You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে চিতলমারী উপজেলা (বাগেরহাট)

চিতলমারী উপজেলা (বাগেরহাট) ব্রিটিশ আমল থেকেই চিতলমারী উপজেলা ছিল প্রগতিশীল বাম রাজনীতির শক্ত ঘাঁটি। তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান আমলে এখানে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও আওয়ামী লীগ-এর রাজনীতি সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর আহ্বানে সারাদেশের মতো চিতলমারীর মানুষও স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর ন্যাপ নেতা এডভোকেট এস এম এ সবুর (আড়য়াবর্নি), চিতলমারী আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল হক মল্লিক (আডুয়াবর্নি), ভাসানী ন্যাপ- নেতা শেখ নাসির আহমেদ (বোয়ালিয়া), ন্যাপ নেতা শান্তিরঞ্জন গুহ (পাঙ্গাশিয়া), আওয়ামী লীগ নেতা ও বড়বাড়িয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক শামসুদ্দীন রহমান ওরফে ছিকা মাস্টার (বড়বাড়িয়া), শেখ আব্দুল আউয়াল, নূরমোহম্মদ মল্লিক প্রমুখের নেতৃত্বে একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এ পরিষদের নেতারা নিজেদের অনুসারীসহ সাধারণ মানুষকে স্বাধীনতার পতাকাতলে সমবেত করেন। এই পটভূমিতে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ।
২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট এবং ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ পৌঁছার সঙ্গে-সঙ্গে চিতলমারীর বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন। আওয়ামী লীগ নেতা শামসুদ্দীন রহমান ওরফে ছিকা মাস্টারকে আহ্বায়ক এবং মোহাম্মদ আলী (বাগেরহাট পি সি কলেজের ক্যাডেট কোরের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছাত্র)-কে সচিব করে বড়বাড়িয়ায় ৫১ সদস্যবিশিষ্ট একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। বোয়ালিয়ায় ভাসানী ন্যাপ নেতা শেখ নাসির আহমেদ (হিজলা ইউনিয়নের
চেয়ারম্যান)-এর নেতৃত্বে ফরিদ আহমেদ শেখ (শান্তিখালি), শান্তিরঞ্জন গুহ, মনীন্দ্র নাথ বোস (বোয়ালিয়া), কাজী সোহরাব (হিজলা), মৃন্ময় কান্তি মণ্ডল (পাঙ্গাশিয়া) প্রমুখের সমন্বয়ে একটি ইউনিয়ন ভিত্তিক সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ২৭শে মার্চ ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর উদ্যোগে চিতলমারী উপজেলার স্কুল শিক্ষক বিমল চন্দ্র বিশ্বাসের বাবুগঞ্জ বাজারস্থ বাসায় বসে একটি গোপন মুক্তিযুদ্ধ সেল গঠন করা হয়। সেলের সভাপতি ও সেক্রেটারি ছিলেন যথাক্রমে এস এম এ সবুর ও এ বি এম রেজাউল করিম (দীঘিরজান, নাজিরপুর)। এর সদস্য ছিলেন- কাজী সোহরাব হোসেন, ডা. মো. আলাউদ্দীন (মাহমুদকান্দা, নাজিরপুর) এবং এম এ রব (চরমাটিভাঙ্গা, নাজিরপুর)। এই সেলের অধীনে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি উপ-কমিটি গঠন করা হয়, যেখানে নারীরাও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
২৬শে মার্চের পর চিতলমারী বয়েজ স্কুল মাঠ ও চিতলমারী কাচারির বেলতলা ময়দানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দুটি পৃথক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলা হয়। এ দুটি ক্যাম্পে প্রশিক্ষক ছিলেন মেজর জয়নুল আবেদিন মানিক মিয়া (পরে শহীদ) এবং শেখ সোহরাব সোহরাব হোসেন (কাটিপাড়া)। প্রথমটিতে অংশগ্রহণকারী প্রশিক্ষণার্থীদের অধিকাংশ ছিলেন ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মী। তাঁদের মধ্যে ছিলেন- আব্দুর সবুর বাচ্চু, আনসার আলী খোকন, মীর হেমায়েত উদ্দীন, শেখ গোলাম মোস্তফা, হাজী চান মিয়া মোল্লা, এস এম রেজাউল করিম, অসীম কুমার সাহা, রাধাবল্লভ সাহা, শ্যামল কুমার পোদ্দার, শেখ জেন্নাত আলী, সেকেন্দার আলী (আলীপুর), আব্দুর রব প্রমুখ। ২০শে জুন পাকবাহিনী কর্তৃক চিতলমারী আক্রান্ত হলে এ গ্রুপের প্রায় সকলেই এস এম এ সবুরের নেতৃত্বে আসামের তেজপুরে হালকা ও মাঝারি এবং ভালুকপংয়ে ভারী অস্ত্র ও গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁরা এস এম এ সবুরের অধিনায়কত্বে বিশেষ গেরিলা বাহিনী নিয়ে আখাউড়া দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন।
দ্বিতীয় ক্যাম্পের প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সংখ্যা ছিল অধিক। তাঁদের মধ্যে শেখ বেল্লাল হোসেন, শেখ ফয়জুল ইসলাম, শেখ মনি, ফরিদ বিশ্বাস, নালু বিশ্বাস, শেখ শহিদুল ইসলাম, শেখ ওহিদুল ইসলাম, শেখ সিরাজুল ইসলাম, শেখ রোকন উদ্দীন প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ২০শে জুনের পর এঁদেরও অধিকাংশ ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
ইউনিয়ন ভিত্তিক সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১লা এপ্রিল থেকে বোয়ালিয়ায়ও প্রশিক্ষণ শুরু হয়। শেখ নাসির আহমদ ও শান্তিরঞ্জন গুহ এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালক ও সহ- পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এখানে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন আনসার কমান্ডার আয়ুব আলী শেখ ওরফে কালু মিয়া (হিজলা)। ১লা এপ্রিল প্রশিক্ষণ উদ্বোধনের দিন মণীন্দ্রনাথ বোস পাকিস্তানি পতাকা পোড়ান এবং নাসির আহমদ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এখানে প্রশিক্ষণ নেন মনীন্দ্র নাথ বোস, রসময় বিশ্বাস (পিরারাবাদ), মৃন্ময় কান্তি মণ্ডল, কাজী সোহরাব হোসেন, আকরাম আলী শেখ, হাবিবুর রহমান শেখ, ডা. ইয়াকুব আলী মোল্লা, গোপাল চন্দ্র বসু, নির্মল চন্দ্ৰ বিশ্বাস (পাটারী), আব্দুল হক কাজী, আতিয়ার রহমান গাজী, অমূল্য কুমার বালা, যোগেন্দ্রনাথ রায় (বোয়ালিয়া)-সহ ষাটোর্ধ্ব মুক্তিযোদ্ধা। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন নাসির আহমদ, শান্তিরঞ্জন গুহ, মৃন্ময় কান্তি মণ্ডল, মনীন্দ্র নাথ বোস, কাজী সোহরাব হোসেন এবং মহিলাদের মধ্যে খোদেজা বেগম (বোয়ালিয়া), নীহারিকা বিশ্বাস (বোয়ালিয়া), মালতী রাণী সরকার (পাঙ্গাশিয়া) প্রমুখ। ২০শে জুন চিতলমারী পাকবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হলে নাসির আহমদ ও শান্তিরঞ্জন গুহ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র-শস্ত্রের জন্য ভারতে যান এবং ভারতের বিহার রাজ্যের চাকুলিয়া ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের তত্ত্বাবধানে বড়বাড়িয়া হাইস্কুল প্রাঙ্গণেও একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলা হয় এবং সেখানে অনেকে প্রশিক্ষণ নেন। উপর্যুক্ত নেতৃবৃন্দ ব্যতীত চিতলমারী উপজেলায় আরো যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা হলেন— শের আলী মল্লিক (আড়ুয়াবর্নি), কায়ুম আলী শেখ (শিবপুর), সিরাজুল হক মল্লিক (আড়য়াবর্নি), বেদার উদ্দিন তালুকদার (পাটরপাড়া), মনোরঞ্জন সাহা (চিতলমারী), নগেন্দ্রনাথ বড়াল (চরবানিয়ারী), মনোরঞ্জন বসু (দুর্গাপুর), শেখ ফরিদ উদ্দীন (শান্তিখালী), শেখ নাছির আহমেদ (বোয়ালিয়া) প্রমুখ। ছাত্র-যুবকদের মধ্যে ছিলেন- এ বি রেজাউল করিম (দিঘীরজান), কাজী সোহরাব হোসেন, মৃন্ময় কান্তি মণ্ডল, বিশ্বদেব মণ্ডল (খড়মখালী) এবং মনীন্দ্র নাথ বোস। নারী সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন- খোদেজা বেগম, মালতী রাণী সরকার, নীহারিকা বিশ্বাস, কুলছুম বেগম (আড়য়াবর্নি), পারুলপ্রভা বিশ্বাস (তাড়াইল, গোপালগঞ্জ), গীতা রাণী হালদার (খড়মখালী) প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের সময় এঁরা সংগঠকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য, বিশেষত বাগেরহাট ও পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খাদ্য সংগ্রহ ও সরবরাহের দায়িত্ব পালন করেন। উপর্যুক্ত ছাত্র-যুবক ও মহিলাদের সকলেই ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী।
পাকবাহিনী ১৭, ১৮ ও ২০শে জুন চিতলমারীর তিনটি গ্রামে প্রবেশ করে শতাধিক লোককে হত্যা করে এবং দুশতাধিক ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তবে এখানে তাদের কোনো ক্যাম্প ছিল না।
চিতলমারী উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দল ছিল মুসলিম লীগ এবং শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা হলো- লাল মিয়া সরদার (আদিখালী), রব কাজী (কাঠিপাড়া), আলী শেখ (হিজলা), কামাল শেখ (চরবড়বাড়িয়া), তারু মীর (রাজনগর), আনোয়ার হোসেন খান (বড়বাড়িয়া), আতিয়ার রহমান, দবির উদ্দীন শেখ (শিবপুর), আলতাব হোসেন (হিজলা, চরপাড়া), আতোর আলী (হিজলা), রেজা কাজী (হিজলা), আব্দুল কাদের মোল্লা (হিজলা), মৌলবী জাফর আলী (শ্যামপাড়া), শেখ মতলেব উদ্দীন (বড়বাড়িয়া), কটা মুন্সি (চরশৈলদাহ), তারু মীর (কুর্নিয়া) ও মুনছুর মিয়া (বড়বাড়িয়া)। এদের উদ্যোগে রাজাকার- বাহিনী গঠিত হয় এবং রাজাকাররা পাকবাহিনীর সহায়তায় এলাকায় নানারকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালায়। ২৫শে মে তারু মীরের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী রাজনগর গ্রামের প্রায় দুশ ঘরে আগুন দেয় ও লুটপাট করে। ১৭ই জুন গোপালগঞ্জ জেলার পাঠগাতী ইউনিয়নের মুসলিম লীগ নেতা ও কুখ্যাত রাজাকার নুরু মিয়া ৫০-৬০ জন পাকসেনা ও অনেক রাজাকার নিয়ে পরানপুর গ্রাম হয়ে চিতলমারী উপজেলার বড়বাড়িয়া গ্রাম আক্রমণ করে। তারা মুন্সি কামরুজ্জামান ও অন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং মুন্সি বদিউজ্জামান, মুন্সি মাকসুদুউজ্জামান (পিতা মুন্সি কামরুজ্জামান) ও নালুয়ার কাছে চরলাটিমার নকুল বালা (পিতা সখিচরণ বালা)-কে হত্যা করে। পরের দিন ১৮ই জুন চরলাটিমা ও শান্তিখালির উত্তরপাড়ায় হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় রাজাকাররা বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে ও লুটপাট চালায়।
২০শে জুন চিতলমারী পুনরায় আক্রান্ত হয়। পাকবাহিনীর একটি দল গোপালগঞ্জের বড়গুনি পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে। আরেকটি দল পিরোজপুর থেকে নদীপথে চিতলমারীর দশমহলের দক্ষিণ সীমান্তে কালিগঞ্জ বাজারে আসে। একটি দল পিরোজপুরের হুলারহাট থেকে মাটিভাঙ্গা হয়ে বলেশ্বর নদী দিয়ে বাবুগঞ্জ বাজারে আসে। অন্য একটি দল বাগেরহাটের মুনিগঞ্জ-কান্দাপাড়া-দেপাড়া- ফুলতলা-সন্তোষপুর হয়ে চিতলমারীর দিকে অগ্রসর হয়। প্রত্যেকটি দলের সঙ্গে ছিল বাইরের এবং স্থানীয় বহু রাজাকার ও দালাল।
কালীগঞ্জের দলটি পিপড়াডাঙ্গার মধ্য দিয়ে উত্তরদিকে খাসেরহাটের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে অনেক হিন্দুবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। খাসেরহাটের পথে তারা ইন্দুভূষণ মল্লিক, দেবেন্দ্রনাথ মল্লিক, নারায়ণচন্দ্র মণ্ডল, যোগেন্দ্রনাথ গুহ, অমর গুহ, ছবি রাণী গুহ এবং রাধাকান্ত গাইনকে গুলি করে হত্যা করে। ক্ষীরোদ চন্দ্র রায়কে গুলি করে ফেলে রেখে যাওয়ার পর সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। এ সময় সুনীতি মণ্ডল ও পুতুল রাণী মণ্ডলের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। পথে তারা চরবানিয়ারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নগেন্দ্রনাথ বড়ালের বাড়িসহ অনেক বাড়িতে আগুন দেয়। তাদের সঙ্গে থাকা রাজাকার বাহিনী চরবানিয়ারী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের বাড়িসহ আরো কয়েকটি বাড়িতে লুটতরাজ চালায়। পাকবাহিনীর মুনিগঞ্জের দলটি কান্দাপাড়া-দেপাড়া হয়ে চিতলমারী আসার পথে বিভিন্ন বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। বাবুগঞ্জ বাজারের দলটি খলিশাখালীর পথ ধরে চিতলমারীর দিকে অগ্রসর হয় এবং খলিশাখালীর অনেক বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। সঙ্গে থাকা বহিরাগত ও স্থানীয় রাজাকাররা লুটতরাজ চালায়। স্থানীয় রাজাকারদের মধ্যে ছিল কটা মুন্সি এবং দেলোয়ার হোসেন দিলু। পাকবাহিনী ও রাজাকারদের অত্যাচারে বিভিন্ন জায়গা থেকে আশ্রয় নেয়া এবং স্থানীয় বহু লোককে তারা হত্যা করে, যা খলিশাখালী গণহত্যা নামে পরিচিত।
এদিন খড়মখালীর শেরে বাংলা কলেজের পেছনেও এক নারকীয় ঘটনা ঘটে। পিরোজপুরের আটঘর-কুড়িআনার অনেক মানুষ এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। তারা পাকবাহিনীর আকস্মিক আক্রমণে দিশেহারা হয়ে খড়মখালী-গরীবপুর খালের উত্তর পাশে হোগলাবনের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। পাকসেনারা তাদের ওপর এলোপাথাড়ি গুলি চালালে ৭০- ৮০ জন নিরীহ মানুষ শহীদ হয়। এ ঘটনা খড়মখালী হোগলাবন গণহত্যা- নামে পরিচিত। এছাড়া চিতলমারীর আদিখালীর কাছে পাকবাহিনীর গুলিবর্ষণে পাটক্ষেতের মধ্যে শহীদ হন হরকুমার মাঝি, তার শিশুপুত্র যোগেন মাঝি, চৌদ্দ হাজারি গ্রামের হরিপদ হালদার, অমূল্য হালদার এবং আড়ুয়াবর্নি গ্রামের আফজাল হোসেন মোল্লা। এছাড়া নালুয়া গ্রাম এবং চরলাটিমা ও শান্তিখালির উত্তরপাড়ায় রাজাকাররা বিভিন্ন বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ করে।
চিতলমারী উপজেলায় তিনটি গণকবর রয়েছে- খলিশালীর মাঠ গণকবর, পিপড়াডাঙ্গার মাঠ গণকবর এবং খড়মখালী হোগলাবন গণকবর।
চিতলমারীতে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি স্থানীয় বাহিনী গড়ে উঠেছিল। সেগুলো হচ্ছে— সবুর বাহিনী, শামসু মল্লিক বাহিনী, হবি বাহিনী, তাজুল ইসলাম বাহিনী, নূরমোহম্মদ বাহিনী, শান্তিগুহ বাহিনী এবং খোকন বাহিনী। শান্তিরঞ্জন গুহর নেতৃত্বে শান্তিগুহ বাহিনী ছিল সবুর বাহিনীর অনুগত একটি শাখা বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে শান্তিরঞ্জন ৩০-৪০ জন সহযোদ্ধাসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে খলিশাখালীতে তাঁর শ্বশুর সুন্দর হীরার বাড়িতে আশ্রয় নেন। খোকন বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন রফিকুল ইমলাম খোকন (পিতা মো. সায়েল উদ্দীন, চিরুলিয়া- বিষ্ণুপুর, বাগেরহাট)। তিনি ছিলেন ‘পূর্ব বাংলার কমুনিষ্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি’র বাগেরহাট মহকুমা শাখার আহ্বায়ক এবং ভারতের নকশালবাড়ির চারু মজুমদারের অনুসারী। উপর্যুক্ত বাহিনীগুলো চিতলমারীকে পাকহানাদারমুক্ত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
পাকবাহিনী জুনের ১৭, ১৮ ও ২০ তারিখ চিতলমারীতে ঢুকে শতাধিক লোককে হত্যা করে এবং বেশ কিছু ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় ও লুটপাট করে। বাকি সময় এটি ছিল মুক্ত এলাকা। তাই এ উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো যুদ্ধ হয়নি। তবে চিতলমারীর মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন জায়গার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। জয়নুল আবেদিন মানিক মিয়া (আড়ুয়াবর্নি), শেখ নওসের আলী (আড়ুয়াবর্নি), শেখ শাজাহান (খড়মখালী), শেখ সৈয়দ আলী (উত্তর শিবপুর), শেখ সাখাওয়াত হোসেন (আডুয়াবর্নি), শেখ তাছেন উদ্দীন (আড়ুয়াবর্নি) এবং মিলু মোল্লা (শিবপুর) খুলনার গল্লামারীর যুদ্ধ-এ অংশগ্রহণ করেন। এ-যুদ্ধে জয়নুল আবেদিন মানিক মিয়া শহীদ হন। নূরমোহাম্মদ উকিল (বড়বাড়িয়া) তাঁর বাহিনী নিয়ে রঘুনাথপুর রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ-এ অংশগ্রহণ করেন। এখানে গরীবপুর গ্রামের শান্তিরঞ্জ মণ্ডল (তাজুল ইসলাম বাহিনীর ওয়ারলেস অপারেটর) আখ বিক্রেতার ছদ্মবেশে রেকিতে অংশ নেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বোয়ালিয়ার আতিয়ার রহমান গাজী। শামসু মল্লিক ও নওসের আলী মোল্লাহাটের চরকুলিয়া যুদ্ধ, হাড়িদহ ব্রিজ যুদ্ধ ও দত্তডাঙ্গা রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন-এ অংশগ্রহণ করেন এবং বিশেষ সাহসিকতার পরিচয় দেন। ২৫শে অক্টোবর বাগেরহাটের মুনিগঞ্জ এবং কচুয়ার কান্দাপাড়া ও দেপাড়া হয়ে পাকবাহিনী ও রাজাকার- আলবদররা চিতলমারীর দিকে অগ্রসর হলে তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে কমান্ডার রফিকুল ইসলাম খোকন, মো. জাবেদ আলী, আমজাদুল হক প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা তাদের প্রতিরোধ করেন। দুদিন ধরে এ প্রতিরোধ চলার পর কান্দাপাড়ায় দুপক্ষের মধ্যে এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে তিনজন পাকসেনা ও পাঁচজন রাজাকার নিহত হয়। এটি কান্দাপাড়ার যুদ্ধ নামে পরিচিত।
বাগেরহাট জেলা শহর পাকবাহিনী ও রাজাকারদের দখলে চলে গেলেও চিতলমারী উপজেলা মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস (১৭, ১৮ ও ২০শে জুনের ঘটনা ব্যতীত) মুক্তাঞ্চল ছিল। চিতলমারীর যেসব মুক্তিযোদ্ধা চিতলমারী ও অন্যত্র এবং অন্য এলাকার যেসব মুক্তিযোদ্ধা চিতলমারীতে শহীদ হন, তাঁরা হলেন— জয়নুল আবেদিন মানিক মিয়া (পিতা শেখ লেহাজ উদ্দীন, আড়ুয়াবর্নি; খুলনার গল্লামারী যুদ্ধে শহীদ), সিদ্দিক সরদার (পিতা শীতল সরদার, খড়মখালী; মাদারতলী সীমান্তে শহীদ), বেদার সরদার (পিতা শীতল সরদার, খড়মখালী; ঐ), সাহেব বিশ্বাস (পিতা রহিম উদ্দীন বিশ্বাস, খড়মখালী; ঐ), জাবেদ মিয়া তারা (পিতা জালাল মিয়া, শৈলদাহ, কলাতলা; ফকিরহাটের পিলজং-এ শহীদ), লিয়াকত আলী শেখ (পিতা সুরত আলী শেখ, কলাতলা; ঐ), সমীর চন্দ্র মল্লিক (পিতা কুমুদবন্ধু মল্লিক, বাঁশবাড়িয়া, সন্তোষপুর; যশোর সীমান্তে শহীদ), হেদায়েৎ উল্লাহ (নড়াইল; খলিশাখালীতে শহীদ), বিজয় পাল (ফতেপুর, বাগেরহাট; সন্তোষপুর ক্যাম্পে সমাহিত) এবং মোল্লা আফজাল হোসেন (পিতা জব্বার মোল্লা, আড়ুয়াবর্নি; চিতলমারী উপজেলা চত্বরে শহীদ)।
চিতলমারী উপজেলা চত্বরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। ১৯৯৭ সালে সন্তোষপুর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ পরিষদের উদ্যোগে চিতলমারী সদর থেকে সাত কিলোমিটার দক্ষিণে সন্তোষপুর হাইস্কুল মাঠের উত্তর পাশে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। ফলকের ওপরে লেখা রয়েছে: ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে/ বাংলার স্বাধীনতা আনলে যাঁরা, আমরা তোমাদের ভুলব না।’ পাকিস্তান আমলে কলাতলা ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি খাল এবং খালের পাশের একটি হাটের নাম ছিল যথাক্রমে ‘পাকিস্তানের খাল’ এবং ‘পাকিস্তানের হাট’। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর উপর্যুক্ত খাল এবং হাটের নামকরণ করা হয় যথাক্রমে ‘বাংলাবাজার খাল’ এবং ‘বাংলাবাজার হাট’। [মনীন্দ্র নাথ বোস]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!