You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.17 | চিলমারী যুদ্ধ (চিলমারী, কুড়িগ্রাম) - সংগ্রামের নোটবুক

চিলমারী যুদ্ধ (চিলমারী, কুড়িগ্রাম)

চিলমারী যুদ্ধ (চিলমারী, কুড়িগ্রাম) সংঘটিত হয় ১৭ই অক্টোবর। এদিন মুক্তিযোদ্ধারা এক সঙ্গে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের নিয়ন্ত্রাধীন ৬টি ঘাঁটি ও ক্যাম্পে আক্রমণ করেন। এসব আক্রমণ একত্রে চিলমারী যুদ্ধ নামে পরিচিত। যুদ্ধে অনেক পাকসেনা ও রাজাকার- নিহত ও আহত হয়। চিলমারী যুদ্ধে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা পরাজিত হলে তাদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। চিলমারীতে রেলস্টেশন ও নদীবন্দর পর্যন্ত একটি সড়ক পথ ছিল। চিলমারী উত্তর বঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগ এবং রৌমারী, জামালপুর, বাহাদুরাবাদ ও গাইবান্ধা থেকে কুড়িগ্রামে প্রবেশের গেটওয়ে হিসেবে গণ্য হতো। ব্রহ্মপুত্রের পূর্বপাড় থেকে মুক্তিযোদ্ধারা যাতে চিলমারীর দখল নিতে না পারেন সেজন্য চিলমারীতে পাকিস্তানিরা বিরাট ঘাঁটি স্থাপন করে। সেখান থেকে তারা চিলমারী নদীবন্দর, চিলমারী রেলস্টেশন, বালাবাড়ি রেলস্টেশন, বালাবাড়ি ব্রিজ, ওয়াপদা ভবন, রাজারভিটা মাদ্রাসা, থানাহাট বাজার ইত্যাদি স্থান নিয়ন্ত্রণ করত। এছাড়া চিলমারীতে পাকিস্তানিদের সহযোগী হিসেবে শামসুল হক পঞ্চ মিয়া, অলি মোহাম্মদ, আজিজুর রহমান ভাটু, হামিদুল হক (পিতা পঞ্চু মিয়া)-এর নেতৃত্বে বিপুলসংখ্যক রাজাকার ছিল। এরা থানার বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানিদের পথ দেখানো ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য দেয়ার কাজ করত। রাজাকাররা এলাকায় হত্যা-নির্যাতন- লুণ্ঠন চালাতে পাকসেনাদের সহায়তা করত। মুক্তিযোদ্ধারা ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে বেশ কয়েকবার চিলমারী থানায় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের ক্যাম্পে আক্রমণ করেন। এসব আক্রমণের মধ্যে সবচেয়ে ব্যাপক ও পরিকল্পিত আক্রমণ ছিল চিলমারী যুদ্ধ।
যুদ্ধের পূর্বে মুক্তিযোদ্ধারা চিলমারীতে পাকিস্তানিদের অবস্থান সম্পর্কে রেকি করেন। রেকি পার্টি চিলমারী থানা, বালাবাড়ি রেলস্টেশন, রেলস্টেশনের পূর্বদিকের সেতু, জোড়গাছ জুনিয়র হাইস্কুল, চিলমারী ওয়াপদা অফিস ভবন এবং রাজারভিটা মাদ্রাসায় পাকিস্তানিদের অবস্থানের নানাদিক শনাক্ত করে। রেকি পার্টির রিপোর্ট যাচাই করার জন্য চিলমারীর স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ওবায়দুলের নেতৃত্বে আব্দুল্ল্যাহ ও আবু বকর সিদ্দিক আরেকটি রিপোর্ট তৈরি করেন। দুটি রিপোর্ট বিবেচনায় নিয়ে চিলমারী যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রণীত হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে, চিলমারীর ৬টি স্থানে পাকিস্তানিদের এক সঙ্গে আক্রমণ করা হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য ছিল কমপক্ষে ৪টি পাকিস্তানি ঘাঁটি দখল করা। আক্রমণ সফল করার জন্য একাধিক কোম্পানির বহু মুক্তিযোদ্ধা সমন্বিতভাবে এতে অংশ নেন। তবে এক্ষেত্রে খায়রুল আলম কোম্পানি, আফতাব বাহিনী – ও চাঁদ কোম্পানি-র মুক্তিযোদ্ধারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কোম্পানি কমান্ডার নজরুল ইসলাম (খায়রুল আলম) রাজারভিটা থানাহাটে সোলায়মান, বালাবাড়ি রেলস্টেশনে রবিউস সামাদ এবং বালাবাড়ি রেলস্টেশনের পূর্বদিকে সেতুসংলগ্ন ক্যাম্পে আব্দুল জব্বারকে অপারেশন কমান্ডার নিয়োগ করেন। ভারতীয় জেনারেল গুল বক্স সিং, কর্নেল ব্রার, লে. কর্নেল কুলকার্নির সঙ্গেও চিলমারী যুদ্ধের পরিকল্পনা বিষয়ে আলোচনা হয়। এ-যুদ্ধ নিয়ে সেক্টর কামন্ডার মেজর আবু তাহের, সাব-সেক্টর কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান এবং ভারতীয় সেনা অফিসার কর্নেল ব্রার ও লে. কর্নেল কুলকার্নির বৈঠক হয়। তাঁরা চিলমারী যুদ্ধের পরিকল্পনা অনুমোদন করেন। প্রয়োজনে ভারতীয় মাউন্টেন ডিভিশন এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের স্বয়ং এ-যুদ্ধে অংশ নেন। সাব-সেক্টর কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান, সফিক উল্লাহ, কোম্পানি কমান্ডার মাহাবুব এলাহি রঞ্জু, খায়রুল আলম, আবুল কাশেম চাঁদ, এ টি এম খালেদুর রহমান দুলু, সুবেদার আফতাব ও সুবেদার মান্নানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা এ-যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন।
জোড়গাছ ও ওয়াপদা ভবনে আক্রমণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের দলদুটি ১৬ই অক্টোবর রাত ১২টার দিকে গাজীরচরে এসে অবস্থান নেয়। রাজারভিটা, বালাবাড়ি স্টেশন, বালাবাড়ি ব্রিজ ও চিলমারী থানা আক্রমণ করার জন্য গঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের দলগুলো ঠাকুরের চর থেকে বনগাঁওয়ে অবস্থান নেয়। ছালিয়া পাড়াকে উইথড্রয়াল পয়েন্ট করা হয়। সেখানে ভারতীয় মিত্রবাহিনী-র সঙ্গে অবস্থান নেয় ডা. মতিয়ার রহমানের নেতৃত্বে একটি মেডিকেল টিম। এ টিমে মেডিকেল কলেজের ছাত্র সাজেদুল ইসলাম সাজু ছিলেন। এ-যুদ্ধে ছোট-বড় অসংখ্য নৌকা ব্যবহার করা হয়েছিল।
১৭ই অক্টোবর ভোর ৪টায় সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের চিলমারীর আকাশে ২৬.৫ ভেরিলাইট পিস্তলের সবুজ সংকেত উৎক্ষেপণ করার সঙ্গে-সঙ্গে চিলমারী যুদ্ধের সূচনা হয়। সবুজ সংকেত পাওয়ামাত্র মুক্তিযোদ্ধারা এক সঙ্গে পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ করেন। চিলমারী থানা অক্রমণে নেতৃত্ব দেন আবুল কাশেম চাঁদ। তাঁর কাছে থানার ওসি-সহ সকল পুলিশ ও রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। সেখান থেকে ৭৬টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। রাজারভিটা মাদ্রাসা আক্রমণে নেতৃত্ব দেন নজরুল ইসলাম ও মাহাবুবুর রহমান চণ্ডুল। এটি ছিল চিলমারীর বড় রাজাকার ক্যাম্প। এখান থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রাথমিক ডিফেন্স দেয়া হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সেখানে ঘণ্টাধিক সময় ধরে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের ক্ষিপ্রতা দেখে কিছু রাজাকার অন্ধকারে পালিয়ে যায়। অন্যরা আত্মসমর্পণ করে। এখান থেকে ৪০টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ও গোলাবারুদ উদ্ধার এবং রাজাকারদের বন্দি করা হয়। জোড়গাছ স্কুলে এ টি এম খালেদুর রহমান দুলু, কাইজুল ও নূর আহম্মেদ আলোর নেতৃত্বে তিনদিক থেকে আক্রমণ চললে রাজাকাররা পরাজিত হয়। এখানে ২০ জন রাজাকারকে বন্দি করে মুক্তিযোদ্ধারা ২০টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল দখলে নেন। দুলুর দলের মুক্তিযোদ্ধারা এ অপারেশনের পর ওয়াপদা ভবন অপারেশনে যোগ দেন। সুবেদার মান্নানের নেতৃত্বে ওয়াপদা ভবনে আক্রমণ হয়। এ ভবনে পাকিস্তানি সৈন্যদের ঘাঁটি ছিল। এখানে মুক্তিযোদ্ধারা ভারী অস্ত্র ব্যবহার করেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা ভবনের বাইরে কংক্রিটের বাংকার নির্মাণ করেছিল। এখানে সারাদিন ধরে যুদ্ধ চলে। এ-যুদ্ধে অনেক পাকসেনা নিহত ও আহত হয়। চিলমারী যুদ্ধে পাকিস্তানিদের নিক্ষিপ্ত মর্টার শেলের আঘাতে মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন সিদ্দিকীর পিতা আবুল হোসেন, তাঁর ছোট বোন আফিয়া খাতুন ও পচু-র মা চাকলিপাড় গ্রামে শহীদ ও আবুল হোসেনের স্ত্রী আছিয়া খাতুন গুলিবিদ্ধ হন। চিলমারী যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পাকিস্তানি দালাল শামসুল হক পঞ্চু মিয়া ও ওয়ালি মোহাম্মদকে মুক্তিযোদ্ধা এ টি এম খালেদুর রহমান দুলু আটক করেন। বিভিন্ন অবস্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রচুর পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র নিজেদের দখলে নিয়ে রৌমারী মুক্তাঞ্চলে নিরাপদে ফিরে যান। পরদিন রৌমারীতে পঞ্চু মিয়া ও অলি মোহাম্মদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। চিলমারী যুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মবিশ্বাস ও সামরিক শক্তি বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়। [এস এম আব্রাহাম লিংকন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড