You dont have javascript enabled! Please enable it!

চিংড়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

চিংড়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা) সংঘটিত হয় ২০ ও ২১শে সেপ্টেম্বর। এতে ৭ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান। ডুমুরিয়া সদরের পশ্চিম-দক্ষিণ পাশে ভদ্রা নামে একটি খরস্রোতা নদী ছিল। ডুমুরিয়া সদরের বাজারের কাছে এন জি সি এন্ড এন জি কে হাইস্কুলের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে ভদ্রা নদী প্রবাহিত ছিল। ভদ্রা নদীর পশ্চিম পাড়ে শোভনা ইউনিয়নের চিংড়া গ্রাম। এ গ্রামে রাজাকার-রা এ গণহত্যা সংঘটিত করে।
ডুমুরিয়া থানা ভবনের পূর্ব পাশে ছিল এন জি সি এন্ড এন জি কে হাইস্কুলের ছাত্রাবাস। এ ছাত্রাবাসটি দখল করে রাজাকাররা এতে ক্যাম্প স্থাপন করে। রাজাকারদের আরেকটি ক্যাম্প ছিল থানা ভবনের পশ্চিম পাশে মজিদ মোল্লার বাড়ি সংলগ্ন একটি ভবনে। এ ক্যাম্পের পশ্চিম পাশে ভদ্রা নদী এবং ভদ্রা নদীর পশ্চিম পাড়ে চিংড়া গ্রাম। ডুমুরিয়া সদর এলাকায় রাজাকারদের প্রভাব থাকলেও নদীর পশ্চিম পাড়ের চিংড়া গ্রাম তথা শোভনা ইউনিয়ন ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মজিদ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।
৫ই সেপ্টেম্বর মজিদ বাহিনী শোভনা ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী ঝিলা নদীতে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের একটি লঞ্চ ডুবিয়ে দেয়। এ ঘটনার পর থেকে পাকিস্তান বাহিনী শোভনা এলাকায় অভিযান জোরদার করে। ৮ই সেপ্টেম্বর থেকে শোভনার পার্শ্ববর্তী নদীতে ৪টি লঞ্চ ও গানবোটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী টহল দিতে শুরু করে। এছাড়া রাজাকাররা শোভনা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় মজিদ বাহিনীর যোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে থাকে। চিংড়া গ্রামেও রাজাকাররা এ-সময় তৎপর হয়ে ওঠে।
১০ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শোভনা গ্রামে হানা দেয় এবং বিভিন্ন বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এ ঘটনায় এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মজিদ বাহিনী তখন শোভনা এলাকা ছেড়ে পার্শ্ববর্তী মাগুরখালী ইউনিয়ন ও অন্যান্য এলাকায় আশ্রয় নেয়। এ বাহিনীর অন্যতম যোদ্ধা ছিলেন চিংড়া গ্রামের শেখ আমজাদ হোসেন। চিংড়া গ্রামের অধিবাসীরা তাঁর কাছে গিয়ে তাদের এ অবস্থায় করণীয় সম্পর্কে জানতে চায়। তখন ডুমুরিয়ার রাজাকাররা চিংড়ার অধিবাসীদের আশ্বাস দেয় যে, তারা গ্রামে আক্রমণ করবে না, তবে মজিদ বাহিনীর কেউ গ্রামে থাকলে তাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। পরদিন সকালে ডুমুরিয়া সদরের রাজাকাররা নৌকায় পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে নদী পার হয়ে চিংড়া গ্রামে হাজির হয়। আগেরদিন পরস্পরকে আক্রমণ না করার ব্যাপারে সমঝোতা হওয়ায় মজিদ বাহিনীর সক্রিয় সদস্য মোহর আলী ফকির, আবদুল গফুর, জফর আলী প্রমুখ গ্রামেই ছিলেন। রাজাকাররা গ্রামে এসে সকলকে উত্তর চিংড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। এ খবর পেয়ে গ্রামের অনেকে সেখানে উপস্থিত হয়। তারা ভেবেছিল রাজাকাররা হয়তো গ্রামবাসীকে কোনো নির্দেশনা দিতে চায়।
চিংড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার পর রাজাকাররা অস্ত্রের মুখে গ্রামবাসীর মধ্য থেকে ২০ জনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে। পরে তাদের নৌকায় করে নদী পার করিয়ে থানা সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে সপ্তাহ খানেক রেখে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন করে। তাদের মধ্যে ৭ জনকে ২০শে সেপ্টেম্বর রাতে রাজাকাররা স্কুলের পশ্চিম পাশে নদীর চরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে। ঘটনাস্থলে ৫ জন মারা যান। মুমূর্ষু অবস্থায় আবদুর রহিম ও আবদুল গাজী কোনোরকমে নদীতে ভাসতে ভাসতে চিংড়া গ্রামে পৌঁছান। পরের দিনই এ খবর রাজাকার বাহিনীর কাছে পৌঁছে যায়। ২১শে সেপ্টেম্বর তারিখে রাজাকাররা আবদুর রহিমকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। অপর আহত আবদুল গাজী বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেন।
চিংড়া গণহত্যায় নিহত ৭ জন হলেন- মোহর আলী ফকির ফারুক (পিতা শরীতুল্লা, চিংড়া), আবদুর রহিম জদ্দার (পিতা আমীর আলী জদ্দার, চিংড়া), আবদুল গফুর জদ্দার দুখো (পিতা আমীর আলী জদ্দার, চিংড়া), সফেদ আলী সরদার (পিতা ছপো সরদার, চিংড়া), আবদুল গাজী (পিতা জমাদ্দার গাজী, চিংড়া), জফর আলী শেখ (পিতা হাজের আলী শেখ, চিংড়া) এবং হারান ঋষি (পিতা নিরাপদ ঋষি, শিবপুর, শোভনা)। [দিব্যদ্যুতি সরকার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!