You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে চিলমারী উপজেলা (কুড়িগ্রাম)

চিলমারী উপজেলা (কুড়িগ্রাম) কুড়িগ্রাম জেলার প্রাচীন থানাগুলোর একটি। ১৮৫০ সালে গঠিত এ থানাটি স্বাধীনতার পরে উপজেলায় রূপান্তরিত হয়। এ উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন হলো- চিলমারী, থানাহাট, রাণীগঞ্জ, অষ্টমীর চর, নয়ারহাট ও রমনা। চিলমারী, অষ্টমীর চর ও নয়ারহাট এ ৩টি ইউনিয়নের অবস্থান ব্রহ্মপুত্র নদের পাশে। চিলমারীর উত্তরে উলিপুর, দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র ও গাইবান্ধা জেলা, পূর্বে ব্রহ্মপুত্র, রৌমারী ও রাজিবপুর থানা, পশ্চিমে তিস্তা নদী ও গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানা। উপজেলাটি উত্তর দিক ব্যতীত অপর তিন দিকে নদ-নদী পরিবেষ্টিত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে চিলমারী থানার ছাত্র, যুবক, শিক্ষক, কর্মচারী, রাজনীতিবিদ ও সংগ্রামী জনগণের গৌরবময় ভূমিকা রয়েছে। ৬-দফা, ১১-দফা ও সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে চিলমারীর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এর সময় চিলমারীর ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। উত্তরবঙ্গের বামপন্থী নেতা শাহদত হোসেন, ফিরোজ মো. ফারুক, আবিজার হোসেন, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মো. আবুল কাশেম চাঁদ, মো. সাদাকাত হোসেন ছক্কু মিয়া, শওকত আলী সরকার, বীর বিক্রম- প্রমুখের নেতৃত্ব ও তত্ত্বাবধানে চিলমারী থানায় নিয়মিত মিছিল সমাবেশ হতো। এসবের ধারাবাহিকতায় ৭০-এর নির্বাচনে উলিপুর-চিলমারী-রৌমারী আসন থেকে মো. সাদাকাত হোসেন ছক্কু মিয়া এমএনএ এবং চিলমারী- রৌমারী আসন থেকে নূরল ইসলাম পাপ্পু মিয়া এমপিএ নির্বাচিত হন। পাকিস্তানিরা নির্বাচনের ফল অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তরে ষড়যন্ত্র শুরু করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে সমগ্র জাতিকে দিকনির্দেশনা প্রদানসহ অসহযোগ আন্দোলন-এ শরিক হওয়ার আহ্বান জানান। এ আন্দোলনের প্রবল উত্তাপ চিলমারীতেও এসে পড়ে। সারাদেশের মওতা এখানেও মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সর্বত্র গণপ্রতিরোধ গড়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর চিলমারী ইপিআর ক্যাম্পের হাবিলদার আনিস মোল্লা প্রথম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাঁর অস্ত্র নিয়ে কুড়িগ্রাম কলেজ ছাত্রবাসে অবস্থান নেন। তিনি আর ক্যাম্পে ফিরে যাননি। ১১ই মার্চ চিলমারী হাইস্কুল মাঠে ছাত্র- জনতার উপস্থিতিতে প্রধান শিক্ষক চিলমারী উপজেলা
জয়নুল আবেদীন মানচিত্রখচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সকল স্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করার জন্য চিলমারী থানা আওয়ামী লীগ-এর নেতারা বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কুড়িগ্রামে সংগ্রাম কমিটি গঠনের পর চিলমারীতে ১৪ই মার্চ থানা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ ও পাকিস্তানবিরোধী সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এবং আনসার, ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে এটি ছিল একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি। এ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন সদাকাত হোসেন ছক্কু এমএনএ। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন- ডা. হাবিবুর রহমান, সামসুল হক বিএসসি, আমিনুদ্দৌল্লা (মিন্টু মিয়া), আবুল খায়ের মণ্ডল (টেলো মিয়া), জয়নুল আবেদীন (ন্যাপ ভাসানী ও প্রধান শিক্ষক, চিলমারী হাইস্কুল), ফিরোজ মো. ফারুক (ন্যাপ মোজাফ্ফর), ওবায়দুল হক, মোজাম্মেল হক, নজির বিএসসি প্ৰমুখ। এছাড়াও দেলোয়ার হোসেন মাস্টার, মোহাম্মদ আলী খন্দকার, গোলাম হাবিব দুলাল, জয়নাল আবেদীন লাল মিয়া, আনসার উদ্দিন, ইসাহাক আলী, আনোয়ার হোসেন, হাবিবুর মেম্বার, খমির মেম্বার, আখতারুল ইসলাম, আবুল কাশেম চাঁদ, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল লতিফ ভোলে, তাহমীদুর রহমান চাঁদ, রেজাউল করিম রাঙ্গা, ছাত্র ইউনিয়ন-এর আবিজার রহমান, আব্দুল মান্নান, জয়নাল আবেদীন, গোলাম হায়দার, ছাত্রলীগ-এর নূরল আলম প্রমুখ কমিটিতে ছিলেন। প্রতিটি ইউনিয়নের প্রতিনিধিরাও এ কমিটির সদস্য ছিলেন। জেলা থেকে ছাত্রলীগ নেতা রওশন উল-বারী রঞ্জু চিলমারী সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন।
ছাত্রলীগ নেতা আবুল কাশেম চাঁদ মার্চের শেষদিকে চিলমারীর ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। পরে সুবেদার আফতাব হোসেন চিলমারীতে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। মহকুমা সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে চিলমারীর বেশ কিছু ছাত্র-যুবক-পুলিশ-আনসার-ইপিআর সদস্য তিস্তা ব্রিজ প্রতিরক্ষায় যোগ দেন।
২৪শে এপ্রিল পাকবাহিনী উলিপুর ও চিলমারীতে অনুপ্রবেশ করে সিও অফিস, রেলস্টেশন, চিলমারী থানা, বালাবারী রেল স্টেশন, জোড়গাছ জুনিয়র স্কুল, চিলমারী ওয়াপদা ভবন, রাজারভিটা মাদ্রাসা প্রভৃতি স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। চিলমারীতে ঢুকেই তারা স্থানীয় শান্তি কমিটি-র পরামর্শ এবং সহযোগিতায় এলাকায় সন্ত্রাস এবং জ্বালাও-পোড়াও নীতি বাস্তবায়ন করতে থাকে।
কুখ্যাত পাকিস্তানি দালাল শামসুল হক পঞ্চঞ্চু মিয়া ছিল কুড়িগ্রাম মহকুমা শান্তি কমিটির সহ-সভাপতি। তার সক্রিয় ভূমিকার ফলে চিলমারীতে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সভাপতি হয় ডা. আজহার উদ্দিন আহমেদ। এসব ক্ষেত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য অলি মোহাম্মদ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা থানা শান্তি কমিটির সদস্য ছিল। চিলমারী থানায় পঞ্চু মিয়ার ছেলে হামিদুল হকসহ ২৮৭ জন বেতনভুক্ত রাজাকার – ছিল। স্বাধীনতার পর এদের অনেকে গ্রেফতার হয়। ১৭ই অক্টোবর চিলমারী যুদ্ধ-এর পর মুক্তিযোদ্ধারা পঞ্চু মিয়া ও অলি মোহাম্মদকে আটক করে রৌমারীতে নিয়ে যান। সেখানে তাদের বিচার করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস চিলমারীর নয়ারহাট ও অষ্টমীর চর মুক্তাঞ্চল ছিল। এসব এলাকা রৌমারী ও রাজিবপুর থানার মুক্তাঞ্চল সংলগ্ন ছিল। এসব মুক্তাঞ্চলে বিপদগ্রস্ত ও নির্যাতিত মানুষের আশ্রয় ছিল। এলাকার মানুষেরা আশ্রয় ও খাদ্য দিয়ে অনেককে সাহায্য করে। মুক্তাঞ্চলগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত অবস্থান ছিল।
চিলমারীতে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি মুজিব বাহিনী ও সক্রিয় ছিল। এখানে মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ছাত্রলীগ নেতা সরকার ইসাহক আলী। তাঁর ডেপুটি ছিলেন আলিফ উদ্দিন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন আনোয়ার হোসেন, দছিজল হক, আবু তৈয়ব সরদার, স্বপন কুমার সরকার (ভকত), তোফাজ্জল হক, শুকুর আলী প্ৰমুখ। ন্যাপ (মোজাফফর), কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা ফ্রন্টের বেশ কয়েকজন নেতা মুক্তিযুদ্ধে চিলমারীতে বিশেষ অবদান রাখেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শাহদত হোসেন, ফিরোজ মো. ফারুক, আবিজার হোসেন, গোলাম হাবিব দুলাল প্রমুখ।
আলতাফ হোসেন ওরফে আফতাব হোসেন বা আফতাব আলী সিলেট জেলার লোক ছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীর সুবেদার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে এক প্লাটুন বাঙালি সৈন্যসহ বিদ্রোহ করে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট হয়ে গাইবান্ধায় আসেন। এরপর তিনি ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে প্রথমে পাথরের চরে অবস্থান নেন। সেখান থেকে সাহায্যের জন্য পরে ভারতে যান। বিএসএফ কমান্ডার তাঁকে অস্ত্র জমা দিতে বললে তিনি অস্ত্র জমা না দিয়ে রৌমারী ফিরে আসেন। রৌমারীর চরগুলোতে তিনি তাঁর বাহিনীর প্রভাব বিস্তৃত করেন। এসব চর থেকে মাঝে- মাঝে পাকিস্তানি ক্যাম্প ও রাজাকারদের আক্রমণ করে তিনি অস্ত্র সংগ্রহ করতেন। এভাবে তাঁর বাহিনীর সাহস ও যুদ্ধের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর নিয়ন্ত্রিত বাহিনী এলাকায় আফতাব বাহিনী নামে পরিচিত ছিল। আফতাব বাহিনীর যোদ্ধারা কোদালকাটি, চিলমারীসহ অনেক যুদ্ধে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর অধীনে একাধিক কোম্পানি ছিল। তিনি রণাঙ্গনে বীরত্ব প্রদর্শন করায় স্বাধীনতা- পরবর্তীকালে তাঁকে বীর উত্তম ও বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। এছাড়া প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা আবুল কাশেম চাঁদ ও ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) নেতা খায়রুল-এর নেতৃত্বে কুড়িগ্রাম এলাকায় দুটি পৃথক কোম্পানি চাঁদ কোম্পানি ও খায়রুল আলম কোম্পানি – গড়ে ওঠে। এ দুই কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা চিলমারীর বিভিন্ন যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
পাকিস্তানি বাহিনী চিলমারীতে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। তারা রৌমারী দখলে নিতে না পারলেও চিলমারীর ওপর নিয়ন্ত্রণ শক্তভাবে বজায় রাখে। সমগ্র এলাকায় যোগাযোগের জন্য চিলমারীর ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। চিলমারী থেকে যেমন রেলপথে মহকুমা ও জেলা সদরের সংযোগ ছিল, তেমনি নৌপথেও ব্রহ্মপুত্র দিয়ে হাজার-হাজার আশ্রয়প্রার্থী মানুষ ভারতে পাড়ি দিত। এ নৌপথে প্রায়ই পাকবাহিনী আক্রমণ করে নিরীহ মানুষদের আটক ও হত্যা করত। তাদের টহল নৌকা ব্রহ্মপুত্র নদে ঝটিকা অভিযান চালিয়ে সাধারণ মানুষদের আটক করে হত্যার পর ব্রহ্মপুত্রে ফেলে দিত।
চিলমারী ঘাট ও রেলস্টেশনে শতশত যাত্রীকে পাকিস্তানিরা হত্যা করে পাশেই পুঁতে রাখত। ফলে এটি একটি বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। চিলমারী ঘাট ও রেলস্টেশন বধ্যভূমি- তখন একটি আতঙ্কজনক স্থান ছিল।
পাকবাহিনী সাদাকাত হোসেন ছক্কু মিয়া এমএনএ, কমান্ডার আবুল কাশেম চাঁদ, টোলো মণ্ডলের বাড়িসহ বহু মুক্তিযোদ্ধা ও অসংখ্য সাধারণ মানুষের বাড়িঘর ব্যাপক লুটপাট শেষে পুড়িয়ে দেয়।
পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের ফলে চিলমারী থানার থানাহাট ইউনিয়ন, রমনা ও রাণীগঞ্জের ৮০ ভাগ মানুষ শরণার্থী হতে বাধ্য হয়। কেউ-কেউ আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে কিংবা চরাঞ্চলে আশ্রয় নেয়। তবে তাদের বড় অংশ শরণার্থী হিসেবে দেশান্তরী হয়।
চিলমারীর প্রতিটি পাকিস্তানি ক্যাম্পই নির্যাতন ও গণহত্যার কেন্দ্র ছিল। এসব কেন্দ্রে নারীদেরও নির্যাতন করা হতো। রাজাকাররা হানাদার বাহিনীকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করত।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা চিলমারীর বিভিন্ন স্থানে মানুষকে হত্যা করে ব্রহ্মপুত্রে ভাসিয়ে দিত বলে এখানে নিহতদের প্রকৃত সংখ্যা জানা সম্ভব নয়। তবে এটি নিশ্চিত যে, এখানে শতশত নৌ ও রেলযাত্রীকে হত্যা করা হয়। এ উপজেলায় অনেক গণকবরও রয়েছে। সেগুলোর একটি বৈলমন্দিয়ার চিলমারী হাইস্কুলের কাছের রেলস্টেশন গণকবর। এখানে দিনাজপুর, রংপুর, কুড়িগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার নিরীহ সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে মাটিচাপা দেয়া হতো। ১৯৭৩ সালে এ গণকবরে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হলেও পরবর্তীকালে এটি নদীগর্ভে তলিয়ে যায়। বালাবাড়ি রেলস্টেশনের কাছে রেললাইনের উত্তর ও পশ্চিমে একটি বধ্যভূমি ও গণকবর আছে, যা বালাবাড়ি রেলস্টেশন বধ্যভূমি ও গণকবর নামে পরিচিত। এখানে বহু মানুষকে হত্যা করে কবর দেয়া হয়। বৈলবন্দিয়ারখাতা চাকলীর পাড়ে ৬ জন শহীদের গণকবর ছিল। এটিও নদীগর্ভে হারিয়ে যায়। চিলমারী থানার নিকটবর্তী বাঁশঝাড়ে একটি গণকবর আছে। এটি চিলমারী থানা সংলগ্ন গণকবর- নামে পরিচিত। এখানে পাকসেনারা অসংখ্য বাঙালিকে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়। মাইলডাঙ্গা ব্রিজের কাছে একটি গণকবর রয়েছে। এ গণকবরে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শায়িত রয়েছেন।
এছাড়া চিলমারীতে আরও কিছু গণকবর রয়েছে। যেমন পুটিমারীহাটি থানার মণ্ডল পাড়া গণকবর, রহিমুদ্দিন ব্যাপারীর বাড়ির গণকবর, খড়খড়িয়া মৌজাধীন মণ্ডল পাড়া ফুটবল মাঠ গণকবর (এখানে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধার দেহাবশেষ রয়েছে), সুতারমারী গ্রামের শশধর সরকারের বাশঝাড় গণকবর, দক্ষিণ নওয়ারির বড়ভিটা গ্রামের বাসাতুল্লা ব্যাপারীর বাড়ির পূর্ব পাশের গণকবর, শরিফেরহাট মনির উদ্দিন হাইস্কুলের দক্ষিণের মুক্তিযোদ্ধা গণকবর, পূর্ব মুদাফত থানা মৌজার জলিল মিয়ার বাড়ির পাশে মোহন মিয়াসহ কয়েক জনের গণকবর, বজরা তবকপুর মৌজার মেরাজউদ্দিন ব্যাপারীর বাড়ির গণকবর, পাটওয়ারীর সেনপাড়ায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমানের কবর এবং বালাবাড়িহাট রেলস্টেশন সংলগ্ন গণকবর, বালাবাড়িহাট রেলস্টেশনের পার্শ্ববর্তী কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে শহীদ ফারুকের কবর।
১৯শে জুলাই চিলমারী থানা অপারেশন- পরিচালিত হয়। খায়রুল আলম কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা এতে অংশ নেন। এতে একজন পাকসেনা নিহত ও অনেকে আহত হয়। অপারেশনের পর থানা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলোর একটি চিলমারী যুদ্ধ। এ-যুদ্ধের পরিকল্পনা করেন ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহের। ১৭ই অক্টোবর সেক্টর কমান্ডারের নেতৃত্বে এ ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল বিশাল ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে চিলমারীর বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটিগুলোতে আক্রমণ করা। সে পরিকল্পনা সফল হয়। যুদ্ধে অনেক পাকসেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। নানা দিক বিবেচনায় এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল। যুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের, স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ খান, ওয়ারেন্ট অফিসার সফিকউল্লাহ, সুবেদার মান্নান, কমান্ডার আবুল কাশেম চাঁদ প্রমুখ অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দেন। একই দিন বালাবাড়ি রেলস্টেশন অপারেশন – পরিচালিত হয়। এতে অর্ধশতাধিক পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়। অপরপক্ষে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
২রা ডিসেম্বর আবুল কাশেম চাঁদের নেতৃত্বে বালাবাড়ি ব্রিজ আক্রমণ করে তা ধ্বংস করা হয়। এ-যুদ্ধে মাহফুজুর রহমান নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
৫ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি কোম্পানি চিলমারী থানা আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা রাতে চারিদিক থেকে পাকিস্তানি অবস্থানগুলো ঘেরাও করেন। তবে এর আগেই পাকসেনা ও পুলিশ সদস্যদের সবাই ট্রেনে করে রংপুর পালিয়ে যায়। তখন বিজয় উল্লাসে মুক্তিযোদ্ধোরা ফাঁকা গুলি করতে-করতে থানার ভেতর প্রবেশ করেন। চারদিকে মানুষ আনন্দ-উল্লাস করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তারাও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়।
৬ই ডিসেম্বর সমগ্র চিলমারী সম্পূর্ণভাবে হানাদারমুক্ত হয়। চিলমারী মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসার পর সেখানে আইন- শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বেসামরিক প্রশাসন চালু করা হয়। প্রশাসক হন মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম চাঁদ। কয়েক দিনের মধ্যে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। বেসামরিক প্রশাসন রাজাকারদের আটক করাসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখে।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন— শওকত আলী সরকার, বীর বিক্রম- (পিতা এজাব উদ্দিন সরকার, দক্ষিণ ওয়ারী, রাণীগঞ্জ)।
চিলমারী উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুল হামিদ (পিতা আকবর হোসেন, মৌজাথানা), ফারুক আহমেদ (পিতা আব্দুর রাজ্জাক মিয়া, মৌজাথানা), হায়দার আলী (পিতা গোলাম আলী, দক্ষিণ ওয়ারী, রমনা), আজিজুল হক (পিতা নিয়ামত উল্যা বেপারী, খরখড়িয়া), ছাকেন হোসেন (পিতা হাসেন আলী, বৈলবন্দিয়ারখাতা জোড়গাছ), রহমত আলী সরকার (পিতা এনায়েত উল্যা বেপারী, বানু কিসামত), মজিবর রহমান (পিতা বয়ান উদ্দিন, মাচাবান্দা), মজিবর রহমান (পিতা উমর উদ্দিন, মাচাবান্দা), জোনাব আলী মণ্ডল (পিতা নাজির উদ্দিন মণ্ডল, রমনা), আব্দুল আউয়াল (পিতা ইলিম উদ্দিন, বৈলমনদিয়ারখাতা), আব্দুল জলিল (পিতা কুমির উদ্দিন, মাচাবান্দা), নুর হোসেন (পিতা জোনা বেপারী, দক্ষিণ ওয়ারী, রমনা) এবং মাহফুজুর রহমান।
চিলমারীতে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও আরো কিছু স্মৃতিসৌধ ও প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়েছে। যেমন বালাবাড়ি রেলস্টেশন স্মৃতিস্তম্ভ, শওকত আলী সরকার বীর বিক্রম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (রাণীগঞ্জ, চিলমারী), গোলাম হাবিব (মুক্তিযোদ্ধা) মহিলা কলেজ, এম এ কুদ্দুস মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ফাউন্ডেশন (রমনা, চিলমারী) ইত্যাদি। চিলমারী উপজেলায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে বেশকিছু রাস্তার নাম নামকরণ হয়েছে। যেমন শহীদ … রহিম সড়ক (চিলমারী কলেজ মোড় থেকে রমনা স্টেশন), শহীদ আউয়াল সড়ক (খাদ্য গোডাউন থেকে রণি মোড় পর্যন্ত), শহীদ মজিবর রহমান সড়ক (থানাহাট বাজারের লুতফর মেকারের দোকান থেকে মাটিয়াল), শহীদ রহমত আলী সড়ক (চিলমারী ডিগ্রী কলেজ মোড় থেকে সন্তোষ ডাক্তারের বাড়ির রাস্তা), শহীদ সাদেক হোসেন সড়ক (চিলমারী ডিগ্রী কলেজ থেকে শরিফের হাট সড়ক), শহীদ আব্দুল জলিল সড়ক (চিলমারী ডাকঘর মোড় থেকে থানাহাট বাজার করিম লন্ড্রি পর্যন্ত), শহীদ শের আলী সড়ক (চিলমারী ডিগ্রী কলেজ মোড় থেকে রেললাইন পর্যন্ত), শহীদ ফারুক সড়ক (মাটিকাটা মোড় থেকে বালাবাড়ি সড়ক), শহীদ মজিবর রহমান সড়ক (সবুজ পাড়া থেকে ফকির পাড়া সড়কটি), শহীদ হায়দার আলী সড়ক (হ্যালিপ্যাড থেকে গাবতলা), শহীদ জোনাব আলী সড়ক (রমনা সরকার বাড়ি থেকে রমনাঘাট), শহীদ নুর হোসেন সড়ক (সবুজ পাড়া থেকে গোলাম হাবিব মহিলা কলেজ), শহীদ ফজল উদ্দিন সড়ক (এডভোকেট ফিরোজ মো. ফারুকের মোড় থেকে সবুজপাড়া কালিমন্দির)। [এস এম আব্রাহাম লিংকন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!