You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা নদী ও বাওড় অধ্যুষিত একটি এলাকা। এর উত্তরে আলমডাঙ্গা, পশ্চিমে মেহেরপুর ও দামুড়হুদা, দক্ষিণে দামুড়হুদা, জীবননগর ও ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর এবং পূর্বে ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর ও হরিণাকুণ্ডু উপজেলা। মাথাভাঙ্গা চুয়াডাঙ্গা জেলার প্রধান নদী। চুয়াডাঙ্গা শহর এ নদীর তীরে অবস্থিত। মাথাভাঙ্গার শাখা নদী নবগঙ্গা ও চিত্রা এ জেলার ওপর দিয়ে বহমান। দক্ষিণে বেগমপুর ইউনিয়নে কিছু বাওড় আছে। ১৯৭১ সালে বর্ষায় এ-সকল নদী ও বাওড় ছিল পানিতে থৈ-থৈ অবস্থা। ফলে মুক্তিযুদ্ধে তা মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল। নীলমণিগঞ্জ, সরোজগঞ্জ, হিজলগাড়ী ও ডিঙ্গেদহ বাজার এখানকার বর্ধিষ্ণু জনপদ।
ব্রিটিশ আমল থেকেই চুয়াডাঙ্গার লোকজন আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলন জোরালোভাবে শুরু হলে ২৩শে জানুয়ারি ভি জে স্কুলের ছাত্র মোহাম্মদ শাজাহান ও শিক্ষক রহমতুল্লাহ্ নেতৃত্বে এক বিরাট মিছিল বের হয়। মিছিল শেষে ওহিদ মিয়ার আমবাগানে মিটিং হয়। মিটিং-এ বক্তব্য দেন শাসদম চক্রবর্তী, আজিজুল হক, হাশেম মুক্তার, মোহাম্মদ শাজাহান প্রমুখ। ভাষা-আন্দোলনে চুয়াডাঙ্গার নারী সমাজও এগিয়ে আসে। রুবি, হেনা, মেন্টু, আনোয়ারা, বুলবুলি, পাখি, বেলা, পান্না প্রমুখ নারী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে গুলিবর্ষণের পর ২২শে ফেব্রুয়ারি ভি জে স্কুল মাঠে মিছিল শেষে এক প্রতিবাদ সভা হয়। ঐ সভায় সভাপত্বি করেন ডা. আসাবুল হক এবং বক্তব্য রাখেন ওহিদ হোসেন জোয়াদ্দার, মোহাম্মদ শাজাহান, হোসেন জোয়াদ্দার, মজিবর রহমান, মোহাম্মদ রফাতুল্লাহ, শেখ রহিম বকস্, ওয়ালিউল ইসলাম, ফয়জুর রহমান জোয়াদ্দার, মির্জা সুলতান রাজা, আব্দুল হান্নান জোয়াদ্দার, গোলাম কায়ুম জোয়াদ্দার, কামরুজ্জামান জোয়ার্দার, ভুলু মিয়া প্রমুখ। আওয়ামী লীগ-এর ৬-দফা ও ছাত্র সমাজের ১১-দফা দাবিনামাভিত্তিক রাজনীতিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে এখানে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, তাঁরা হলেন— ডা. আসহাবুল হক, এডভোকেট ইউনুস আলী, কলম আলী বিশ্বাস, ওয়াজেদ আলী বিশ্বাস, নজির আহমদ (দামুড়হুদা), ব্যারিস্টার বাদল রশীদ, সাফাতুেল ইসলাম, ডা. সাহাব উদ্দীন (আলমডাঙ্গা), কমরেড এডভোকেট শহিদুল ইসলাম (দর্শনা) ও কাজী কামাল (আলমডাঙ্গা)। এঁদের সঙ্গে ছিলেন সোলায়মান হক জোয়াদ্দার ছেলুন, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুর রাজ্জাক মালিক দুলু, জাহিদ হোসেন সন্তু, আলিউজ্জামান জোয়াদ্দার, নাসির উদ্দীন পেদু, রেজাউল করিম মুকুল, নুর-উল-ইসলাম মালিক, সিদ্দিক জামাল নান্টু, আব্দুল হান্নান, তৌহিদুল ইসলাম কচি, লিয়াকত আলী, আব্দুর রহমান জোয়াদ্দার লাল্টু, হাফিজুর রহমান জোয়াদ্দার প্রমুখ। মেয়েদের মধ্যে কলেজ ছাত্রী হানিফা খানম গোপা, দিলরুবা জেয়াদার, রেখা, ডেইজি, পুটি প্রমুখ জোরালো ভূমিকা রাখেন। এঁরা উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও ৭০-এর নির্বাচনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দিলরুবা জোয়াদ্দার ডা. আসহাবুল হকের জিপে মাইক বেঁধে নিজে গাড়ি চালিয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলার গ্রামেগঞ্জে তরুণ-তরুণীদের রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করেন। এখান থেকে ৭০-এর নির্বাচনে ব্যারিস্টার আফজালুর রশীদ ওরফে বাদল রশীদ জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) এবং ডা. আসহাবুল হক ও এডভোকে ইউনুস আলী প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপিএ) নির্বাচিত হন।
নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কাছে আদৌ কাম্য ছিল না। তাই তারা বিজয়ী আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে ষড়যন্ত্র শুরু করে। বঙ্গবন্ধু এটা বুঝতে পেরে ৭১-এর ৩রা জানুয়ারি আওয়ামী লীগ থেকে নব-নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটে এক সভা করেন। সভায় বঙ্গবন্ধু সার্বিক অবস্থা ব্যাখ্যা করে যে-কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সকলকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন।
অবশেষে ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হয় বটে, কিন্তু ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তা স্থগিত ঘোষণা করেন। সঙ্গে-সঙ্গে পূর্ববঙ্গের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। চুয়াডাঙ্গার বিক্ষুব্ধ জনতা রাস্তায় নেমে আসে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কোর্ট-কাচারি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ করে দিয়ে সর্বস্তরের পেশাজীবী মানুষ মিছিলে যোগ দেয়। চুয়াডাঙ্গা শহর সেদিন মিছিলের শহরে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ২রা মার্চ সান্ধ্য আইন ঘোষণা করা হলে তা অমান্য করে চুয়াডাঙ্গাবাসী রাস্তায় মিছিল করে। ৩রা মার্চ থেকে ৬ই মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। চুয়াডাঙ্গার বড়বাজারে মতিরাম আগরওয়ালার ঘরে কন্ট্রোল রুম চালু করা হয় এবং ঢাকা থেকে প্রাপ্ত খবরাদি মাইক যোগে প্রচার করা হয়। ৫ই মার্চ টাউন ফুটবল মাঠে এক বিশাল জনসভায় পাকিস্তানের পতাকা ও জিন্নাহ্ ছবি পোড়ানো হয়। এতে অংশ নেন আব্দুল আজিম জোয়াৰ্দ্দার শান্তি, দাউদ হোসেন জোয়াদ্দার পিপু, মতিয়ার রহমান মালিক ফিটু, এ ডি মালিক রবি, মাহমুদ হোসেন জোয়াদ্দার প্রমুখ।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ- চুয়াডাঙ্গাবাসী ৮ই মার্চ রেডিওতে শুনতে পায়। ভাষণ শোনার পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক চুয়াডাঙ্গা থানার প্রতিটি ইউনিয়নে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। চুয়াডাঙ্গা শহর সংগ্রাম কমিটির সভাপতি হন ডা. আসহাবুল হক এমপিএ এবং সদস্য হন এডভোকেট ইউনুস আলী এমপিএ, আবুল হাসেম মুক্তার, দোস্ত মোহাম্মদ আনছারী, মিসকিন আলী মিয়া, এডভোকেট জাকারিয়া, মির্জা সুলতান রাজা, আল্লা হাফিজ প্রমুখ। অপরদিকে ছাত্রলীগ নেতা আলীউজ্জামানকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এর সদস্যরা হলেন- সিদ্দিক জামান লাল্টু (ছাত্রলীগ), মো. মনিরুজ্জামান (ছাত্র ইউনিয়ন – মতিয়া গ্রুপ), আলী জাফর (ঐ), গোলাম সরোয়ার (ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ), আব্দুস সালাম (ঐ), জহিরুল হক (এনএসএফ) প্রমুখ।
২৩শে মার্চ চুয়াডাঙ্গা আওয়ামী লীগ অফিসে মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক বসে। বৈঠক চলাকালে আওয়ামী লীগের ঢাকা কেন্দ্রীয় অফিস থেকে টেলিফোনে সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ আসে। এদিন বিকেলে টাউন ফুটবল মাঠে চুয়াডাঙ্গা মহকুমা ছাত্রলীগ সভাপতি নুর-উল-ইসলাম মালিক ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিক জামাল লাল্টুকে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ডামি রাইফেল দিয়ে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। একই দিন চুয়াডাঙ্গা মহকুমা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় দিনব্যাপী রাজনৈতিক ঘটনা-প্রবাহ নিয়ে আলোচনা হয়। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সারাদেশে অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে নির্বিচারে মানুষ হত্যা শুরু করে। ঢাকার হত্যাকাণ্ডের খবর গভীর রাত্রেই চুয়াডাঙ্গা থানা থেকে অবহিত হয়ে রিকশা চালক আকবর আলী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে জানায়। একই সময় আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আসহাবুল হক এমপিএ টেলিফোনে ঢাকার খবর জানতে পারেন। চুয়াডাঙ্গা মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট ইউনুস আলী এমপিএ ইপিআর-এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা পান। ২৬শে মার্চ সকাল ৯টায় সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে চুয়াডাঙ্গা বড়বাজার চৌরাস্তার মোড়ে এক জনসভা হয়। ঐ সভায় ডা. আসহাবুল হক এমপিএ এক আবেগঘন বক্তব্য দেন। এ-সময় উত্তেজিত জনতা রাম দা ও লাঠি উঁচিয়ে পাকিস্তানি বাহিনিকে প্রতিরোধ করার শপথ নেয় এবং মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তোলে। তারপর চুয়াডাঙ্গার মানুষ গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে পাকিস্তানি সৈন্যদের চুয়াডাঙ্গায় প্রবেশ প্রতিহত করার উদ্যোগ নেয় এবং নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে। মাইকযোগে চুয়াডাঙ্গার সকল আনসার, মুজাহিদ, অবসরে থাকা পুলিশ, ইপিআর, আর্মিসহ ছাত্র-জনতাকে শহরে পাকস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয় ৷ শ্রীমন্ত টাউন হলে কন্ট্রোল রুম খোলা হয় এবং অন্যান্য থানা থেকে আগত সকল আনসার-মুজাহিদদের এখানে থাকা- খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ২৬শে মার্চ জনসভা থেকে একটি জঙ্গি মিছিল ঝিনাইদহ বাসস্ট্যান্ডে পৌছলে ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরী ইপিআর ৪নং উইং-এর সহকারী। অধিনায়কের নেতৃত্বে এক দল সদস্য নিয়ে ঐ মিছিলে যোগ দেন। ঐ সময় মেজর আবু ওসমান চৌধুরী কুষ্টিয়ায় ছিলেন। তিনি ও মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বীর বিক্রম সহ অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ব্যারিস্টার বাদল রশীদ এমএনএ, ডা. আসহাবুল হক এমপিএ, এডভোকেট ইউনুস আলী এমপিএ প্রমুখ নেতৃবৃন্দের কাছে স্বাধীনতার পক্ষে সংহতি ঘোষণা করেন। কুষ্টিয়া থেকে ফিরে ঐদিনই বিকেল বেলা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ এসোসিয়েশন হল (বর্তমান আলাউদ্দীন হল)-এ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে অফিসারবর্গ জরুরি বৈঠকে বসেন। ঐ বৈঠকে মেজর আবু ওসমান চৌধুরীকে অধিনায়ক, ব্যারিস্টার বাদল রশীদ এমএনএ ও এডভোকেট ইউনুস আলী এমপিএ-কে উপদেষ্টা এবং ডা. আসহাবুল হক এমপিএ-কে প্রধান উপদেষ্টা করে ‘বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন কমান্ড’ গঠন করা হয়। চুয়াডাঙ্গাকে কমান্ডের সদর দপ্তর ঘোষণা করা হয়। ঐ বৈঠকে কুষ্টিয়া দখলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
২৭শে মার্চ সকাল ১১টায় চুয়াডাঙ্গার ইপিআর হেডকোয়াটার্সে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে লাল-সবুজের মানচিত্রখচিত বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেখানে সরকারি কর্মকর্তাসহ আওয়ামী লীগের প্রায় ৪০ জন নেতা উপস্থিত থেকে সম্পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় পতাকা উত্তোলন করেন এবং ঐদিনই দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার বাদল রশীদ এমএনএ-কে বহির্বিশ্বে প্রচার, যোগাযোগ ও সহযোগিতা লাভের জন্য ভারতে প্রেরণ করা হয়। এদিন সন্ধ্যার পর দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের অন্যতম উপদেষ্টা এডভোকেট ইউনুস আলী এমপিএ দর্শনার অদূরে পশ্চিমবঙ্গের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান কর্নেল এইচ আর চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করেন এবং সাহায্য-সহযোগিতার বিষয়ে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা করেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহৃত মনোগ্রাম তৈরি করেন চুয়াডাঙ্গার পেশাদার ব্লক প্রস্তুতকারী এম এন সাহা। তাঁর প্রস্তুতকৃত সীল মোহর দ্বারা সীল মারা কাগজ যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পাসপোর্টের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
চুয়াডাঙ্গা সদরে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ছিল তিতুদহ ইউনিয়নের গড়াইটুপি গ্রামের আন্দোর আমবাগানে। এখানে গড়াইটুপি, খাড়াগোদা, খেজুরতলা, গোষ্ঠবিহার, কালোপোলসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহের প্রায় ১০০ জন যুবক অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে আকছেদ, ওয়াজেদ (বড়শলুয়া), মহব্বত (ফুলবাড়ীয়া), ওসমান আলী (বেগমপুর) প্রমুখ কমান্ডারের অধীনে যুদ্ধ করেন। গড়াইটুপির বারেরহাটে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং হতো। ট্রেনিং পরিচালনা করতেন বড়শলুয়ার আকছেদ আলী ও তাঁর দলের গেরিলারা তেঘরিয়া শালবাগান মাঠে রাতের অন্ধকারে পার্শ্ববর্তী গ্রামের যুবকরা মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবকরা ওসমান আলী, আকছেদ আলী, ওয়াজেদ আলী ও মহব্বত আলীর দলভুক্ত হয়ে যুদ্ধ করেন।
ওয়াড়ি-লক্ষ্মীপুর অস্থায়ী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পটি চুয়াডাঙ্গা থানা থেকে একটু দূরে কোটচাঁদপুর থানার মধ্যে ছিল। কমান্ডার ওয়াজেদ আলী (বড়শলুয়া) এটি স্থাপন করেন। চিত্রা নদীর তীরে মাঠের মধ্যে স্থাপিত এ ক্যাম্পে পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহের যুবকরা গভীর রাতে অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতেন। ক্যাম্পটি এক সময় পাকসেনারা ধ্বংস করে দিলেও আকছেদ আলি শিকারপুর থেকে বাছাই করা গেরিলাদের সহযোগে শিবনগর যুদ্ধে পাকসেনাদের পরাজিত করে ক্যাম্পটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন।
দত্তাইল হাসি খালের ধারে নির্জন মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ হতো। প্রশিক্ষক ছিলেন বিএলএফ কমান্ডার নুরুল ইসলাম মালিক, আইনাল হক (কিরণগাছী), ছমির উদ্দীন (খাসবাগন্দী), মতিয়ার রহমান (ফুলবাড়ীয়া) ও সাহাজদ্দিন (জালশুকা)। এখানে ১৫ জন গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন দলের হয়ে যুদ্ধ করেন।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কমান্ডাররা হলেন- হাফিজুর রহমান জোয়াদ্দার হাফিজ (পিতা আজিবর রহমান, ফার্মপাড়া পূর্বনিবাস বটিয়াপাড়া, আলমডাঙ্গা; বিএলএফ কমান্ডার), আজম আক্তার জোয়াদ্দার পিনটু (পিতা এডভোকেট আক্তার হোসেন), শফিউদ্দীন মোংলা (পিতা মকছেদ আলী মণ্ডল, জেনতলাপাড়া; মুজাহিদ, যুদ্ধের সময় কালু শেখের দলে ছিলেন; সহকারী কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন), ওয়াজেদ আলী (পিতা ইমান আলী, বড়শলুয়া; খুবই সাহসী যোদ্ধা ও দক্ষ কমান্ডার ছিলেন; ওয়াড়ি-লক্ষ্মীপুর যুদ্ধে তিনি চিত্রা নদী সাঁতরে পার হয়ে বুক পানিতে দাঁড়িয়ে এলএমজি ফায়ার দিয়ে নিজ দলকে এগিয়ে নিয়ে নিরাপদে পৌঁছান), আকছেদ আলী (পিতা সৈয়দ আলী মণ্ডল, বড়শলুয়া; পেশায় আনসার; শিবনগর যুদ্ধে পাকসেনাদের পরাজিত করে চিত্রা নদীর ধারে ওয়াড়ি-লক্ষ্মীপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ক্যাম্প ও ট্রেনিং সেন্টার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন), মহব্বত আলী (পিতা বদর উদ্দীন, ফুলবাড়ীয়া; সেনাবাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং বানপুর একশন ক্যাম্প থেকে চুয়াডাঙ্গা সদর থানা, কোটচাঁদপুর, হরিণাকুণ্ডু, ঝিনাইদহ ও মহেশপুর থানা এলাকায় যুদ্ধ করেন), ওসামন আলী (পিতা সালামত সরকার, বেগমপুর; পূর্বপুরুষের নিবাস ছিল কুমিল্লার মতলব থানায়; তাঁর কাছে বেগমপুর, দর্শনা, শংকরচন্দ্র ও তিতুদহের অনেক রাজাকার আত্মসমর্পণ করে; মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর দল ‘১১ ভাই’ নামে পরিচিত ছিল), আব্দুস শুকুর বাঙালী (পিতা আফিল উদ্দীন, কুলচরা; তিনি চুয়াডাঙ্গা সদর, দামুড়হুদা, আলমডাঙ্গা, হরিণাকুণ্ডু, কোটচাঁদপুর, ঝিনাইদহ ও জীবননগর এলাকায় যুদ্ধ করেন; ১৪ই আগস্ট আলমডাঙ্গা থানার খাসকররা বাজারে চৌরাস্তার মোড়ে উঁচু অশ্বত্থ বৃক্ষে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন), কালু শেখ (পিতা আফছার আলী শেখ, পুরাতন বাগানপাড়া; দর্জির পেশা ছেড়ে মুজাহিদ ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন; হাটখোলা বর্ডারে তিনি যুদ্ধ করেন) এবং আরশেদ আলী (পিতা লস্কর আলী, পিরপুর আলুকদিয়া; দর্শনা কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় যুদ্ধে যান এবং ১৫ জনের একটি গ্রুপের কমান্ডার হিসেবে দেশে প্রবেশ করেন; গোকুলখালি ও বোরিখখালী যুদ্ধের পর আলমডাঙ্গা থানার আলিনগর শীবপুরে এসে অস্ত্রসহ পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন এবং আর্মি ক্যাম্পে বন্দি থাকেন; দর্শনা আর্মি ক্যাম্প থেকে পালাতে সক্ষম হন এবং পুনরায় পিরপুর-উজিরপুর যুদ্ধে যোগ দেন)।
২৭শে মার্চ দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গাকে রক্ষার জন্য সব রকম প্রস্তুতি নেয়া হয়। কুষ্টিয়া- চুয়াডাঙ্গা ও যশোর-চুয়াডাঙ্গা রেল লাইন উপড়ে ফেলা হয়। গাছ কেটে ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা, কালীগঞ্জ-চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর- চুয়াডাঙ্গা সড়কে ফেলে রাস্তা বন্ধ করা হয়। কুষ্টিয়া আক্রমণের প্রস্তুতির উদ্দেশ্যে ডা. আহসাবুল হক মাইক যোগে জেলার আলোকদিয়া, ডিঙ্গেদহ, সরোজগঞ্জ, হিজোলগাড়ী, দর্শনা, মুন্সিগঞ্জ, আলমডাঙ্গা, খাসকররা বাজার, আসমানখালী বাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় লোক মারফত সকল আনসার, মুজাহিদ, অবসরে যাওয়া পুলিশ, ইপিআর, আর্মি ও ছাত্র-জনতাকে আহ্বান করেন। আনসার ও মুজাহিদদের প্রশিক্ষণের জন্য সংরক্ষিত অস্ত্র চুয়াডাঙ্গা অস্ত্রাগার থেকে তাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। চুয়াডাঙ্গার ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদসহ ছাত্র-যুবকদের বিশাল এক বাহিনী মুন্সিগঞ্জ-আলমডাঙ্গা হয়ে পোড়াদহ আইলচরা গ্রামে অবস্থান নেয়। আইলচরায় একদিন অবস্থানকালে আইলচরা মাদ্রাসা মাঠে তারা তাদের আগাম জানাযা নামাজ আদায় করে। জানাযা শেষে তারা ৩০শে মার্চ ভোর ৪.৪৫ মিনিটে কুষ্টিয়া জেলা স্কুল ও পুলিশ লাইন্সে অবস্থিত পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর আক্রমণ করেন। পাবনা ও রাজবাড়ী থেকেও প্রতিরোধ যোদ্ধারা এসে কুষ্টিয়া মোহিনী মিলে অবস্থিত পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর ত্রিমুখী আক্রমণ শুরু করেন। তুমুল যুদ্ধের পর কুষ্টিয়া শহরে পাকিস্তানি আর্মি পরাজিত হয়। এরপর চুয়াডাঙ্গা থেকে আগত প্রতিরোধ যোদ্ধারা তিন দিকে ভাগ হয়ে যান। এক ভাগ উত্তর-পশ্চিম দিকে গিয়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজে পাকআর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, অন্যভাগ গড়াই নদী পার হয়ে হরিপুর হয়ে পাবনার দিকে অগ্রসর হয় এবং বড় অংশটি ঝিনাইদহ পার হয়ে বিষয়খালীতে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বিষয়খালী প্রতিরোধযুদ্ধকালে চুয়াডাঙ্গা রেল স্টেশনে সৈয়দপুর থেকে এক মালবাহী ট্রেনের ওয়াগনে ১০-১২ জন মানুষের খণ্ডখণ্ড লাশ দেখা যায়। শহর থেকে বিপ্লবী জনতা রেল স্টেশন ঘেরাও করে খুলনাগামী মালগাড়ি আটক করে স্টেশন মাস্টারের কাছে এর জবাব চায়। স্টেশন মাস্টার সৈয়দপুরে যোগাযোগ করলে সেখানকার স্টেশন মাস্টার জানায়- সৈয়দপুরের বিহারিরা সেখানকার আওয়ামী লীগের ১০-১২ জন শীর্ষস্থানীয় নেতার লাশ কেটে ওয়াগনে ভর্তি করে গাড়ি ছাড়তে বাধ্য করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উত্তেজিত জনতা অবাঙালি বিহারিদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। এ আক্রমণে চুয়াডাঙ্গা শহরের উপকণ্ঠে ডিঙ্গেদহ বাজার এলাকার বিহারি পল্লিতে ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কয়েকশ বিহারিকে হত্যা করে বর্তমান ঈদগাহ ও আখসেন্টারে নবগঙ্গা নদীর তীরে পুঁতে রাখা হয়। নফরকান্দি ও খেজুরার বিহারিদেরও নদীর অপর পাড়ে বর্তমান ইউনিয়ন কাউন্সিলের ওখানে হত্যা করে পুঁতে রাখা হয়। দর্শনার বিহারিদের এক দলকে ভালাইপুরে হত্যা করে পুঁতে রাখে বিপ্লবী জনতা। যুদ্ধে আহতদের সেবার জন্য ২৭শে মার্চ চুয়াডাঙ্গায় বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর দায়িত্বে ছিলেন ডা. আসহাবুল হক এমপিএ, এডভোকেট ইউনুস আলী এমপিএ, ডা. সামসুজ্জোহা কোরেশি, ডা. সাইদুর রহমান ও ডা. সাহাবুদ্দীন (আলমডাঙ্গা)।
২৭শে মার্চ কুষ্টিয়ার সঙ্গে টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে চুয়াডাঙ্গাকে প্রধান টেলিফোন এক্সচেঞ্জে পরিণত করা হয়। বহির্বিশ্বে যোগাযোগের জন্য ‘জয় বাংলা’ কোড স্থাপন করা
হয়। ঐদিনই টেলিফোনে ডা. আসহাবুল হক এমপিএ কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। টেলিফোন লাইনের কাজে দায়িত্ব পালন করে এক্সেঞ্জের অপারেটর ফকির মোহাম্মদ এবং লাইনম্যান পরিতোষ কুমার। এদিন চুয়াডাঙ্গার মাচলিয়া বিওপি-তে চুয়াডাঙ্গা ইপিআর ৪ উইং-এর অবাঙালি ক্যাপ্টেন সাদেক যশোর সেনানিবাস থেকে সৈন্য নিয়ে বাঙালি ইপিআর-দের নিরস্ত্র করার জন্য আক্রমণ করে। বাঙালি-অবাঙালিদের এ-যুদ্ধে বাঙালি সেনা আশরাফ শহীদ হন। যুদ্ধে অবাঙালি ইপিআর- রা পরাজিত হয় এবং তিনজন সঙ্গীসহ ক্যাপ্টেন সাদেক নিহত হয়।
কুষ্টিয়া প্রতিরোধযুদ্ধ চলাকালে আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও পরবর্তীতে গঠিত (১০ই এপ্রিল) মুজিবনগর সরকার-এর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ- এবং ৭০- এর নির্বাচনে কুষ্টিয়া থেকে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ঢাকা থেকে ফরিদপুর- মাগুরা-ঝিনাইদহ হয়ে ভারত গমনের সময় মুক্ত এলাকা চুয়াডাঙ্গায় আসেন। চুয়াডাঙ্গায় তাঁরা একদিন যাত্রাবিরতি করেন। মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর বাসায় তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ২৯শে মার্চ তাঁরা মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, ব্যারিস্টার বাদল রশীদ এমএনএ, ডা. আসহাবুল হক এমপিএ, এডভোকেট ইউনুস আলী এমপিএ-সহ স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে পরপর তিনটি বৈঠক করেন। প্রথম বৈঠকে চুয়াডাঙ্গার সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন। দ্বিতীয় বৈঠকে নির্বাচিত ৩ জন জনপ্রতিনিধিসহ সামরিক অফিসারবর্গ এবং ৩য় বৈঠকে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ও শিলাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। প্রথম বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ চুয়াডাঙ্গাকে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাজধানী ঘোষণা করেন এবং নির্মাণাধীন চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের অংশবিশেষ এর কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হবে বলে উল্লেখ করেন।
৩০শে মার্চ তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বেলা ৩টার দিকি চেংখালী বর্ডার হয়ে ভারত গমন করেন। আবু ওসমান চৌধুরী ও মাহবুবউদ্দিন আহমেদ তাদের পৌঁছে দেন। বিএসএফ-এর আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার হাই কমান্ডের নির্দেশে অভিবাদনসহ তাঁদের গ্রহণ করেন। ১লা এপ্রিল গোলক মজুমদার ও বিএসএফ-এর প্রধান রুস্তমজী গোয়েন্দা ও সাংবাদিকদের নজর এড়িয়ে তাজউদ্দীন আহমদকে ‘মোহাম্মদ আলী’ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে ‘রহমত আলী’ ছদ্মনামে একটি মালবাহী বিমানে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী-র সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য দিল্লি নিয়ে যান। ২রা এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ৫ই এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ ভারতীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে জীবননগর সীমান্তে আসেন। মেজর আবু ওসমান চৌধুরী সেখানে যান এবং যশোর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ ও যুদ্ধের অন্যান্য দিক নিয়ে আলোচনা করেন।
১০ই এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ শিলিগুড়ির অনতিদূরে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি এক স্থান থেকে ভারতীয় সময় রাত সাড়ে ৯টায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার-এর মন্ত্রিসভা ঘোষণা করেন। সরকারের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। সিদ্ধান্ত হয়, ১৪ই এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হবে পূর্বে ঘোষিত স্বাধীন বাংলার প্রথম রাজধানী চুয়াডাঙ্গায়। সংবাদটি গোপন রাখার কথা ছিল, কিন্তু ডা. আসহাবুল হক এমপিএ অতিআনন্দে বিদেশী সাংবাদিকদের নিকট তা প্রকাশ করেন। ফলে ১৩ই এপ্রিল পাকিস্তানি আর্মি যশোর সেনানিবাস থেকে এসে চুয়াডাঙ্গায় বোম্বিং করে। তাই নিরাপত্তার কারণে অনুষ্ঠানটি পরবর্তীতে ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা (বর্তমানে মুজিবনগর)-র আম্রকাননে অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীদের গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে চুয়াডাঙ্গা জেলার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। তাঁদের মধ্যে প্রধান নেতৃবৃন্দ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর সীমান্ত পার হয়ে বেতাই লাল বাজারে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণ ক্যাম্প তৈরি করেন। পরে ডোমপুকুর, মাঝদিয়া, ভজনঘাট, করিমপুর, জামসেদপুর ও কড়ইগাছিতে অভ্যর্থনা ও প্রশিক্ষণ ক্যাম্প তৈরি করা হয়। এসব ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুট করে উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। চুয়াডাঙ্গা থানার অধিকাংশ নেতা ডোমপুকুর যুবশিবিরে অবস্থান নেন। এ ক্যাম্পটি পরিচালনা করতেন এডভোকেট ইউনুস আলী এমপিএ, মির্জা সুলতান রাজা, এডভোকেট জাকারিয়া, ইনসান মৃধা, বাবর আলী খান এবং আব্দুর রফিক মাস্টার। ভারতের সীমান্তে হাটখুলা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি মিনি একশন ক্যাম্প খোলা হয়।
এখান থেকে চুয়াডাঙ্গা, দামুড়হুদা ও আলমডাঙ্গাসহ পার্শ্ববর্তী থানাসমূহের মুক্তিযোদ্ধাদের গাইড করে বিভিন্ন স্থানে আক্রমণের জন্য পাঠানো হতো। ক্যাম্পটি পরিচালনা করতেন সোলায়মান হক জোয়াদ্দার ছেলুন।
বিষয়খালীতে ব্যাপক আক্রমের মুখে টিকতে না পেরে পাকবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। ৩রা এপ্রিল তারা যশোর থেকে এসে চুয়াডাঙ্গায় নাপাম বোমা নিক্ষেপ করে। ১৩ ও ১৪ই এপ্রিল বোম্বিং আরো জোরদার করা হয়। ১৩ই এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা হাসপাতাল, বড়বাজার চৌরাস্তার মোড়, রেল স্টেশন, পুরাতন ইপিআর ক্যাম্প, ন্যাশনাল ব্যাংক ও গার্লস স্কুলের সম্মুখে বোম্বিং হয়। ১৪ই এপ্রিল তারা চুয়াডাঙ্গা দখল করে। আসার পথে সরোজগঞ্জ বাজারে হাট চলা অবস্থায় হানাদার বাহিনী এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ৪৫ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। সরোজগঞ্জ বাজার পার হয়ে ডিঙ্গেদহ বাজারে এসে পাকবাহিনী এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ৮-১০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে এবং ১০-১৫টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। পাকসেনারা চুয়াডাঙ্গা দখলের পর ১৪ই এপ্রিল থেকে ১৯শে এপ্রিল পর্যন্ত গণহত্যা চালায় ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। বিমান হামলায় শহর ও আশপাশের গ্রামের শতাধিক লোক নিহত হয় এবং পৌরসভা, দৌলতদিয়াড়, হাতিকাটা, ডিঙ্গেদহ, নুরনগরসহ আশপাশের গ্রামসমূহে বহু ঘরবাড়ি ভস্মীভূত হয়।
পাকসেনারা সদর হাসপাতালে ক্যাম্প স্থাপন করে। রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল ঘোড়ামারা ব্রিজ, রেলের পাঁচ পকেট (নবগঙ্গা রেল ব্রিজ), হৈদুরপুর ব্রিজ (ছাগলা ব্রিজ), মাথাভাঙ্গা ব্রিজ, চুয়াডাঙ্গা থানা, সরোজগঞ্জ বাজার, নীলমণিগঞ্জ বাজার এবং ন্যাশনাল (বর্তমান সোনালী) ব্যাংকে। পৌরসভার বাইরে পাকসেনাদের ক্যাম্প ছিল হিজলগাড়ী বাজার ও খাড়াগোদা ব্রিজে। সরোজগঞ্জ বাজার রাজাকার- ক্যাম্পে পাকসেনারা এসে মাঝে-মধ্যে অবস্থান করত। নীলমণিগঞ্জ বাজারে রাজাকারদের ক্যাম্পটি খুব শক্তিশালী ছিল। দোস্ত গ্রাম ও বেগমপুরের রাজাকাররা হিজলগাড়ী বাজারে থাকত। বড়শলুয়া ও ছোটশলুয়া গ্রামের রাজাকাররা নিজ-নিজ বাড়িতে থাকত এবং প্রত্যেক দিন হিজলগাড়ী বাজারে গিয়ে পাকসেনাদের হুকুমমতো বাঙ্কার খুঁড়ত।
চুয়াডাঙ্গার ঐতিহ্যবাহী মল্লিক পরিবারের সন্তান ডা. আব্দুল মুত্তালিব মালিক (পিতা আতাহার হোসেন মল্লিক, চুয়াডাঙ্গা) যুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিশেষ উপদেষ্টা ছিল। ৩১শে আগস্ট উপদেষ্টা পদের পরিবর্তে তাকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। গভর্নর থাকাকালে সে বিভিন্ন স্থানে জনসভা ও হলরুমে বক্তব্য দিয়ে এবং সরকারি নির্দেশনা জারি করে পাকসেনা, রাজাকার, আলবদর- ও আলশামস-দের মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভন্ডুল করতে উৎসাহিত করে। মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় ও পাকহানাদারদের পরাজয়ের ২ দিন পূর্বে ১৪ই ডিসেম্বর সে গভর্নরের পদ ত্যাগ করে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে আশ্রয় নেয়। ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা তাকে এখান থেকে গ্রেফতার করেন।
আব্দুল মুত্তালিব পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করলে চুয়াডাঙ্গার নওয়াজেস আহমেদ উকিল (পিতা মনির উদ্দীন) মন্ত্রিসভায় খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী নিযুক্ত হয়। সেও বিভিন্নভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও আলবদরদের সহায়তা করে এবং স্বাধীনতার চরম বিরোধী ভূমিকা পালন করে। ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় সেও গ্রেফতার হয়।
৭ই ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা মুক্ত এবং ১১ই ডিসেম্বর মোস্তফা আনোয়ারকে মহকুমা প্রশাসক নিযুক্ত করে বেসরকারি প্রশাসন চালু হলে বেশকিছু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দালালকে মুক্তিযোদ্ধারা বন্দি করে চুয়াডাঙ্গা থেকে কুষ্টিয়া জেল হাজতে পাঠান। তারা হলো- গিয়াস উদ্দীন আনছারী, সিরাজুল ইসলাম মল্লিক (চুয়াডাঙ্গা পৌরসভা; ১০ই ডিসেম্বর গ্রেফতার), মুন্সি সামসুজ্জোহা (বুজরুক গড়গড়ি পৌরসভা; ঐ), আফছার উদ্দীন (কোর্টপাড়া; ঐ), ইয়াকুব হোসেন (কোর্টপাড়া; ঐ), এস এম আজিজুল হক (কোর্টপাড়া; ঐ), তুফান শেখ (কোর্টপাড়া; ঐ), তুফাজ্জেল হোসেন (মালোপাড়া পৌরসভা; ঐ), গোলাম নবী মল্লিক (আরামপাড়া; ঐ), ফয়েজ উল্লাহ শেখ (বালিয়াপাড়া; ঐ), আশরাফ আলী (চুয়াডাঙ্গা; ঐ), মো. ইউনুচ (চান্দমারী পাড়া; ঐ), ওয়াদুদ হোসেন (মল্লিকপাড়া), মওলা বকস (মালোপাড়া), আবুল কালাম আজাদ (বড়বাজার; ২৭শে ডিসেম্বর গ্রেফতার), আব্দুল আজিজ বিশ্বাস (হাসপাতাল পাড়া; ঐ), আজগর আলী এডভোকেট (২৮শে ডিসেম্বর গ্রেফতার), আব্দুল হান্নান (২৯শে ডিসেম্বর গ্রেফতার), নাসির খান (চুয়াডাঙ্গা; ৩০শে ডিসেম্বর গ্রেফতার), রোকেয়া খাতুন (চুয়াডাঙ্গা; ১০ই ডিসেম্বর গ্রেফতার), আকালি সর্দার (চুয়াডাঙ্গা; ১৭ই জানুয়ারি ১৯৭২ গ্রেফতার), আত্তাব শেখ (রেলওয়ে কলোনি; শ্রমিক, চাপড়া, যশোর; ৩০শে ডিসেম্বর গ্রেফতার), সৈয়দ নুরুল ইসলাম (চুয়াডাঙ্গা; এডিসিডব্লিউডি, কুমিল্লা; ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ গ্রেফতার) ও আব্দুল মজিদ (বুজরুক গড়গড়ি; ১০ই ডিসেম্বর গ্রেফতার)। এছাড়া আরো কিছু স্বাধীনতাবিরাধী হলো- বাগানপাড়ার শাহাদত কাঁঠাল, আয়ুব কাঁঠাল, আহম্মদ দর্জি, আব্দুল হামিদ, ইউনুচ আলী, কানু কাঁঠাল, আশরাফ আলী, আনছার আলী লতু; ভি জে স্কুল পাড়ার খোদন, মন্টু, টুনু; জেনতলাপাড়ার সব্বত আলী, সাইদুর রহমান মল্লিক, মজিবর রহমান মল্লিক; রেলপাড়ার আনিছুল কাদের মল্লিক, ওবেদুল আলম মল্লিক, নুরুল হক জোয়াদ্দার, ফতে আলী; গোরস্থানপাড়ার সাবদাল আলি, গোলাম নবী মল্লিক; বেলগাছির কিছমত আলী, ঝিনাইদহ বাসস্ট্যান্ড পাড়ার হাবিবুর রহমান হবি, ইনামুল হক মল্লিক; মসজিদ পাড়ার সাহাব উদ্দীন টেংরা, মজিব ভাটা; কোর্টপাড়ার গোলাম রহমান, নজরুল; সিনেমা হল পাড়ার ডা. মফিজ উল্লাহ চৌধুরী, আব্দুস সাত্তার, চৌধুরী মনিরদ্দীন মাহফুজ মুক্তা; কলেজপাড়ার গোলাম আনছারী; শেখপাড়ার এস এন রাইহান উদ্দীন এবং পোস্ট অফিস পাড়ার মোজাম্মেল হক ওরফে বঙ্গজ মোজাম্মেল।
বেগমপুর ইউনিয়নের শান্তি কমিটির সদস্য, দালাল ও রাজাকাররা হলো- শাহাদত আলী মুন্সি (বেগমপুর, ১০ই ডিসেম্বর গ্রেফতার), নুরুল ইসলাম (জদুপুর, ঐ), ইউনুচ আলী বাকাইল (বেগমপুর, ঐ), আব্দুল মজিদ (কোটালী ঐ), আজিজুল ইসলাম (বোয়ালিয়া; তৎকালীন বেগমপুর ইউপি চেয়ারম্যান, ঐ), হারান আলী (বলদিয়া; ঐ), ইবাদত আলী (জদুপুর; ৭ই জানুয়ারি ১৯৭২ গ্রেফতার), জয়নাল (খোরশেদপুর), রব (দস্তি), লাল হিজলগাড়ী, দিনু হিজলগাড়ী, খুয়াজ (খোরশেদপুর) প্রমুখ।
আলোকদিয়া ইউনিয়নের রাজাকাররা হলো- হামিদ আলী (দৌলতদিয়াড়; ১০ই ডিসেম্বর গ্রেফতার), সুরতর আলী (দৌলতদিয়াড়; ১৪ই জানুয়ারি ১৯৭২ গ্রেফতার), ছালামতুল্লাহ, মুসা আলী, মতলেব, এরেং মণ্ডল, হাশেম আলী, কাশেম, বুদুই মণ্ডল, পুতলে, দিনু, মুনাজাত (এরা সকলে দৌলতদিয়াড়-এর অধিবাসী) ও আকবর আলী বিশ্বাস (আলুকদিয়া; শান্তি কমিটির সদস্য)।
তিতুদহ ইউনিয়নের শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা হলো- আব্দুল কাইয়ুম (বড়শলুয়া; ডিসেম্বরে গ্রেফতার), আব্দুল গফুর (বড়শলুয়া; ৭ই জানুয়ারি ১৯৭২ গ্রেফতার), নুরু মিয়া (খেজুরতলা), আব্দুল মোতালেব (খেজুরতলা), শফিউদ্দীন (খেজুরতলা), আরমান আলী (জামালপুর), সাকের আলী (খাড়াগোদা), আব্দুল মোল্লা (বঙ্কিরা), আব্দুল জলিল (গোবরগাড়া), সাদেক আলী (খাড়াগোদা) ও কাশেম মোল্লা (তিতুদহ)।
পদ্মবিলা ইউনিয়নের শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা হলো- আকবর আলী (শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, ডিঙ্গেদহ বাজার), ওলি (খেজুরা), সুরত আলী (খেজুরা), নজরুল (খেজুরা), (খেজুরা), জিন্নাথ (খেজুরা), ছলিমুল্লাহ (নফরকান্দি), ছাত্তার খলিফা (নফরকান্দি) ও খোয়াজ মাস্টার (নফরকান্দি)।
কুতুবপুর ইউনিয়নের শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা হলো- গোলাম কিবরিয়া (মোহাম্মদজমা; ১০ই ডিসেম্বর গ্রেফতার), গোলাম রসুল (মোহাম্মদজমা; ১০ই ডিসেম্বর গ্রেফতার), আজিজুল হক (পিতা ইউসুফ আলী ওরফে খেঁচো ডাক্তার, মোহাম্মদজমা; রাজাকার প্রধান ও খুবই হিংস্র ছিল), খন্দকার মইন উদ্দীন (মোহাম্মদজমা), শুকুর খন্দকার (মোহাম্মদজমা), ওয়াজেদ (মোহাম্মদজমা), নুরুন্নবী (মোহাম্মদজমা) ও মফিজুল ইসলাম (সরোজগঞ্জ বাজার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান)।
শংকরচন্দ্র ইউনিয়নের শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা হলো- খোসাল উদ্দীন (ছয়ঘরিয়া; ৩০শে ডিসেম্বর গ্রেফতার), কাশেম (ছয়ঘরিয়া), মোবারক আলী (বোয়ালিয়া), গণি (বোয়ালিয়া), ফকির মোহাম্মদ (বোয়ালিয়া), আফজেল মণ্ডল (বোয়ালিয়া), মিয়াজান (বোয়ালিয়া) ও জাহাবকস (বোয়ালিয়া)।
মোমিনপুর ইউনিয়ন শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা হলো- নাজিম উদ্দীন (আমিরপুর; ১৯শে জানুয়ারি ১৯৭২ গ্রেফতার), এম এ ওয়াহেদ হোসেন (বোয়ালমারি; ২৮শে ডিসেম্বর গ্রেফতার), আফতাব আলী শেখ (মোমিনপুর, ১০ই ডিসেম্বর গ্রেফতার), জাফর খন্দকার (শরিষাডাঙ্গা), মুনসুর আলী (মোমিনপুর), আজগর আলী (আমিরপুর), দিদার (কাথুলী), কুতুব উদ্দীন (বোয়ালমারি), কেছমত আলী (বোয়ালমারি), লিয়াকত (বোয়ালমারি), আফতাব উদ্দীন (চুয়াডাঙ্গা), ওয়াহেদ হোসেন (পিতা জব্বার খাঁ, বোয়ালমারি; শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), রহমান মল্লিক (নীলমণিগঞ্জ), আফতাব উদ্দীন (মোমিনপুর), আলাউদ্দীন মিয়া (নীলমণিগঞ্জ; ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা ও পাকিস্তানিদের পক্ষে যোগ দেয়; নীলমণিগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত)।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চুয়াডাঙ্গা শহর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহের অধিকাংশ মানুষ বাড়িঘর ত্যাগ করে ভারতে চলে যায়। যারা থেকে যায়, শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালায়। তারা অনেক মহিলাকে ধর্ষণ করে। এরূপ নির্যাতিতা মহিলা চুয়াডাঙ্গা শহর, দৌলতদিয়াড়, হাতিকাটা, ডিঙ্গেদহ, হিজলগাড়ী, নীলমণিগঞ্জ, সরোজগঞ্জ সর্বত্র রয়েছে। ঝিনাইদহ জেলার গিরিশনগর ক্যাম্প থেকে পাকসেনারা এসে খেজুরতলায় ৪ জন নারীকে ধর্ষণ করে। বেগমপুর ইউনিয়নের ২ জন নারী পাকসেনাদের দ্বারা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল ক্যাম্প ছিল পাকসেনাদের নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের এখানে ধরে এনে বন্দি করে রাখা হতো এবং নির্যাতন করা হতো। কাউকে-কাউকে হত্যা করে হাসপাতালের দক্ষিণ পাশের নিচু মাঠের মধ্যে ফেলে দেয়া হতো।
চুয়াডাঙ্গা সদর থানার মধ্যে পাকসেনা ও রাজাকারদের বেশ কয়েকটি ক্যাম্প ছিল। তার মধ্যে বর্তমান সদর হাসপাতালে পাকসেনাদের ক্যাম্পের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি নিচু মাঠ ছিল। চুয়াডাঙ্গা জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সংগঠকদের পাকসেনারা গ্রেফতার করে এ ক্যাম্পে এনে অকথ্য নির্যাতন করত। তারপর তাদের হত্যা করে হাসপাতালের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের ঐ মাঠে গণকবর দিত। থানার পশ্চিমে মাথাভাঙ্গা নদীর তীরেও গণকবর রয়েছে। পাকসেনা ও রাজাকাররা কখনো কখনো সাধারণ মানুষকে হত্যা করে এখানে কবর দিত। এছাড়া হৈদরপুর (ছাগলা ব্রিজ)-এও একটি গণকবর রয়েছে।
৩রা জুলাই মুক্তিযোদ্ধারা চুয়াডাঙ্গা-দর্শনা সড়কে এন্টিট্যাঙ্ক মাইন স্থাপন করে পাকিস্তানি সৈন্যদের দুটি ট্রাক উড়িয়ে দেন। এ দলে ছিলেন রহমান জোয়াদ্দার হাফিজ, বারেক সিকদার ও হুমায়ুন কবির (কবিখালী)। ১৭ই জুলাই মুক্তিযোদ্ধারা নীলমণিগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের মাঝামাঝি স্থানে এন্টিট্যাঙ্ক মাইন স্থাপন করে পাকিস্তানি সৈন্যদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ বহনকারী একটি ট্রেন উড়িয়ে দেন। এতে অনেক পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
৩১শে আগস্ট ৭ জন পাকিস্তানি সৈন্য নৌকায় মাথাভাঙ্গা নদী পার হওয়ার সময় নৌকার মাঝি হাটকালুগঞ্জ গ্রামের নিকট নৌকা ডুবিয়ে ৭ জনকেই মেরে ফেলে। ৪ঠা সেপ্টেম্বর আব্দুল মাবুদ জোয়াদ্দার ও আব্দার আলী চুয়াডাঙ্গা টেলিফোন এক্সচেঞ্জে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে এক্সচেঞ্জ বিকল করে দেন। এ গ্রেনেড হামলায় বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত ও কয়েকজন আহত হয়।
কালুপোল কেটের মাঠ যুদ্ধ সংঘটিত হয় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে। সরোজগঞ্জ বাজার থেকে একদল রাজাকার পাকসেনাদের সঙ্গে নিয়ে কালুপোল বাজারে আসে। সে-সময় গোষ্ঠবিহার, ছয়ঘরিয়া, গড়াইটুপি, খেজুরতলা প্রভৃতি গ্রামে আব্দুস শুকুর বাঙালি (কুলচরা), আকছেদ আলী (বড়শলুয়া), ওয়াজেদ আলী (বড়শলুয়া), উসমান আলী (বেগমপুর), সেনাবাহিনী থেকে আসা সাইদুর রহমান সান্দার প্রমুখ কমান্ডারের মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করছিলেন। কালুপোল বাজারে পাকসেনা দেখে তাঁরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কেটের মাঠে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকসেনারা মুখোমুখি হয়। উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ বাঁধে। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের ঘিরে ফেললে তারা সরোজগঞ্জের দিকে পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে ৮ জন পাকসেনা নিহত হয়।
১২ই সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা মুসলিম লীগ নেতা মুজাম্মেল হকের পেট্রল পাম্প ও পুরাতন কৃষি ব্যাংকের সামনের রাস্তার লাইট পোস্ট মাইন বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেন এবং শহরের দালালদের বাড়িতে আক্রমণ চালান। এতে পাকসেনা ক্যাম্পে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। এ আক্রমণটি পরিচালনা করেন কমান্ডার হাফিজুর রহমান জোয়াদ্দার, আজম আক্তার জোয়াদ্দার ও মতিয়ার রহমান মন্টুর দল মিলে প্রায় ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধা। জদুপুর ও আনছারবাড়ীয়ার মাঝামাঝি ডুমুরিয়া খালে রাজাকারদের সঙ্গে কমান্ডার ওসমানের ১১ ভাই দলের সঙ্গে যুদ্ধে কয়েকজন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে এবং বাকিরা আনছারবাড়ীয়ার দিকে পালিয়ে যায়।
১লা অক্টোবর চুয়াডাঙ্গা সদর থানার জালশুকায় পাকসেনা ক্যাম্পে কমান্ডার ওয়াজেদ আলী, মহব্বত আলী, উসমান আলী ও নুরুল ইসলাম মালিকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল আক্রমণ করে ৫ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করে। যুদ্ধ ১ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। ভারী অস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছিয়ে যান।
১৯শে অক্টোবর চাঁদপুর শৈলগাড়ি মাঠে মুক্তিযোদ্ধা আশু বাঙালীর দলের সঙ্গে পাকসনা ও রাজাকারদের তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে শৈলগাড়ি গ্রামে ৩ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে মাথাভাঙ্গা নদীর এপার-ওপার পিরপুর ও উজিরপুর গ্রামে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে ইউনুচ আলী (পিতা এরশাদ আলী মণ্ডল, পিরপুর) শহীদ হন।
বেগমপুরের বাওড় তখনো পানিতে ভরপুর। এ অবস্থায় ২৭শে নভেম্বর হিজলগাড়ী থেকে পাকআর্মি ও রাজাকারদের একটি গ্রুপ বেগমপুরে পেট্রল ডিউটিতে আসে। বেগমপুর কলনিপাড়ায় পৌঁছলে ১১ ভাই মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের কমান্ডার ওসমান আলীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে ৩ জন পাকসেনা ও ৬ জন রাজাকার নিহত হয়। বাকিরা মুক্তিযোদ্ধাদের ধাওয়া খেয়ে খোরশেদপুর বাওড়ের পানিতে অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা সেখান থেকে ১৫টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল উদ্ধার করেন। এ-যুদ্ধে হারুন-অর- রশিদ (রাঙিয়ারপুতা) শহীদ হন।
চিত্রা নদীর অংশবিশেষ মাইশার বিলকে পূর্ব-পশ্চিমে দুভাগে ভাগ করেছে। উত্তর-দক্ষিণে একটি রাস্তা চলে গেছে আন্দুলবাড়িয়া থেকে সরোজগঞ্জ পর্যন্ত। মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চিম দিকে দর্শনা, দামুড়হুদা ও চুয়াডাঙ্গা থেকে গোপনে ঝিনাইদহ জেলার খাড়াগোদা পৌঁছান। এখানে একটি ব্রিজ ছিল। নিজেদের রক্ষার স্বার্থে পাকসেনাদের জন্য খাড়াগোদা ব্রিজটি ভাঙ্গা প্রয়োজন ছিল। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রয়োজন ছিল সেটি রক্ষার। মুক্তিযোদ্ধারা সংবাদ পান যে, পাকসেনারা সরোজগঞ্জ হয়ে ব্রিজটি ভাঙ্গতে আসবে। তাই আকছেদ, ওয়াজেদ ও ওসমান কমান্ডার তাঁদের গেরিলাদের নিয়ে মাইশার বিলে এম্বুশ রচনা করেন। এদিকে একদল পাকসেনা আন্দুলবাড়িয়া থেকে ব্রিজের দিকে আসে। দুগ্রুপ একই সময়ে ব্রিজে পৌঁছানোর পর আক্রমণ শুরু হবে এমন সময় একজন বৃদ্ধ মহিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, তাঁদের পেছন দিক থেকে আরেক দল পাকসেনা আসছে। তখন মুক্তিযোদ্ধারা মাইশার বিলে নেমে আত্মরক্ষা করেন। পাকসেনারা ব্রিজটিতে ডিনামাইট সেট করে ভেঙ্গে দিয়ে চলে যায়।
কমান্ডার ওয়াজেদ আলী মণ্ডল (বড়শলুয়া) ছিলেন খুবই সাহসী। তিনি চুয়াডাঙ্গা সদর থানার পূর্ব-দক্ষিণে গড়াইটুপি গ্রাম থেকে সামান্য একটু দূরে কোটচাঁদপুর থানার ওয়াড়ি-লক্ষ্মীপুর গ্রামে চিত্রা নদীর ধারে একটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেন। পাকসেনারা সাব্দালপুর, কোটচাঁদপুর ও ঝিনাইদহ থেকে এসে ক্যাম্পটির ওপর আক্রমণ চালায়। তুমুল আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে ওয়াজেদ কমান্ডার চিত্রা নদী পার হয়ে বুক পানিতে দাঁড়িয়ে এলএমজি থেকে ফায়ার করে নিজ দলকে নিরাপদে পার করে নেন। পাকসেনারা ক্যাম্পটি গুঁড়িয়ে দেয়। এ সংবাদ শিকারপুর একশন ক্যাম্পে পৌছলে বড়শলুয়ার আকছেদ কমান্ডার তাঁর শক্তিশালী দল নিয়ে সেখানে রওনা দেন এবং শিবনগর নামক স্থানে যুদ্ধে পাকসেনাদের পরাজিত করে ক্যাম্পটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন ও স্থানীয় যুবকদের প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখেন।
ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখ থেকে চুয়াডাঙ্গা জেলার বিভিন্ন এলাকা মুক্ত হতে থাকে। ২রা ডিসেম্বর শিকারপুর থেকে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বামুন্দী ও হাটবোয়ালিয়া হয়ে ভাংবাড়ীয়া ইউনিয়নের বাঁশবাড়ীয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ান। সঙ্গে আলমডাঙ্গা থানা ও চুয়াডাঙ্গা সদরের অনেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার উপস্থিত ছিলেন। ৩রা ডিসেম্বর জীবননগর থেকে পাকসেনারা চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহের দিকে সরে আসতে থাকে। চুয়াডাঙ্গা শহর মুক্ত করার জন্য চুয়াডাঙ্গা সদরের সকল কমান্ডার শহরের চতুর্দিকে অবস্থান নেন। ৬ই ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা শহরে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ যুদ্ধ হয়। এদিন চুয়াডাঙ্গা মাথা ব্রিজের পশ্চিম পাড়ে দৌলতদিয়াড় থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করলে পাকসেনারা ব্রিজের এক অংশ মাইন দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ৭ই ডিসেম্বর তারা চুয়াডাঙ্গা শহর ছেড়ে মুন্সিগঞ্জ ও আলমডাঙ্গা হয়ে কুষ্টিয়ার দিকে চলে যায়। একটি গ্রুপ ডিঙ্গেদহ হয়ে ঝিনাইদহের দিকে যায়। ভারতীয় মিত্রবাহিনী মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পিছু-পিছু ডিঙ্গেদহ হয়ে ঝিনাইদহের দিকে যান। ৮ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ জনতা চুয়াডাঙ্গা শহরে প্রবেশ করে পতাকা উত্তোলন এবং বিজয় উল্লাস করে। এ-সময় অবাঙালি মহকুমা প্রশাসক ইকবাল বাহার চৌধুরী জনতার রুদ্র রোষে পড়ে নিহত হয়। মোস্তফা আনোয়ারকে মহকুমা প্রশাসক নিযুক্ত করে ১১ই ডিসেম্বর থেকে চুয়াডাঙ্গায় বেসামরিক প্রশাসন চালু হয়।
চুয়াডাঙ্গা সদর থানার একজন মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। তিনি হলেন হারুনুর রশীদ, বীর প্রতীক(পিতা আমোদ আলী, রাঙিয়ারপুতা, বেগমপুর)।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- হারুনুর রশীদ, বীর প্রতীক (বেগমপুরের ওসমান কমান্ডারের সঙ্গে ১১ ভাই গ্রুপের যোদ্ধা ও ২৭শে নভেম্বর বেগমপুর কলনিপাড়া যুদ্ধে শহীদ), আব্দুল আলিম জোয়াদ্দার (২৩) (পিতা গোলাম মোস্তফা, রেলপাড়া; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র; ভারতের ডোমপুকুর ক্যাম্প থেকে বাড়িতে দেখা করতে এলে রাজাকাররা তাঁকে পাকসেনাদের হাতে ধরিয়ে দিলে পাকসেনারা তাঁকে হাসপাতাল ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে ২০শে আগস্ট হত্যা করে), নুরুজ্জামান (২২) (পিতা শেখ ফকির মোহাম্মদ, গুলশানপাড়া; এসএসসি পাস করে দলিল লেখকের চাকরিরত এবং চাকরি ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন; নভেম্বর মাসে আলমডাঙ্গা রুইতনপুর গ্রামে পাকসেনাদের হাতে শহীদ), রবিউল হক জোয়াদ্দার (২৫) (পিতা সামসুদ্দিন জোয়াদ্দার, পোস্ট অফিস পাড়া; স্ক্রুটার চালক ও তা ছেড়ে যুদ্ধে অংশ নেন; ২১শে সেপ্টেম্বর মুজিননগর বর্ডারে পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), তোফাজ্জেল হোসেন (পিতা মহিউদ্দীন মোল্লা, ফার্মপাড়া, পূর্বনিবাস মিরপুর থানার ঝুটিয়াডাঙ্গা গ্রামে; পেশায় আনসার এবং কুষ্টিয়া প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন; শান্তি কমিটির লোকজন পাকসেনাদের হাতে ধরিয়ে দিলে তাদের নির্যাতনে শহীদ), আবুল কাশেম (পিতা বজলুর রহমান, মাঝেরপাড়া; অসচ্ছল পরিবারের সন্তান, প্রতিরাতে শহরে রিকশা চালিয়ে পড়ার খরচ জোগাড় করতেন; চুয়াডাঙ্গা কলেজে ছাত্র থাকা অবস্থায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ; উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর মেহেরপুরের বাগোয়ান মাঠে রতনপুর যুদ্ধে শহীদ ও আট কবরে তাঁর দাফন হয়; তাঁর নামে বড়বাজার থেকে রেল গেট পর্যন্ত সড়কের নাম ‘আবুল কাশেম সড়ক’ রাখা হয়েছে), আলাউল ইসলাম খোকন (পিতা মহিউদ্দীন আহমেদ, বড়বাজার চুয়াডাঙ্গা; ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব; মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে উচ্চ প্রশিক্ষণ শেষে মেহেরপুরের বাগোয়ান মাঠে রতনপুর (আট কবর) যুদ্ধে শহীদ; তাঁর নামে চুয়াডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদ এসোসিয়েশন হলের নামকরণ করা হয় “শহীদ আলাউল হল’), উবায়দুল হক জোয়াদ্দার কবু (মহকুমা আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান; পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে শহীদ), হিমাংশু কুমার বিশ্বাস (ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী; ৬-দফা ও ১১-দফা আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন ও প্রতিরোধযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ; মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারত থেকে বাড়িতে এলে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে শহীদ), মহাম্মদ আলী (মল্লিকপাড়া; রাজনীতিক ও সাংবাদিক; ১৮ই এপ্রিল পাকহানাদাররা বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হাসপাতালের দক্ষিণ মাঠে হত্যা করে), ইসমাইল (৩৪) (পিতা ছলেমান, দীননাথপুর; হার্ডিঞ্জ ব্রিজ প্রতিরোধযুদ্ধে শহীদ), মোতালেব (২২) (পিতা কলিম উদ্দীন, গাড়াবাড়ীয়া; ৩০শে মার্চ কুষ্টিয়া প্রতিরোধযুদ্ধে শহীদ ও পোড়াদহ কবরস্থানে সমাহিত), রবিউল হোসেন (২০) (পিতা হযরত আলী, মানিকডিহি; পাকবাহিনীর পুঁতে রাখা মাইন উদ্ধারের সময় মাইন বিস্ফোরণে ১৩ই ডিসেম্বর শহীদ), আজিজুল হক (ছয়ঘরিয়া; ২রা জুন ছয়ঘরিয়ার দালাল ঘোষাল মিয়া কর্তৃক পাকসেনাদের হাতে ধরিয়ে দেয়ার পর তাঁকে হত্যা), মওলা বকস (ছয়ঘরিয়া; দালাল ঘোষাল মিয়া পাকসেনাদের হাতে ধরিয়ে দিলে ২রা জুন তাঁকে হত্যা), জয়নাল আবেদীন (পিতা ইমান আলী, জালশুকা; পাকসেনাদের হাতে শহীদ), আব্দুল বারী ভূঁইয়া (পিতা আব্দুল মজিদ ভূঁইয়া, বোয়ালিয়া; সেনাবাহিনীর সদস্য ও পাকসেনাদের হাতে শহীদ), জাহাঙ্গীর আলম সরকার (৩৮) (পিতা ওয়াজেদ আলী সরকার, দৌলতদিয়াড়; সেনাবাহিনীতে চাকরিরত; ছুটিতে বাড়ি এসে ইপিআর-দের সঙ্গে কুষ্টিয়া প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ, ১৬ই এপ্রিল বাড়িতে অবস্থানকালে পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে শহীদ), আবদুস সাত্তার (পিতা মধু সর্দ্দার, দৌলতদিয়াড়; সেনাবাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং রাজশাহীতে পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), ইউনুচ আলী (পিরপুর; পিরপুর-উজিরপুর যুদ্ধে পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ), তোফাজ্জেল হোসেন (পিতা মহিউদ্দীন মোল্লা, ছোটশলুয়া; পেশায় আনসার; কুষ্টিয়া প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ শেষে বাড়িতে এলে কোটালি গ্রামের শান্তি কমিটির খাদেম মুন্সী ও মজিদ মোল্লা তাঁকে ও তাঁর এক সহযোদ্ধা আনুছদ্দি (পিতা আলম ফুউরি)-কে ধরে পাকসেনাদের হাতে তুলে দেয় এবং পাকসেনারা চুয়াডাঙ্গায় এনে নির্যাতন শেষে তাঁদের হত্যা করে), আনেছ উদ্দীন (পিতা আলম ফুউরি, পূর্বপুরুষের নিবাস আলমডাঙ্গা থানার ভাংবাড়ীয়া ইউনিয়নের বড়বোয়ালিয়া গ্রামে; পেশায় আনসার; বড়বোয়ালিয়ার মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ফুউরি ওরফে বাবু পরিবারের সন্তান; কুষ্টিয়া প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ; এরপর কোটালি গ্রামের শান্তি কমিটির খাদেম মুন্সী ও মজিদ মোল্লা তাঁকে ও তাঁর সাহযোদ্ধা তোফাজ্জেল হোসেনকে ধরে পাকসেনাদের হাতে তুলে দিলে পাকসেনারা তাঁদের চুয়াডাঙ্গায় এনে নির্যাতন শেষে হত্যা করে লাশ হাসপাতালের দক্ষিণ পাশে বধ্যভূমিতে ফেলে দেয়), ইজারত (পিতা মহন, তিতুদহ; আওয়ামী লীগ নেতা; যুদ্ধকালীন সময়ে ভারত থেকে বাড়ির খোঁজ-খবর নিতে এলে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে শহীদ), সন্তোষ শর্মা (পিতা জগেন্দ্র শর্মা, গড়াইটুপি; ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা; বাড়িতে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করে পুনরায় ভারতে ফেরার পথে ছটাঙ্গারদাড়ি গ্রামে পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে শহীদ), শাহাদত (আকুন্দবাড়ীয়া; পেশায় আনসার; কুষ্টিয়া ও বিষয়খালী প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ), কাশেম (আকন্দবাড়ীয়া মাঝেরপাড়া; পাকসেনাদের হাতে শহীদ), এনায়েত মণ্ডল (আকন্দবাড়ীয়া; পাকসেনাদের হাতে শহীদ), এবং রবিউল ইসলাম রবি (১৯) (পিতা সিদ্দিক আহমেদ, মোমিনপুর; ৫ই আগস্ট রতনপুর (আট কবর) যুদ্ধে শহীদ; তাঁর নামে চুয়াডাঙ্গা কোর্ট থেকে রেল স্টেশন পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ রবিউল ইসলাম সড়ক)।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো হলো- চুয়াডাঙ্গা সদরে স্বাধীনতা স্তম্ভ’৭১, চুয়াডাঙ্গা শিল্পকলা একাডেমিতে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক সংঘ, চুয়াডাঙ্গা বড়বাজারে অস্থায়ী রাজধানী স্মৃতিসৌধ (নির্মাণাধীন), চুয়াডাঙ্গা শহর ব্রিজ মোড়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ (চুয়াডাঙ্গা সদর থানার অনেক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম এতে খোদাই করা আছে), চুয়াডাঙ্গা শহর ব্রিজ মোড়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হাসানের নামে শহীদ হাসান চত্বর, শহীদ আবুল কাশেম সড়ক (বড়বাজার ব্রিজ মোড় পর্যন্ত), শহীদ রবিউল ইসলাম সড়ক (চুয়াডাঙ্গা কোর্ট থেকে রেল স্টেশন পর্যন্ত), শহীদ আলাউল হল, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ডা. আসহাবুল হক এমপিএ-র পাড়ার নামকরণ করা হয় মুক্তিপাড়া ইত্যাদি। [কোরবান আলী মণ্ডল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড