চিরিরবন্দর থানা যুদ্ধ (চিরিরবন্দর, দিনাজপুর)
চিরিরবন্দর থানা যুদ্ধ (চিরিরবন্দর, দিনাজপুর) সংঘটিত হয় ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধে। এতে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ৫ জন এবং মুক্তিবাহিনীর ৪ জন সদস্য শহীদ হন। অপরপক্ষে পাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয় এবং তারা পালিয়ে গেলে চিরিরবন্দর শত্রুমুক্ত হয়।
চিরিরবন্দর রেলস্টেশনের সামনেই থানা ভবন। এখানে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ছিল। থানার পশ্চিম দিকে এক কিলোমিটার দূরে কাঁকড়া রেলসেতুর পাশে আন্ডারগ্রাউন্ডে আরেকটি ক্যাম্প ছিল। পাকসেনারা থানা থেকে রেলসেতু পর্যন্ত মাটি খনন করে ট্রেঞ্চ বানিয়ে তার ভেতর দিয়ে যাতায়াত করত। মাটির তলে ক্যাম্প ও যাতায়াতের ব্যবস্থা থাকায় চিরিরবন্দর থানা থেকে কাঁকড়া রেলসেতু পর্যন্ত রেল লাইনের দুপাশ একটি দুর্ভেদ্য এলাকায় পরিণত হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র গ্রুপে ভাগ হয়ে চিরিরবন্দর এলাকায় বিভিন্ন সময়ে গেরিলা অভিযান পরিচালনা করেন। ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যৌথ কমান্ডে তাঁদের চূড়ান্ত যুদ্ধ পরিচালিত হয়। এটি ভয়াবহ যুদ্ধ ছিল। এ-যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৫২ জন এবং মুক্তিবাহিনীর ১৫২ জন মোট ৩০৪ জন সদস্য অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন ভারতীয় মেজর পাল। যুদ্ধে অংশ নেয়া মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) একটি গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন থানা অধিনায়ক এমদাদুল ইসলাম চৌধুরী ও সহ- অধিনায়ক তসলিমউদ্দিন সরকার। এ বাহিনীর সদস্যরা হলেন— দিনাজপুর-সুইহারির গাজী তোফাজ্জল হোসেন, সর্দারপাড়ার ময়নুল ইসলাম, বালুয়াডাঙ্গার আবু তালেব মনু, চিরিবন্দর-জয়দেবপুরের অইয়ুব আলী, ওয়াকিলউদ্দিন মণ্ডল, বাসুদেবপুরের ইলিয়াস আলী, আব্দুর রশিদ, মো. মাহতাবউদ্দিন, মথুরাপুরের শহিদুল ইসলাম, রাজাপুরের নুরুল ইসলাম, অমরপুরের ইলিয়াস হোসেন, দুর্গাপুরের মকবুল হোসেন, কফারউদ্দিন, আব্দুল বাকী প্রমুখ। বিভিন্ন কোম্পানি কমান্ডের অধীনে এ-যুদ্ধে অংশ মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজন হলেন- দিনাজপুরের জর্জ দাস, লোকমান হাকিম, চিরিরবন্দর-অমরপুরের আলহাজ্ব মো. বজলার রহমান, আব্দুল গফুর, জসিমউদ্দিন, জরিপউদ্দিন, মহিষমারীর ফয়জার আলী, ছোট বাউলের মোজাফফর হোসেন, সুখদেবপুরের আমজাদ হোসেন, হামিদুল হক, নুরুল ইসলাম, আলোকডিহির আবু তোরাব, হুমায়ুন কবির, ফুলপুরের কাজী এমদাদুল হক, কালিগঞ্জের ইদ্রিস আলী, ইলিয়াস আলী, খোচনার মো. সাহাবুল্লাহ, আব্দুর রহমান, পলাশবাড়ির আবুল বাশার, রানীরবন্দরের আব্দুল্লাহ হেল বাকী, আলোকডিহির খয়বর রহমান প্রমুখ।
অপারেশনের দিন মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী ভারতের ফকিরগঞ্জ থেকে বিকেল ৩টার দিকে রওনা দিয়ে সীমান্তের কাছাকাছি চিরিরবন্দরের জয়পুরহাট মাদ্রাসায় এসে আশ্রয় নেয়। এরপর থেকে মুক্তিবাহিনী দুজন মুক্তিযোদ্ধার দ্বারা রেকি করিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এভাবে তাঁরা কালিগঞ্জ বাজার, শান্তিবাজার ও অমরপুর হয়ে ওয়াপদা পর্যন্ত অগ্রসর হন। এরপর তাঁরা বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে থানা ও রেলস্টেশনকে লক্ষ করে সুবিধাজনক স্থানে পজিশন নেন। এদিকে ভারতীয় সেনারা অমরপুর থেকে কাঁচা রাস্তা ধরে কাঁকড়া রেলসেতুর দিকে এগিয়ে যান। তাঁরা সামনের দিকে অবস্থান নিয়ে মুক্তিবাহিনীকে তাঁদের পেছনে রাখেন। মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর একটি অংশ থানা ও এর আশপাশের এলাকায় পজিশন নেয়। মিত্রবাহিনীর পক্ষে প্রথম আক্রমণ শুরু হলেও পাকিস্তানি সেনারা দীর্ঘক্ষণ সাড়া না দেয়ার কৌশল নেয়। কিন্তু তাদের বাংকার ও ট্রেঞ্চে অব্যাহতভাবে আর্টিলারি বাহিনীর শেল নিক্ষিপ্ত হলে তারা অকস্মাৎ বেরিয়ে এসে তীব্র গোলাবর্ষণ শুরু করে। দুপক্ষের তুমুল যুদ্ধে সেদিন চিরিবন্দর থানা থেকে কাঁকড়া রেলসেতু পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ-যুদ্ধে কাঁকড়া রেলসেতুর কাছে ৫ জন ভারতীয় সেনা এবং চিরিরবন্দর থানা ও আশপাশে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. নেসারউদ্দিন (চিরিরবন্দর মথুরাপুর), মো. আব্দুস সোবহান (বাসুদেবপুর), ইলিয়াস হোসেন (পিতা জফিরউদ্দিন সরকার, অমরপুর) ও নজিবর রহমান (রাজাপুর)। ইলিয়াস হোসেন ছিলেন একজন আনসার কমান্ডার এবং ফুটবল খেলোয়াড়। যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। এক পর্যায়ে তারা পালিয়ে গেলে চিরিরবন্দর মুক্ত এলাকায় পরিণত হয়। চিরিরবন্দর থানার সম্মুখে মুজিব বাহিনীর একটি ফলক স্থাপন করা হয়। [আজহারুল আজাদ জুয়েল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড