মুক্তিযুদ্ধে চুনারুঘাট উপজেলা (হবিগঞ্জ)
চুনারুঘাট উপজেলা (হবিগঞ্জ) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ-এ সারা দেশের ন্যায় চুনারুঘাটের জনগণও উদ্বুদ্ধ হয়। অন্য অঞ্চলের মতো চুনারুঘাটেও যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক মোস্তফা শহীদ এমপিএ, আব্দুর রশীদ চৌধুরী (ছাবু মিয়া), আজিজুর রহমান ওরফে ছুরুক আলী, আবদুল গফ্ফার, আব্দুল মান্নান সরকার, সিরাজুল ইসলাম, আনসার কমান্ডার আবদুস সামাদ পিসি, আবদুল খালেক, শফিকুল ইসলাম আরজু প্রমুখের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে ধরে নিয়ে চুনারুঘাটের ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক, মণিপুরী ও চা-শ্রমিকসহ আপামর জনতা প্রস্তুতি নিতে থাকে। রাজার বাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, গাজীপুর হাইস্কুল প্রভৃতি এলাকায় মুক্তিকামী যুবকরা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের নির্দেশে অবসরপ্রাপ্ত সেনা, পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যরা সংগঠিত হয়ে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন।
আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের নির্দেশে আনসার কমান্ডার আব্দুস সামাদ পিসির নেতৃত্বে চুনারুঘাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে, ৯ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ছুটিতে আসা ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল কুদ্দুস (অনু মিয়া)-র নেতৃত্বে গাজীপুর হাইস্কুল মাঠে এবং এম সি কলেজের ছাত্র স্কাউট লিডার মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ এবং আওয়ামী লীগ নেতা রইছ উল্লার নেতৃত্বে রাজার বাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। চা-শ্রমিক সর্দার নিবারণ উরাঙ্গ, ধরম সিং, বুদু কালঞ্জির, দুর্গেশ রঞ্জন ধরের নেতৃত্বে চা-শ্রমিকদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় তীরন্দাজ বাহিনী। পরবর্তী সময়ে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা ভারতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ করেন।
চুনারুঘাটে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ হলেন- এনামুল হক মোস্তফা শহীদ এমপিএ, সার্কেল অফিসার জয়নাল আবেদীন খান, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রশীদ চৌধুরী (ছাবু মিয়া), আজিজুর রহমান ওরফে ছুরুক আলী, আব্দুল খালেক, আব্দুল গফ্ফার, আব্দুল মান্নান সরকার, মইন উদ্দিন, আব্দুস সামাদ পিসি, চা-শ্রমিক সর্দার নিবারণ উরাঙ্গ, ধরম সিং ও বুদু কালঞ্জি, সিরাজুল ইসলাম, আব্দুল গনি, সফিউল আলম চৌধুরী বাচ্চু, নুরুল হক, জাহাঙ্গীর খান, আব্দুর রহিম জুয়েল, আব্দুর রহমান, সফাত উল্লা, সফিক মিয়া, রমিজ আলী, আব্দুস সামাদ, আজিজুর রহমান কাপ্তান, দুর্গা দাশ, সফিকুল ইসলাম আরজু, আব্দুল মন্নান চৌধুরী ওরফে কুটি মিয়া, জমরুত চৌধুরী প্রমুখ।
এনামুল হক মোস্তফা শহীদ এমপিএ, সার্কেল অফিসার (সিও) জয়নাল আবেদীন খান, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রশীদ চৌধুরী (ছাবু মিয়া), আজিজুর রহমান ওরফে ছুরুক আলী, আব্দুল গফ্ফার, আব্দুল মান্নান সরকার, মইন উদ্দিন, আব্দুস সামাদ পিসি, চা-শ্রমিক সর্দার নিবারণ উরাঙ্গ, ধরম সিং ও বুদু কালঞ্জি, দুর্গেশ রঞ্জন ধর প্রমুখের নেতৃত্বে ঢাকা- সিলেট মহাসড়কের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সাতছড়ি নামক স্থানে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। চা-শ্রমিকদের নিয়ে গড়ে তোলা তীরন্দাজ বাহিনী তীর ছুড়ে প্রথমেই পাকসেনাদের নাস্তানাবুদ করে দেয়।
২০শে এপ্রিল মাধবপুর উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামের সৈয়দ সৈদউদ্দিনের পুত্র শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকার কমান্ডার সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার (এরশাদ আমলের হুইপ ও কৃষি প্রতিমন্ত্রী, বর্তমানে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত)-এর নেতৃত্বে চুনারুঘাটে পাকসেনারা প্রথম প্রবেশ করে সিও অফিসে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তী সময়ে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজাকারা দুর্গাপুর বাজার, আমুরোড প্রাইমারি স্কুল, একঢালা প্রাইমারি স্কুল এবং নালমুখ বাজারে ক্যাম্প স্থাপন করে।
চুনারুঘাটে পাকবাহিনীর হাসানকে সেক্রেটারি করে হবিগঞ্জ শাখা শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সদস্য ও রাজাকার কমান্ডার সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার চুনারুঘাট উপজেলায় শান্তি কমিটি এবং রাজাকার বাহিনী গঠনে ভূমিকা রাখে। মুসলিম উদ্দিন (চেয়ারম্যান, চুনারুঘাট সদর ইউনিয়ন, বড়াইল)-কে আহ্বায়ক, আবুল হাশিম (চেয়ারম্যান, আহমদাবাদ ইউনিয়ন)-কে সদস্য-সচিব করে চুনারুঘাট থানা শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। শান্তি কমিটির উল্লেখযোগ্য সদস্যরা হলো- গোলাম মোস্তফা চৌধুরী, ছুরুক আলী, বদিউর রহমান, আব্দুর রশিদ, মাসুদ চৌধুরী (রানীগাঁও), সৈয়দ জিয়াউর রহমান (রামশ্রী; দালাল আইনে হাজতবাস), তামাই মহালদার প্রমুখ। ইউসুফ খা (পাইকপাড়া), আব্দুর রাজ্জাক (রহমতাবাদ), মো. চাঁদ (বাসুল্লা), আব্দুল হক (ষাড়েকোনা), ফিরোজ মিয়া (নরপতি), আজগর আলী (বনগাঁও), সুরুজ মিয়া (গাজীপুর) প্রমুখকে নিয়ে চুনারুঘাট থানা রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। শান্তি কমিটি এবং রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা পাকবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগসহ সকল মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে সহায়তা করে।
২০শে এপ্রিল অনুপ্রবেশের দিন শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকার কমান্ডার সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের নেতৃত্বে চুনারুঘাটে পাকসেনারা তাণ্ডবলীলা চালায়। অনুপ্রবেশকালে তারা হাতুণ্ডা ও চন্দনা গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে গ্রামদুটি পুড়িয়ে দেয়। পরবর্তী সময়ে সিও অফিসে ক্যাম্প স্থাপনের পর পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা হত্যা, গণহত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন চালায়। তারা চাঁদপুর চা-বাগান বাজারের বড় দোকানসহ কয়েকটি দোকান ও বাসা-বাড়ি লুটপাট করে। তারা বাল্লা সীমান্ত এলাকার ঐতিহ্যবাহী আসামপাড়া বাজার পুড়িয়ে বিরান ভূমিতে পরিণত করে। ভয় ও আতঙ্কে পুরো এলাকাবাসী ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পদ ফেলে এলাকা ছেড়ে ভারতসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করে। ঐ সময় গ্রামের কোনো-কোনো বাড়িতে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটে। ২১শে এপ্রিল পাকসেনারা ডা. অশোক রায়কে গ্রেফতার করে খোয়াই নদীর তীরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। এ সময় জিতেন্দ্র সরকার তাদের হাতে আহত হয়। ২২শে এপ্রিল পাকবাহিনী ফুলপুর গণহত্যা চালায়। এদিন তারা ফুলপুর গ্রামের ৮ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে গ্রেফতার করে দেউন্দি-সায়েস্তাগঞ্জ রাস্তার পূর্বপাশে গুলি করে হত্যা করে। ২৯শে এপ্রিল তারা বড়াইল গণহত্যা- চালায়। এতে ৬ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। ৩০শে এপ্রিল তারা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও আওয়ামী লীগ নেতা রইছ উল্লা (পশ্চিম রানীর কোর্ট, আহমদাবাদ)-কে গুলি করে হত্যা করে।
পাকবাহিনী এপ্রিলের শেষদিকে শানখলা ইউপির লালচান চা-বাগানে গণহত্যা চালায়। লালচান চা-বাগান গণহত্যায় ১১ জন চা-শ্রমিক শহীদ হন।
পাকবাহিনী ১১ই মে সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন গাজীপুরে হানা দিয়ে দিঘীরপাড় গণহত্যা- সংঘটিত করে। এতে সত্তর বছর বয়স্ক বৃদ্ধ ওমর মিয়া (কনা মিয়া) সহ ৯ জন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন। ১১ই মে মুক্তিযোদ্ধারা তেলিয়াপাড়া-চুনারুঘাট রাস্তায় এম্বুশ করে পাকবাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করেন। ১২ই মে পাকবাহিনী থানার সীমান্ত এলাকায় খোয়াই নদীর পাড়ের গাজীপুরের টেকেরঘাট গ্রামে গণহত্যা চালায়। টেকেরঘাট গণহত্যায় ৬ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। গাজীপুর স্কুল মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার দায়ে ৯ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল কুদ্দুস (অনু মিয়া)-কে পাকসেনারা ধরে নিয়ে শ্রীমঙ্গলে হত্যা করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত আব্দুল কুদ্দুছ (অনু মিয়া) ছুটি নিয়ে মায়ের কাছে এসেছিলেন। এ-সময় স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তিনি আর চাকরিতে যোগদান না করে এলাকার ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেন। এসব হত্যাযজ্ঞ ও অগ্নিকাণ্ডের পর এলাকার মানুষ দিকবিদিক ছুটে গেলেও হাজী ইছহাক মিয়া নামে এক ব্যক্তি মসজিদের খেদমত করার মানসে এলাকায়ই থেকে যান। ফলে তিনি নির্মমভাবে পাকসেনাদের হাতে শহীদ হন। ১৮ই মে পাকবাহিনী আহমদাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাশেম এবং ইউপি সচিব কবির মিয়ার যোগসাজশে গোছাপাড়া গণহত্যা- চালায়। এতে ১০ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। হানাদাররা এ গণহত্যায় নিহত রাখাল শুক্লবৈদ্যর স্ত্রীকে ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে। মুক্তিযোদ্ধা মরম আলী চৌধুরী পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়লে তাঁকে শ্রীমঙ্গলে নিয়ে হত্যা করে।
পাকবাহিনী আহমদাবাদ ইউনিয়নের নালুয়া চা-বাগানের ধরমনাথ লেনে ১৬ই মে গণহত্যা চালায়। নালুয়া চা- বাগান গণহত্যায় ২৭ জন চা-শ্রমিক শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলামের পিতা আবদুর রশীদ এবং চাচা রৌশন মিয়াকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। স্থানীয় দালালদের ইন্ধনে পাল বাড়িতে বিপিন পালসহ অন্যদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও পরনের ধুতি গলায় পেঁচিয়ে টেনে-হিঁচড়ে এবং বনে আগুন ধরিয়ে তাতে নিক্ষেপ করে হত্যা করে। এ-সময় তাদের হাতে দুজন গৃহবধূ মালতী শুক্লবৈদ্য ও পুষ্পরাণী শুক্লবৈদ্য নির্যাতিত হন।
২৫শে জুন খোয়াই নদীর পাড় গণহত্যা সংঘটিত হয়। এতে ৭ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন।
২৪শে সেপ্টেম্বর রানীগাঁও ইউনিয়নের কালেঙ্গা বনাঞ্চল যুদ্ধে ২২ জন পাকসেনা নিহত হলে হেডম্যান আব্দুল মান্নানকে গাছের সঙ্গে বেঁধে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে।
পাকবাহিনীর সিও অফিস ক্যাম্প ছিল নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। এছাড়া পাকবাহিনীর দুর্গাপুর বাজার, আমুরোড প্রাইমারি স্কুল, একঢালা প্রাইমারি স্কুল ক্যাম্প এবং নালমুখ বাজার রাজাকার ক্যাম্পও নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নারীসহ সাধারণ মানুষকে ধরে এনে এসব ক্যাম্পে নির্যাতন চালানো হতো।
গাজীপুরের সাগরদিঘীর পাড়ে একটি গণকবর রয়েছে। সাগরদিঘীর পাড় গণকবর-এ অনেককে মাটিচাপা দেয়া হয়। বাল্লা বাদশা মিয়ার পানির কূপে যাদের হত্যা করা হয়, তারা হলেন— রহিম উলাহ (৮০), আলিফ চান বিবি (৭০), মিশ্রির মা (৩০), আব্দুল খালেক, লেংরা আতিক ও আহমদ আলী। চুনারুঘাটের অন্য বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো হলো- নালুয়া চা-বাগানের ধরমনাথ লেনের পানির কূপ, সায়েস্তাগঞ্জ-দেউন্দি সড়কের পূর্ব পাশে শ্মশানঘাট, চুনারুঘাট উত্তর বাজার, খোয়াই নদীর তীর।
চুনারুঘাটে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকগুলো যুদ্ধ হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— রেমা চা-বাগান যুদ্ধ, নালুয়া চা-বাগান যুদ্ধ, কালেঙ্গা বনাঞ্চল যুদ্ধ, হরিণমারায় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের আক্রমণ, নালমুখ বাজার যুদ্ধ এবং একডালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ।
পাকবাহিনীর দালাল তমাই মহালদার হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ১৬ই মে রেমা চা-বাগানে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা রমিজ আলী (জগন্নাথপুর, সায়েস্তাগঞ্জ; মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীর বিক্রম’ উপাধীতে ভূষিত) শহীদ হন। ২৯শে মে নালুয়া চা-বাগানে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হয়। পাকবাহিনীর নিয়মিত টহল বাহিনীর ওপর এ স্থানে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেক ও তাঁর সহযোদ্ধাদের অতর্কিত হামলায় ১৯ জন পাকসেনা নিহত হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেক (মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীর বিক্রম’ উপাধীতে ভূষিত) শহীদ হন।
কালেঙ্গা বনাঞ্চল যুদ্ধ হয় ২৪শে সেপ্টম্বর। মুক্তিযোদ্ধারা কালেঙ্গা রিজার্ভ ফরেস্টে এম্বুশ পেতে পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি করতে সক্ষম হন। এখানে একজন অফিসারসহ ৬১ জন পাকসেনা নিহত হয়। এমন সফল যুদ্ধের মধ্যেও মুক্তিযোদ্ধা নায়েক আবদুল মান্নান শহীদ হন (কুমিল্লা; মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত)।
নভেম্বর মাসে মো. ইব্রাহিমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা হরিণমারায় পাকবাহিনী এবং রাজাকারদের আক্রমণ করেন। এ আক্রমণে পাকবাহিনী পিছু হটে। এ মাসেই মুক্তিযোদ্ধা শফিউল আলম চৌধুরী বাচ্চুর নেতৃত্বে নালমুখ বাজার যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে রাজাকাররা পালিয়ে যায়। একই সময় মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান কাপ্তানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা একডালা প্রাইমারি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। আক্রমণে রাজাকাররা পালিয়ে যায়। ৫ই ডিসেম্বর চুনারুঘাট উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মেজর জেনারেল চিত্তরঞ্জন দত্ত, বীর উত্তম- (পিতা উপেন্দ্ৰ চন্দ্ৰ দত্ত, মিরাশী), আবদুল খালেক, বীর বিক্রম- (পিতা মো. আ. গোফার, খৈলগাঁও), আব্দুল হক, বীর বিক্রম- (পিতা মো. সোনা মিয়া, শাহাপুর, মিরাশি) ও আব্দুল কুদ্দুস, বীর প্রতীক- (পিতা আব্দুস শহীদ, গোগাউড়া)।
এ ছাড়া নির্যাতনের শিকার চুনারুঘাটের ৪ জন নারী বীরাঙ্গনা – হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁরা হলেন- চাঁনপুর চা-বাগানের হিরামনি, সাবিত্রি, আহম্মদাবাদ ইউনিয়নের গোছাপাড়া গ্রামের মালতি রানী শুক্লবৈদ্য ও পুষ্পরানী শুক্লবৈদ্য।
চুনারুঘাটের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুল খালেক, বীর বিক্রম (১৪ই মে নলুয়া চা বাগান যুদ্ধে শহীদ), নীলাম্বর রুদ্র পাল (পিতা ভীম রুদ্র পাল, নালুয়া চা-বাগান, চানপুর), ছুরত আলী (পিতা নজাবত উলা, মিরাশী), মনতাজ উদ্দিন (পিতা মাক্কু মিয়া, চানপুর বস্তি), আব্দুল কাদির (পিতা আব্দুল হেকিম, উরুকান্দি, সায়েস্তাগঞ্জ), আব্দুল কাদির (পিতা আব্দুর করিম, ফান্ডাইল, শাকির মামদ), মহরম আলী চৌধুরী (পিতা বাজিদ চৌধুরী, গাজীপুর), পুলিশ সদস্য জহুর আলী (পিতা বয়াত উলা, শানখলা, শাকির মামদ), খুরশেদ আলী (পিতা আকবর আলী, গোবরখলা, গাজীপুর), মো. হাবিবুর রহমান (পিতা ইছব উলা, মাধবপুর, দুর্গাপুর, রামশ্রী), আব্দাল মিয়া (পিতা ইদ্রিছ মিয়া, সিংপাড়া), সৈয়দ বাদশা মিয়া (পিতা সৈয়দ গণি মিয়া, কচুয়া, মুছিকান্দি), আব্দুল হাই (পিতা আব্দর নুর, গোগাউড়া), আব্দুর রেজাক কটনা (পিতা মন্জব উলা, পাচারগাও, মিরাশী), রমজান আলী (পিতা আহমদ উলা, রাজাকোনা), গোপাল মুন্ডা (পিতা বয়া মুন্ডা, চানমারী, রেমা, গাজীপুর), নন্দলাল ব্যানার্জী (পিতা নিরঞ্জন ব্যানার্জী, বালুছড়া চা-বাগান)। এছাড়া রেমা চা-বাগান যুদ্ধে রমিজ আলী, বীর বিক্রম- (জগন্নাথপুর, সায়েস্তাগঞ্জ) এবং কালেঙ্গা বনাঞ্চল যুদ্ধে নায়েক আবদুল মান্নান, বীর উত্তম- (কুমিল্লা) শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নালুয়া চা-বাগান এবং লালচান্দ চা-বাগানে (পানছড়ি) স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। [মিলন রশীদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড