You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.07 | চাপিতলা যুদ্ধ (মুরাদনগর, কুমিল্লা) - সংগ্রামের নোটবুক

চাপিতলা যুদ্ধ (মুরাদনগর, কুমিল্লা)

চাপিতলা যুদ্ধ (মুরাদনগর, কুমিল্লা) সংঘটিত হয় ৭ ও ৮ই নভেম্বর। এতে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ৪৬ জন সাধারণ মানুষ শহীদ এবং ৫ জন সাধারণ মানুষ আহত হন। অপরপক্ষে ২ জন অফিসারসহ ৫৫ জন পাকিস্তানি সৈনিক নিহত হয়।
সুষ্ঠুভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুজিবনগর সরকার- সারা দেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে এবং ৪টি ফোর্স গঠন করে। কুমিল্লা ছিল ২নং সেক্টরের অধীন এবং মেজর খালেদ মোশারফের নামে পরিচিত ‘কে’ ফোর্সের নিয়ন্ত্রণে। ২নং সেক্টরে ৬টি সাব-সেক্টর ছিল। মুরাদনগর, গঙ্গাসাগর, আখাউড়া এবং কসবা নিয়ে ছিল একটি সাব-সেক্টর। এ সাব-সেক্টরের প্রধান ছিলেন ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন। ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট এখানে যুদ্ধ করে।
কুমিল্লা জেলা শহর থেকে ৩৩ কিলোমিটার পশ্চিমে কুমিল্লা-ঢাকা সড়কে ময়নামতি ও দেবীদ্বার পেরিয়ে মুরাদনগরের কোম্পানীগঞ্জ বাজার। এখান থেকে কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর রোডে ৫ কিলোমিটার উত্তরে চাপিতলা বাসস্ট্যান্ড। এখানে একটি ব্রিজ আছে, যা স্থানীয়ভাবে গাঙ্গেঝুড়ি ব্রিজ নামে পরিচিত।
৭ই নভেম্বর চাপিতলা গ্রামে এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি সৈনিকদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। প্রথমত ২নং সেক্টরের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর এ টি এম হায়দার চাপিতলায় পাকিস্তানি সৈনিকদের রাস্তা পাকাকরণের কাজে বাধা দেয়ার পরিকল্পনা করেন। পরবর্তীতে চূড়ান্ত অনুমোদন আসে সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশারফের নিকট থেকে। এ নিয়ে উভয় পক্ষে যুদ্ধ বাঁধে। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন কামরুল হাসান ভূঁইয়া (পরবর্তীতে মেজর)। যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন হাবিলদার কুদ্দুস, হাবিলদার গাজী, নায়েক নুরুল হক, হাবিলদার রমিজ উদ্দিন ও গিয়াস উদ্দিন। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস যুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। সেদিন প্রাণপণ লড়াই করে দেশের স্বাধীনতার জন্য এডভোকেট সামছুল হক ফিরোজ (চাপিতলা), হুমায়ুন করিব (খোশঘর), আতিকুর রহমান (যাত্রাপুর), শাহজাহান (কুরুন্ডি), হানিফ মিঞা (মটকির চর), ফিরোজ আহমদ ভূঁইয়া (চাপিতলা), এস এম আলী আকবর (অনন্তপুর), লুৎফুর রহমান (খাপুড়া), আবুল কাশেম (বাঙ্গরা) এবং মুজিবুর রহমান (কাশিমপুর) বিশেষ অবদান রাখেন। মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য ও বাসস্থানের ব্যাপারে সহযোগিতা করেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক রফিকুল ইসলাম ওরফে সাহেব আলী ভূঁইয়া।
চাপিতলায় ৩টি ব্রিজে যুদ্ধ হয়। বিজ্রগুলো হলো— গাঙ্গেঝুড়ি ব্রিজ, নিমাইঝুড়ি ব্রিজ ও খাপুড়া ব্রিজ। চাপিতলার বড় খালটির প্রস্থ ছিল ৮০-৯০ ফুট। বর্ষাকালে এতে প্রচুর স্রোত থাকত। এটি দেবীদ্বারের রসুলপুরের কাছে গোমতী নদী থেকে বের হয়ে চাপিতলার মধ্য দিয়ে তিতাস নদীতে গিয়ে মিশেছে। এর ওপর গাঙ্গেঝুড়ি ব্রিজ অবস্থিত। এ ব্রিজ পার হয়ে শত্রুরা যাতে চাপিতলায় প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য ব্রিজের দুপাশে ২০ ফুট করে গর্ত করা হয়। এছাড়া সেতুটিতে সীমিত শক্তির ৩টি মাইন লাগানো হয়। সেগুলো বিস্ফোরিত হলে সেতুর ৩টি স্থানে বড় ধরনের ক্ষতি হয়।
চাপিতলা গ্রামে সুবিধা করতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা উত্তরদিকে সরে গিয়ে কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর সড়কের বাঙ্গরা, খাপুড়া ও খামার গ্রাম অংশে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। পাকসেনারা খামার গ্রামের প্রতিরক্ষা ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিকভাবে দৌলতপুরে ৭ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল পাঠিয়ে সেখানে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। রাজাকার-রা পাকসেনাদের ধারণা দেয় যে, কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর সড়ক হয়ে নবীনগর যেতে পারলে বৃহত্তর কুমিল্লার উত্তরাঞ্চল দখল করা সম্ভব হবে। কিন্তু চাপিতলাসহ নবীনগর এলাকা অপেক্ষাকৃত নীচু হওয়ায় নভেম্বর পর্যন্ত জলমগ্ন থাকে। আর স্থলপথে সেদিকে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর সড়ক। এটি টনকি থেকে নবীনগর পর্যন্ত কাঁচা। তখন রাজাকারদের সহযোগিতায় রাস্তাটি পাকা করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এদিকে ময়নামতি সেনানিবাস থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যেভাবেই হোক নবীনগরসহ বাঞ্ছারামপুর ও সরাইল এলাকা দখল করতে হবে। সে অনুযায়ী কমান্ডিং অফিসারসহ ২ জন সহযোগী অফিসারের তত্ত্বাবধানে ১ ব্যাটালিয়ন পাকিস্তানি সৈন্য সেখানে পাঠানো হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাজাকার প্রধান মাজেদুল ইসলাম ভূঁইয়ার সহযোগিতায় একটি দল ময়নামতি সেনানিবাস থেকে কোম্পানীগঞ্জ হয়ে গাড়িবহর নিয়ে টনকি গ্রামে অবস্থান নেয়। আরেকটি ক্ষুদ্র দল কোম্পানীগঞ্জ থেকে পশ্চিম দিকে গিয়ে নবীপুর হয়ে রঘুরামপুরস্থ মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে হামলা চালানোর উদ্দেশ্যে রওনা হয়। তৃতীয় দলটি কোম্পানীগঞ্জ পর্যন্ত এক সঙ্গে এসে কুমিল্লা-সিলেট সড়কে সিএন্ডবি ব্রিজের কাছে নেমে পায়ে হেঁটে চাপিতলা গ্রামের পূর্বদিক দিয়ে প্রবেশ করে। রাজাকার তমিজ উদ্দিন এ দলটিকে পথ দেখিয়ে খামার গ্রামে আবুল হাশেম এমএনএ-এর বোনের বাড়ি নিয়ে যায় এবং বাড়িটিতে অগ্নিসংযোগ করে। চাপিতলায় আবুল হাশেমের বাড়ি হওয়ায় এ গ্রামটি হানাদারদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। চাপিতলা যুদ্ধের আগেও কোম্পানীগঞ্জ ও সিএন্ডবি নামক স্থানে পাকিস্তানি সৈনিক ও মিলিশিয়াদের ক্যাম্প থেকে এ গ্রামের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখা হয় এবং মাঝে-মাঝে শেল নিক্ষেপ করা হয়। ২০শে অক্টোবর রাজাকারদের সহযোগিতায় এক প্লাটুন সৈন্য চাপিতলায় প্রবেশ করে। এ-সময় রাজাকার মর্তুজ আলী ভূঁইয়া ও আব্দুল হালিম ভূঁইয়ার সহযোগিতায় আবুল হাশেমের বাড়ি ও বাঙ্গরার রূপ বাবুর বাড়িতে লুটপাট করা হয়। এ-সময় তারা ৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁরা হলেন- শাহজাহান (পিতা ছায়েদ আলী, চাপিতলা), বিল্লাল হোসেন (পিতা রওশন আলী, মুরাদনগর) এবং রাজা মিয়া (মুরাদনগর)। এঁদের কুমিল্লা সেনানিবাসে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেখানে তাঁদের কবর সুরক্ষিত আছে।
৭ই নভেম্বর যুদ্ধের আশঙ্কা থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। তাঁদের অস্ত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ, জেলেটিন, এক্সপ্লোসিভ, গোলা- বারুদ, এনারগা-৯৪ রাইফেল, ৩৬ হ্যান্ড গ্রেনেড, এসএমজি, এসএমসি, এলএমজি, এন্টিপারসোনাল মাইন, এন্টি ট্যাংক মাইন, ২ ইঞ্চি মর্টার ইত্যাদি।
ঘটনার দিন একটি ছেলে দৌড়ে এসে কমান্ডার কামরুল হাসান ভূঁইয়াকে খবর দেয় যে, শত্রুরা রঘুরামপুরের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে হানা দিয়েছে এবং সেখান থেকে দ্রুত পূর্বদিকে এগিয়ে আসছে। তখন ধানি জমিতে সামান্য পানি ছিল। পাকিস্তানি সৈন্যরা তার মধ্য দিয়েই দ্রুত হাঁটতে থাকে। তাদের বাধা দেয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রবর্তী দল চাপিতলা-নিমাইঝুড়ি খালের ওপর অবস্থিত বর্তমান চাপিতলা বাসস্টেশন ব্রিজের পাশে প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলে। মুক্তিযোদ্ধারা আগে থেকেই ব্রিজের দুপাশের মাটি কেটে রেখেছিলেন। এছাড়া চাপিতলা গ্রামের দক্ষিণাংশে রূক্কু শাহ্র মাজারের পাশে অবস্থিত গাঙ্গেঝুড়ি ব্রিজ, বাসস্টেশন ব্রিজ ও খাপুড়া ব্রিজসহ টনকি থেকে খামারগাঁও মাদ্রাসা পর্যন্ত যতগুলো ব্রিজ ছিল, সবগুলোতেই মাইন বসানো ছিল। গনি নামের এক মুক্তিযোদ্ধা একাই ১৮টি স্থানে এ মাইনগুলো বসান।
বিষ্ণুপুর গ্রামের ভেতর দিয়ে আসা পাকিস্তানি সৈনিকদের আটকানোর জন্য মুক্তিযোদ্ধারা কমান্ডার কামরুল হাসান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হন। এ-সময় কমান্ডারের সঙ্গে ছিল হাবিলদার রমিজের প্লাটুন। শত্রুরা এফইউপি ছেড়ে এসাল্ট ফরমেশনে প্রচণ্ড ফায়ার করতে-করতে এগিয়ে আসে। কমান্ডার চিৎকার করে প্লাটুন কমান্ডার ইপিআর হাবিলদারকে বারবার ফায়ার করতে বলেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তিনি তা করেননি। পরিস্থিতি খারাপ দেখে কমান্ডার তখন সবাইকে দ্রুত পেছনে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। মুক্তিযোদ্ধারা সরে গেলে পাকিস্তানি সৈনিকরা চাপিতলা গ্রামের ৩৭ জন নারী- পুরুষকে নির্বিচারে হত্যা করে, ২১ জন নারীর শ্লীলতাহানি করে এবং ৩০টি বাড়ির দেড় শতাধিক ঘর জ্বালিয়ে দেয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা বাঙ্গরা, খাপুড়া ও খামারগাঁও এলাকায় অবস্থান নেন। গ্রামের রাস্তাঘাট না চেনার কারণে পাকিস্তানি সৈনিকরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে আঁচ করতে পারেনি। এছাড়া শত্রুদের সম্ভাব্য আগমন পথে মাইন বসানোর কারণে শত্রুরা সুবিধা করতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধারা ৮০টি স্মোক গ্রেনেড ফাটিয়ে ধূম্রজালের সৃষ্টি করেন এবং নিরাপদ স্থানে চলে যান। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরক্ষার সুবিধার্থে কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর রোডের পূর্ব পাশে খামারগাঁও মাদ্রাসা ও তার পশ্চিম পাশে কবরস্থানের নিকট বাংকার খনন করেছিলেন। রাত ৩টার দিকে পাকিস্তানি সৈনিকদের একটি দল মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে-খুঁজতে বাংকারের ২০০ গজের মধ্যে চলে আসে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড গুলির আঘাতে টিকতে না পেরে তারা নিহত ও আহতদের ফেলে চাপিতলা অজিফা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্পে ফিরে যায়। এরপর নৌকাযোগে আহত ও নিহতদের প্রথমে সিএন্ডবি ব্রিজের কাছে এবং সেখান থেকে গাড়ি করে ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়।
তৃতীয় আক্রমণ করা হয় ৮ই নভেম্বর সকাল ৯টার দিকে। খামারগাঁও গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তার পশ্চিম দিক থেকে শত্রুরা আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা সতর্ক অবস্থানে থাকায় তারা সুবিধা করতে পারেনি। এখানে দুপক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশ ছিলেন স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাই তাঁরা গুলির নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেননি। ফলে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র ও গোলা-বারুদ ক্ষয় হয়। গোলা-বারুদ সংগ্রহ করতে হলে ভারতের মেলাঘরে যেতে হবে। কিন্তু তখন তা সম্ভব ছিল না। ফলে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটার নির্দেশ দেন। গোলা-বারুদের ঘাটতি ছাড়াও পিছু হটার আরেকটি কারণ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ক্লান্তি। দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা অনেকেরই ছিল না। প্রথম দিন যুদ্ধ করে অনেকেই আহত ও ক্লান্ত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বেশিরভাগ ছিল ভারতীয় ৭-৬২ মিমি বোল্ট একশন রাইফেল। এ রাইফেল দিয়ে ফায়ার করে দুদিনেই তাঁদের হাতে ফোস্কা পড়ে যায়।
খামারগাঁও থেকে পিছিয়ে আসার আগেই মুক্তিযোদ্ধারা দৌলতপুরে মজবুত প্রতিরক্ষা গড়ে তুলেছিলেন। এখানে একটি এলএমজি-সহ ৭ জনের একটি সশস্ত্র দল প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখে প্রতিরক্ষা গুটিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বাঙ্গরার দিকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু এ অবস্থায়ও মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার রমিজ উদ্দিন যুদ্ধ চালিয়ে যান। এক সময় তাঁর গুলিও ফুরিয়ে যায়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আবুল বাশার (বলিঘর) ও বাচ্চু মিয়া (দেলবাড়ি)। রমিজ উদ্দিন এক কমান্ডারের কাছে গোলা- বারুদ চান। তিনি তাঁকে প্রায় ৪০০ রাউন্ড এমুনিশন পাঠান। তবে তাঁকে নির্দেশ দেয়া হয় প্লাটুন অপসারণ করতে। কিন্তু তিনি তাতে রাজি না হয়ে প্রাণপণে যুদ্ধ চালিয়ে যান। গুলি করতে-করতে তাঁরা ট্রেন্সের ওপরে উঠে একটি কবরস্থানের পাশে অবস্থান নেন। কিন্তু শত্রুর সংঘবদ্ধ আক্রমণে এক সময় তিনজনকেই শাহাদত বরণ করতে হয়। রমিজের গায়ে ৩৬টি গুলি লাগে। পাকিস্তানি সৈনিকরা খামারগাঁও গ্রামে প্রবেশ করে ৬ জনকে হত্যা করে এবং ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তারপর তারা তাণ্ডব চালাতে-চালাতে কাশিমপুরের পীর সাহেব (গফুর চিশতি)-এর বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার পথে দৌলতপুরে ৩ জনকে হত্যা করে ময়নামতি সেনানিবাসে ফিরে যায়।
চাপিতলা যুদ্ধে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি এলাকাবাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধারা আসেন ভারতের মেরাবহ ক্যাম্প থেকে। সেখান থেকে কমান্ডার কামরুল হাসান ভূঁইয়া, হাবিলদার রমিজ উদ্দিন, হাবিলদার কুদ্দুস, নায়েক নুরুল হকসহ একটি সুসজ্জিত বাহিনী যুদ্ধের দুদিন আগে চাপিতলার অদূরবর্তী কাশিমপুর গ্রামে পৌঁছলে এলাকাবাসী তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সৈন্যরা বাড়ি-বাড়ি গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান ও নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করতে থাকলে, স্থানীয় অহিদউল্লাহ কেরানী রাইফেল দিয়ে গুলি করে ৬ জন পাকিস্তানি সৈনিককে হত্যা করে এবং পরবর্তীতে স্ত্রীপুত্রসহ পাকসেনাদের গুলিতে তিনি শহীদ হন।
চাপিতলা যুদ্ধে পাকিস্তানি সৈনিকরা চাপিতলার ৩৭ জন, খামারগাঁওর ৬ জন এবং দৌলতপুরের ৩ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ২ জন অফিসারসহ ৫৫ জন পাকিস্তানি সৈনিক নিহত হয়। অপরদিকে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁরা হলেন- রমিজ উদ্দিন (পিতা মোছলেহ উদ্দিন, পুস্কুনীরপাড় ইপিআর), আবুল বাশার (পিতা পরচান মিয়া, বলিঘর; ছাত্র) ও বাচ্চু মিঞা (পিতা চেরাগ আলী, দেলবাড়ি)। প্রথম দুজনের কবর খামারগাঁও (কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর রোডের পাশে) রাস্তার পাশে সংরক্ষিত আছে।
চাপিতলা যুদ্ধে গণশহীদরা হলেন- চাপিতলার আকবর আলী (পিতা মোকছেদ আলী), অহিদউল্লাহ কেরানী (পিতা অজিদ উল্লাহ), আব্দুল গফুর (পিতা আহসান উল্লাহ), সুলতান আহমদ (পিতা সানাউল্লাহ), সুন্দর আলী (পিতা সানাউল্লাহ), হারুনুর রশিদ (পিতা সুলতান আহমদ), আবদুল কাদির (পিতা আব্দুল মজিদ), ওহাব আলী (পিতা নেয়াব আলী), আব্দুল জব্বার (পিতা ফৈজউদ্দিন ডলু), মর্তুজা আলী (পিতা নোয়াব আলী), মনিরুল হক (পিতা ছায়েদ আলী), আমির আলী (পিতা আশ্রাফ আলী ভূঁইয়া), আবু তাহের (পিতা আব্দুল মজিদ), জোহর আলী (পিতা মহব্বত আলী), আব্দুল মালেক (পিতা ফৈজ উদ্দিন), সূর্যমোহন দেবনাথ (পিতা সর্বানন্দ দেবনাথ), সুবেদ আলী (পিতা জয়নাল আবেদীন), পিয়ারি দেবনাথ (পিতা পরশুরাম দেবনাথ), সোনা মিঞা (পিতা মঞ্জুর আলী), অলিঙ্গ দেবনাথ (পিতা পরশুরাম দেবনাথ), আব্দুল মিঞা (পিতা চান্দু মিঞা), আব্দুর রশিদ (পিতা তাইজ উদ্দিন), ইদ্রিস মিঞা (পিতা লাল মিঞা), ছিদ্দিকুর রহমান (পিতা তাইজ উদ্দিন), কানু মিঞা (পিতা অছেক মিঞা), চিন্তাহরণ সিংহ রায় (পিতা প্রসন্ন সিংহ রায়), মমিনা খাতুন (পিতা আব্দুর রাজ্জাক কুডু), আব্দুল হালিম (পিতা মনসুর আলী চাপরাসী), হোরন আলী (পিতা রোসমত আলী), আবু মিয়া (পিতা মুসকত আলী), জনৈক আবু মিয়ার স্ত্রী, মনির হোসেন, নুরু মিঞা, জনৈক আকবর আলীর স্ত্রী, আব্দু মিঞা (পিতা মনসুর আলী), রাজা মিঞা (পিতা নজমুদ্দিন); খামারগাঁওয়ের শের আলী (পিতা চেরাগ আলী), শাহ্জাহান (পিতা শের আলী), নজীব আলী (পিতা আব্দুল্লাহ), মিন্নত আলী (পিতা অহিদ উল্লাহ), রহিমা আক্তার, জহির আলী (পিতা আম্বর আলী) এবং দৌলতপুরের হাশেম মিঞা (পিতা শহিদুল্লাহ), কাশেম মিঞা (পিতা শহিদুল্লাহ) ও জয়দুল হোসেন (পিতা আলফাজ আলী সরকার)। চাপিতলার একজন শহীদের নাম জানা যায়নি।
চাপিতলা যুদ্ধে ৫ জন গ্রামবাসী আহত হয়েছিলেন। তারা হলেন— মো. সফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া (পিতা আছমত আলী ভূঁইয়া), জয়দল হোসেন (পিতা চাঁন বক্স), জব্বর আলী (পিতা হাজী আব্দুস সোবহান), ইয়েব আলী (পিতা মুক্তল হোসেন) এবং জনৈক ক্ষেত্রমোহন নাথের স্ত্রী। [মমিনুল ইসলাম মোল্লা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড