ডিমাতলী (বড়টিলা) অঞ্চলে একটি ক্যাম্প গড়ে তোলা হয় এবং সেখানে চৌদ্দগ্রাম থানা মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এ ক্যাম্পের উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি ছিলেন গণপরিষদ সদস্য এডভোকেট মীর হোসেন চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক জসিমউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। ২নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার্স মেলাঘরের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের মাধ্যমে এ ক্যাম্পের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বিশেষ বিবেচনায় ২৪শে জুলাই এ ক্যাম্পটিকে ওয়ার্কার্স ক্যাম্প হিসেবে অনুমোদন দেয় এবং জসিমউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে এর প্রধান নিযুক্ত করা হয়।
চৌদ্দগ্রাম থানা মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ ক্যাম্পের তিনটি শাখা ছিল— সাধারণ মুক্তিবাহিনী (গেরিলাসহ) শাখা, গোয়েন্দা শাখা ও রাজনৈতিক শাখা। প্রথম শাখার কাজ ছিল সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে অপারেশন পরিচালনা করা। দ্বিতীয় শাখার কাজ ছিল শত্রুপক্ষের অবস্থান নির্ণয়, ম্যাপ তৈরি ও গোপন খবরাখবর সংগ্রহ করা। তৃতীয় শাখার কাজ ছিল যুবকদের সংগঠিত করে যুবশিবির-এ প্রেরণ ও তাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা এবং সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। এছাড়া, এ শাখা বাঙালি শরণার্থীদের অভ্যর্থনা, আশ্রয়দান ও খাদ্যের ব্যবস্থা করত। এ ক্যাম্পের সঙ্গে সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও ভারতীয় অফিসারদের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ক্যাম্পের উদ্যোগে চৌদ্দগ্রামের বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রামে সভা-সমিতির মাধ্যমে জনগণের মনোবল বৃদ্ধি ও তাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার ব্যবস্থা করা হয়। ৬ই ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার- এডভোকেট মীর হোসেন চৌধুরী এমপিএ-কে লিয়াজোঁ অফিসার নিযুক্ত করে। উল্লেখ্য যে, এ ক্যাম্প থেকে মাত্র দুমাইল দূরে জগন্নাথদিঘিতে পাকবাহিনীর একটি ঘাঁটি ছিল।
আওয়ামী লীগ নেতা কাজী জহিরুল কাইয়ুম (চিওড়া) মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে দেশের পরিস্থিতি তুলে ধরেন। বামপন্থী নেতা কাজী জাফর আহমদ (চিওড়া) পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি-র সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সমন্বয় কমিটির একটি ক্যাম্প পরিচালনা করেন। এছাড়া, হারুন- অর রশিদ (রাজেশপুর) তেলিয়ামুড়া ক্যাম্পে পলিটিক্যাল মটিভেটর হিসেবে, মফিজুর রহমান বাবলু (চিওড়া ) রাধানগর ক্যাম্পের ইনচার্জ হিসেবে এবং কাজী আফতাবুল ইসলাম গেদু মিয়া (আহ্বায়ক, পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি, কুমিল্লা জেলা শাখা) চৌদ্দগ্রাম বাতিসা ক্যাম্পের ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। চৌদ্দগ্রাম থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে সিরাজুল ইসলাম হারুন, মমতাজ হাবিলদার, রুহুল আমিন হাবিলদার, মফিজ পাটোয়ারী প্রমুখ থানা থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেন। প্রশিক্ষণের জন্য অনেক মুক্তিযোদ্ধা এ পথে ভারতে যান।
চৌদ্দগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কাজী জহিরুল কাইয়ুম (চিওড়া), কাজী জাফর আহমদ (চিওড়া), মীর হোসেন চৌধুরী (শিলরী, আলকরা), জসিমউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী (নারায়ণকরা), হারুন-অর রশিদ (রাজেশপুর), মফিজুর রহমান বাবলু (চিওড়া), কাজী আফতাবুল ইসলাম গেদু মিয়া, আনিসুর রহমান নাজাত (চিওড়া), হাবিলদার রংগু মিয়া, বীর বিক্রম- (পিতা আবু মিয়া, মৌবাড়ি), আবদুল কাদের চৌধুরী (পিতা আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরী, ফাল্গুনকরা) প্রমুখ। উপজেলায় যুদ্ধকালীন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন আনিসুর রহমান নাজাত, লে. ইমামুজ্জামান প্রমুখ। চৌদ্দগ্রাম ছিল ২নং সেক্টরের নির্ভরপুর সাব-সেক্টরের আওতাধীন। এর অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন আকবর ও লে. মাহবুব।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি-র উদ্যোগে চৌদ্দগ্রাম গেরিলা বাহিনী গঠিত হয়। চিওড়া ছিল এ বাহিনীর কুমিল্লা জেলার প্রধান কেন্দ্র। এ বাহিনী চৌদ্দগ্রাম থানা আক্রমণ করে বহু অস্ত্র সংগ্রহ করে এবং চিওড়া গ্রামে প্রায় চারশতাধিক তরুণকে প্রশিক্ষণ দেয়। এ বাহিনী বেশ কয়েকটি অপারেশন পরিচালনা করে।
ময়নামতি সেনানিবাস থেকে বের হয়ে পাকবাহিনী প্রথমে রামমালায় ক্যাম্প স্থাপন করে। এরপর বিমানবন্দর হয়ে পর্যায়ক্রমে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে থানা সদরে দুটি, জগন্নাথদিঘি, রাজারমার দিঘি, জগমোহনপুর কাছারি, বাতিসা ও গোবিন্দমাণিক্যের দিঘিতে ক্যাম্প স্থাপন করে।
চৌদ্দগ্রামে সাবেক প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এম এইচ চৌধুরী সুক্কু মিয়া (সোনাপুর) মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। পাকবাহিনীকে সহায়তা দানের জন্য এখানে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সংগঠক গোলাম মহিউদ্দিন চৌধুরী (সোনাপুর) ও সদস্য মৌলভী জুলফিকার হোসেন (উত্তর বেতিয়ারা) পাকবাহিনীকে বিভিন্ন প্রকার অপকর্মে সহায়তা করে। শান্তি কমিটির নেতৃত্বে এলাকার রাজাকাররাও নানা অপতৎপরতা চালায়।
২৬শে জুলাই পাকবাহিনী চিওড়া ইউনিয়নের নোয়াপাড়া গ্রামে গণহত্যা চালায়। নোয়াপুর গণহত্যায় ৭ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। গণহত্যার পাশাপাশি তারা ব্যাপক লুটতরাজ করে। এ-সময় কয়েকজন নারী হানাদার বাহিনী দ্বারা ধর্ষিত হন। ২রা জুলাই কোমারডোগা গণহত্যায় ৮ জন শহীদ হন। এর আগে মিয়াবাজার-ফুলতলি সড়কে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ২১ জন পাকসেনা নিহত হলে তার প্রতিশোধস্বরূপ পাকবাহিনী এ গণহত্যা চালায়। এছাড়া এ উপজেলায় আরো দুটি গণহত্যা সংঘটিত হয় – ৪ঠা ডিসেম্বর খিরনশাল গণহত্যা ও নভেম্বর মাসে কটপাড়া- আঠারবাগ গণহত্যা। দুটিতেই ৮ জন করে নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন।
পাকবাহিনী চৌদ্দগ্রাম থানা দখল করার পর তাদের দোসরদের সহায়তায় চান্দিশকরা গ্রামে প্রবেশ করে মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম পাটোয়ারীর বাড়িতে ব্যাপক লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা ঐ গ্রামের এক ব্যক্তির স্ত্রীকে ধর্ষণ করে। উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধে পাটোয়ারী পরিবারের ৪ জন সদস্য শহীদ হন। পাকবাহিনীর অত্যাচারের শিকার বহু শরণার্থী এ থানা অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নেয়।
চৌদ্দগ্রামের জগন্নাথদিঘি ডাকবাংলো ও গুণবতী রেল স্টেশনের পাশের খাদ্যগুদাম ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র। আশপাশের গ্রামের বহু সাধারণ মানুষকে এদুটি নির্যাতনকেন্দ্রে ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। খাদ্যগুদামে নারীনির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটে।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় তিনটি উল্লেখযোগ্য গণকবর রয়েছে— নোয়াপুর গণকবর, বেতিয়ারা গণকবর ও বৈলপুর করপার্টি মুক্তিযোদ্ধা বাজার গণকবর। ২৬শে জুলাই নোয়াপুর গণহত্যায় শহীদ ৭ জনকে এ গ্রামের মফিজুর রহমান বাবলুর বাড়িতে কবর দেয়া হয়। ১১ই নভেম্বর বেতিয়ারা যুদ্ধে শহীদ ৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বেতিয়ারা গ্রামে কবর দেয়া হয়। ৪ঠা ডিসেম্বর বৈলপুর যুদ্ধে শহীদ ৬ জনকে বৈলপুর গ্রামে গণকবর দেয়া হয়। এছাড়া জগন্নাথদিঘির উত্তর পাশে কেছকি মুড়া (কান্দি) গ্রামের সৈয়দ আলী ও লুতু আলীর বাড়ি এবং চিওড়া ইউনিয়নের ছোট সাতবাড়িয়া গ্রামেও গণকবর রয়েছে।
চৌদ্দগ্রামে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকগুলো যুদ্ধ হয়। সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—মিয়াবাজার যুদ্ধ, বালুজুড়ি যুদ্ধ, চৌদ্দগ্রাম বাজার যুদ্ধ জগন্নাথদিঘি যুদ্ধ, রাজারমার দিঘি যুদ্ধ, নয়াবাজার যুদ্ধ, বেতিয়ারা যুদ্ধ, হাড়িসর্দার যুদ্ধ ও বৈলপুর যুদ্ধ। ৩রা এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে পাকবাহিনী ময়নামতি সেনানিবাস থেকে ৮ লরি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে চৌদ্দগ্রামের উদ্দেশে রওনা করে। এ খবর পেয়ে আবদুল কাদের চৌধুরী, প্রমোদ চক্রবর্তী এবং আনসার, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের নেতৃত্বে দেড়শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা কাঁকড়ী নদীর দুধারে মিয়াবাজার এলাকায় ট্রাম্প করে ডিফেন্স তৈরি করেন। সেখানে পাকবাহিনীর সঙ্গে তাঁদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকবাহিনীর ৩টি লরি বিধ্বস্ত ও ১২ জন সেনা নিহত হয় এবং ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৭ই এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা মিয়াবাজার ব্রিজটি ধ্বংস করেন। এ ব্রিজটি পুনরায় চালু করার জন্য পাকবাহিনীর দুই কোম্পানি সৈন্য এলে মুক্তিবাহিনী তাদের ওপর আক্রমণ করে। ৩ ঘণ্টা স্থায়ী এ- যুদ্ধে পাকবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে কুমিল্লা শহরে পালিয়ে যায়। যুদ্ধে ৫০ জন পাকসেনা হতাহত হয় এবং দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও একজন আহত হন। মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের ৩ টনের একটি গাড়ি গোলাবারুদসহ ধ্বংস করে এবং অপর একটি গাড়ি দখল করে নেয়। ৯ই এপ্রিল সকাল ৮টার দিকে বালুজুড়ি ভাঙ্গা পুলের কাছে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর ৩০ জন সৈন্য নিহত ও ৬ জন আহত হয় এবং বাকিরা পিছু হটে। ২৯শে এপ্রিল নয়াবাজারে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এ- যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আলী আকবর শহীদ হন। ১৪ই মে পাকবাহিনীর ৩৯ বেলুচ রেজিমেন্ট ভারী অস্ত্রসহ চৌদ্দগ্রাম বাজারে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে ৫০ জনের মতো পাকসেনা নিহত এবং ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ২৬শে মে রাত ১১টার দিকে লে. ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ জগন্নাথদিঘি এলাকায় পাকসেনা ক্যাম্পে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে ৪ জন পাকসেনাকে হত্যা করে এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিনিয়ে নেয়। ২৮শে মে ভোরে রাজারমার দিঘি এলাকার পাকসেনাদের বাংকারে মুক্তিবাহিনী গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। ৩০শে মে মিয়াবাজারে চতুর্থ বেঙ্গল ‘বি’ কোম্পানির এক প্লাটুন সৈন্য পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। এতে ৩ জন পাকসেনা নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। একই দিন চতুর্থ বেঙ্গল ‘ব্রাভো’ কোম্পানির এক প্লাটুন সৈন্য চৌদ্দগ্রাম থানায় অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। এতে শত্রুপক্ষের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১০ই জুন লে. মাহবুব রহমানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা রাজারমার দিঘি ও জগমোহনপুর কাছারির শত্রু-অবস্থানের ওপর হামলা চালায়। হামলায় পাকবাহিনীর ৮ জন সৈন্য নিহত ও ৫ জন আহত হয়।
১৪ই জুন পাকসেনাদের একটি দল নয়াবাজার হয়ে চৌদ্দগ্রাম আসার চেষ্টা করলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিরোধ করেন। এ-সময় উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে পাকবাহিনীর ৩০ জন হতাহত হয় এবং বাকিরা পিছু হটে। ২রা জুলাই মিয়াবাজার-ফুলতলি সড়কে পাকবাহিনীর একটি গাড়ির ওপর মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালালে ৩ জন অফিসারসহ (একজন লে. কর্নেল) ২১ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১১ই জুলাই পাকবাহিনীর একটি কোম্পানি মিয়াবাজারে গেলে মুক্তিবাহিনী তাদের ওপর আক্রমণ করে। এতে ১০ জনের অধিক পাকসেনা হতাহত হয়। বিকেল ৩টার দিকে পাকসেনারা পিছু হটে।
১১ই সেপ্টেম্বর রাত ১২টার দিকে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর বিশেষ গেরিলা বাহিনীর একটি দল ঘন অন্ধকারে বেতিয়ারা মহাসড়কের কাছে পৌছায়। তখন গাছের আড়ালে ওঁত পেতে থাকা পাকবাহিনী তিন দিক থেকে তাঁদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে ঘটনাস্থলেই ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
১২ই সেপ্টেম্বর চৌদ্দগ্রামের হাড়িসর্দার বাজারে মুক্তিবাহিনী স্থানীয় দালাল, শান্তি কমিটি ও পাকসেনাদের এক সভায় হামলা করে। এতে একজন জিওসিসহ তিনজন পাকসেনা নিহত হয়। এরপর পাকবাহিনী হাড়িসর্দার বাজারে ঘাঁটি করে। ৪ঠা অক্টোবর লে. ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল ও দুটি গেরিলা কোম্পানি তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ২৫ জন পাকসেনা ও কয়েকজন রাজাকারকে হত্যা করে। ১০ই নভেম্বর পিপুলিয়া- হাজতখোলা যুদ্ধে আলী আশরাফ বীর বিক্রম (পিতা নওয়াব আলী, নাঙ্গলকোট) শহীদ হন। ৪ঠা ডিসেম্বর বৈলপুর যুদ্ধে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা ও কয়েকজন ভারতীয় সেনা শহীদ হন এবং এদিনই চৌদ্দগ্রাম উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুল মান্নান খন্দকার, বীর উত্তম- (পিতা আব্দুল জব্বার খন্দকার, পশ্চিম ডেকড়া), নূরুল আমিন, বীর উত্তম- (পিতা বাদশা মিয়া, পাশাকোট), তৌহিদ উল্লাহ, বীর বিক্রম- (পিতা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, কাঠকরা), ফরিদউদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম- (পিতা আসাদ আলী ভূঁইয়া, পাগৈ), সিরাজুল হক, বীর বিক্রম- (পিতা লাল মিয়া, কাপরচৌতুলী, দোরকারা), <আব্দুল কাদের, বীর প্রতীক- (পিতা কাজী মমতাজ উদ্দিন, লতিফ সিকদার, চিউরা), আলী আকবর, বীর প্রতীক- (পিতা সৈয়দ আলী, দক্ষিণ ফাল্গুনকড়া), জামাল কবির, বীর প্রতীক- (পিতা সিরাজুল ইসলাম মজুমদার, ফাল্গুনকড়া), বাহার উদ্দিন রেজা, বীর প্রতীক- (পিতা জুড়া মিয়া মাস্টার, নোয়াপুর, চিওড়া), মোহাম্মদ মোস্তফা, বীর প্রতীক- (পিতা বজলুর রহমান, বসন্তপুর, বাসিতা) ও সায়ীদ আহমেদ, বীর প্রতীক- (পিতা আমির হোসেন মজুমদার, সোনাপুর)।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আলী আশরাফ, বীর বিক্রম (পিতা নওয়াব আলী, নাঙ্গলকোট; ১০ই নভেম্বর পিপুলিয়া হাজতখোলা যুদ্ধে শহীদ), আব্দুল মান্নান খন্দকার, বীর উত্তম (২৪শে সেপ্টেম্বর কালেঙ্গা সিন্দুরখান টিলা যুদ্ধে শহীদ), সিরাজুল হক, বীর বিক্রম (১২ই নভেম্বর সালদা নদীর ফারাপাড়ায় পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), মোহাম্মদ মোস্তফা, বীর প্রতীক (১৪ই ডিসেম্বর শহীদ), আবদুল কাদের (পিতা গোলজার হোসেন, সাতবাড়িয়া, বেতিয়ারা যুদ্ধে শহীদ), আলী আকবর, বীর প্রতীক (২৯শে এপ্রিল নয়াবাজারে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), বাহার আহমদ (পিতা অলিউর রহমান, রাঙ্গামাটিয়া; ৩রা সেপ্টেম্বর মতিয়াতলিতে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), আব্দুল আজিজ (পিতা হাসন আলী, নারায়ণপুর), আব্দুল জব্বার (পিতা সমা গাজী, সৈয়দপুর), আবদুল কাদের (পিতা গোলজার হোসেন, সাতবাড়িয়া; বেতিয়ারা যুদ্ধে শহীদ), মতলব মিয়া (পিতা মোসলেম মিয়া, বড় সাতবাড়িয়া), আনা মিয়া (পিতা আ. হামিদ, আঠারমাস), রুস্তম আলী (পিতা হাজী আখতারুজ্জামান, ভাংগা পুস্করণী), রাজা মিয়া (পিতা জন্তর আলী বেপারী, চান্দিশকরা), আব্দুল গফুর (পিতা মৌলবী মো. ইউছুফ আলী, নবগ্রাম), দুধ মিয়া (পিতা আব্দুল জলিল, বসন্তপুর), মস্ত মিয়া (পিতা মুন্সী মিয়া, আঠারবাদ), আবদুর রহমান (পিতা আকমত আলী, জয়ন্তীনগর), আবু তাহের (পিতা মোক্তার হোসেন, লক্ষ্মীপুর), জগদীশ চন্দ্র ভৌমিক (পিতা রামচন্দ্র ভৌমিক, তপৈয়া), সিদ্দিকুর রহমান (পিতা আব্বাস আলী, খিরনশাল), হাফেজ হোসেন আলী (পিতা মোজাফ্ফর আলী, কুলাসার), কাজী আজিজুল ইসলাম (পিতা কাজী আমিনুল ইসলাম, কাজীবাড়ি), আবদুস সোবহান (পিতা জন্তর আলী, কুলাশার), কাজী মাহবুবুল হক (পিতা কাজী জন্তর আলী, শ্রীপুর), পিয়ার আহমেদ (পিতা হাসান আলী, কবুরুয়া), আবদুল খালেক (পিতা গোলাম আলী, ইশানচন্দ্রপুর), খায়রুল হোসেন (পিতা আলী মিয়া, বাতিসা), হুমায়ুন কবীর (পিতা আনু মিয়া, খিরনশাল), চান মিয়া (পিতা মৌলভী আ. করিম, সোনারামপুর), আবদুল গোফরান ভূঁইয়া (সেনের খিল; ১৫ই ডিসেম্বর বইলপুর যুদ্ধে শহীদ) ও আফজালুর রহমান (সুতাছড়া; ১৬ই ডিসেম্বর শহীদ)।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বেতিয়ারা, চৌধুরীবাড়ি পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে ফাল্গুনকরায়, শ্রীপুর ইউনিয়নের গজারিয়া এবং বাতিসা ইউনিয়নের বসন্তপুরে চারটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া বসন্তপুরে শহীদ আলী আশরাফ বীর বিক্রমের কবর বাঁধাই করা হয়েছে। [মোতাহার হোসেন মাহবুব]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড