চুন্টা গণহত্যা (সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
চুন্টা গণহত্যা (সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) সংঘটিত হয় ১৮ই অক্টোবর। এতে ২২ জন গ্রামবাসী শহীদ হন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরের উত্তরে সরাইল থানা। সরাইল থানা সদরের উত্তর-পশ্চিমে চুন্টা ইউনিয়ন। ব্রিটিশ আমল থেকে সম্ভ্রান্ত হিন্দুরা এ গ্রামে বাস করত। বাংলার বিখ্যাত সেন বংশের লোকেরা এ গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। সেকালে কলকাতা থেকে চুন্টাপ্রকাশ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো। ড. অবিনাশ সেন ও শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক প্রবোধচন্দ্র সেন ছিলেন চুন্টা গ্রামের মানুষ। পাকিস্তান আমলে সম্ভ্রান্ত হিন্দুরা ভারতে চলে গেলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রচুর লোক এ গ্রামে বসবাস করত।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এবং পাকবাহিনী সরাইলের বিভিন্ন ইউনিয়নে দিনের বেলায় টহল দিলেও চুন্টা গ্রামের হিন্দুরা কেউ ভারত যায়নি। দিনের বেলা যুবক ও নারীরা লুকিয়ে থাকলেও কেউ গ্রাম ছাড়েনি। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ১৬ই অক্টোবর দুপুরে পাকবাহিনীর একটি দল চুন্টা গ্রাম ঘেরাও করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এ গ্রামের রাজাকার-দের সহযোগিতায় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। তখন চুন্টা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিল এমদাদুল হক টাক্কাবালী। সে শান্তি কমিটিরও চেয়ারম্যান ছিল। এই টাক্কাবালীর মদদ ও সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী চুন্টা গ্রামে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সেদিন মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন, পরিমল এবং লোপাড়ার বাদশা মিয়ার বাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হয়।
ঐদিন চুন্টা গ্রামের ২৫ জন নিরপরাধ মানুষ পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে। তারা সবাই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। পাকসেনারা ‘মালাউন ও ভারতের দালাল’ বলে তাদের কোমড়ে দড়ি বেঁধে সরাইল থানায় নিয়ে যায়। সেখানে দুদিন তাদের ওপর অকথ্য অত্যাচার ও নির্যাতন চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর জানতে চায়। তারপর ১৮ই অক্টোবর সকাল বেলা সবাইকে দড়ি দিয়ে বেঁধে সরাইল সদরের উত্তর দিকে কালীকচ্ছ ইউনিয়নের অন্তর্গত ধর্মতীর্থ খালের পাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে লাইন করে দাঁড় করিয়ে সকলকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে ঘটনাস্থলেই ২২ জন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তারা হলেন- যোগেশ চন্দ্র সেন (পিতা ভগবান চন্দ্র সেন), রমণীকান্ত সরকার (পিতা রজনীকান্ত সরকার), রণবীর সরকার (পিতা রমণীকান্ত সরকার), তরণী চন্দ্র ভট্টাচার্য (পিতা সুদর্শন ভট্টাচার্য), পরেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য (পিতা পীতাম্বর ভট্টাচার্য), ননীভূষণ বিশ্বাস (পিতা বরদাচরণ বিশ্বাস), পরেশ চন্দ্র বিশ্বাস (পিতা ননীভূষণ বিশ্বাস), ধীরেশ চন্দ্র বিশ্বাস (পিতা ননীভূষণ বিশ্বাস), সোনার চান বিশ্বাস (পিতা লাল চান বিশ্বাস), রূপচান বিশ্বাস (পিতা লাল চান বিশ্বাস), সুকুমার বিশ্বাস (পিতা ভগবান চন্দ্র বিশ্বাস), যতীন্দ্র চন্দ্র দাস (পিতা রাজেন্দ্র চন্দ্র দাস), মাখন চন্দ্র শুক্লাদাস (পিতা বঙ্কচন্দ্র শুক্লাদাস), দুর্যোধন নমঃশূদ্র (পিতা দুখাই নমঃশূদ্র), প্রসন্ন কুমার পাল (পিতা কৃষ্ণ চন্দ্র পাল), গোপাল চন্দ্ৰ পাল (পিতা ধনীরাম পাল), মরণ চন্দ্র পাল (পিতা গোপাল চন্দ্র পাল), ধীরেন্দ্র চন্দ্র পাল (পিতা গুরুচরণ পাল), অখিল চন্দ্র পাল, প্রফুল্ল চন্দ্র পাল (পিতা নবীন চন্দ্র পাল), সুধীর চন্দ্র দেব এবং কালাচান দেবনাথ (পিতা বলরাম দেবনাথ)। [মানবর্দ্ধন পাল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড