You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে চারঘাট উপজেলা (রাজশাহী)

চারঘাট উপজেলা (রাজশাহী) রাজশাহী জেলার সীমান্তে অবস্থিত। ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই এ অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে চারঘাটের জনগণ তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এ-সময় এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন ভালো ছিল না। রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ শুনে এখানকার জনগণ স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্ধুদ্ধ হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর আনসার বাহিনীর সদস্য মো. মকিবার রহমান (পরবর্তীতে অনারারি ক্যাপ্টেন)-এর নেতৃত্বে ডা. মো. আলাউদ্দিন এমপিএ, মো. রায়হান (প্রাক্তন এমপি), মো. নূরুল হক (চেয়ারম্যান, চারঘাট ইউনিয়ন), আব্দুর রশিদ (ইউসুফপুর) প্রমুখ একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনসার, ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার এবং সাধারণ জনগণ এর সদস্য ছিল। আওয়ামী লীগ- নেতৃবৃন্দ স্থানীয় ছাত্র-জনতাকে নিয়ে ২৭শে মার্চ সকালে পুলিশ একাডেমির অস্ত্রাগার দখল করেন। অস্ত্রাগারের দায়িত্বে নিয়োজিত এসআই গাজীর সহায়তায় প্রায় অর্ধশত প্রতিরোধযোদ্ধা একটি করে ৩০৩ রাইফেল ও ২৫ রাউন্ড গুলি পান। নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস্-এ কর্মরত আদিবাসী সাঁওতালরা তীরধনুক চালাতে সিদ্ধহস্ত ছিল। তাদের সংস্পর্শে এসে অনেক বাঙালিও তীরধনুক চালানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আব্দুল লতিফ মোল্লা (পিতা মোজাহার মোল্লা, বামুনদীঘী) ২০ জনের অধিক যোদ্ধা নিয়ে একটি তীরন্দাজ বাহিনী গঠন করেন। চারঘাট থানাটি পদ্মানদীর তীরে অবস্থিত হওয়ায় অনেক মুক্তিযোদ্ধা নৌকায় চরে ভারতে গমন করেন এবং মুর্শিদাবাদ জেলার পানিপিয়া, নন্দিভিটা ও কাজিপাড়া ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কুচবিহার ও হাফলং-এ পাঠানো হতো।
চারঘাট উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা আজিজুর রহমান, এসলাম খলিফা, জবদুর রহমান এবং ছাত্রলীগ-এর মো. আনোয়ার হোসেন, মো. আবু ওবায়দুর রহমান, মো. মোকারম হোসেন, আব্দুস সামাদ প্রমুখ। উপজেলায় কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন বজলুর রশিদ এবং প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন মো. আবু ওবায়দুর রহমান, মো. মোকারম হোসেন ও মো. মকিবার রহমান।
১৯৭১ সালে উপজেলার চারঘাট, ইউসুফপুর, মিরগঞ্জ ও আলাইপুরে ইপিআর বাহিনীর চারটি ফাঁড়ি ছিল। এ উপজেলায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি ও রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধকালে পুলিশ একাডেমি ও ক্যাডেট কলেজকে কেন্দ্র করে পাকবাহিনী এখানে একটি ক্যান্টনমেন্ট গড়ে তোলে। অন্যদিকে ৭নং সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ শেখপাড়া সাব-সেক্টরের সদর দপ্তরটি উপজেলা সদরের বিপরীতে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত। তাই কৌশলগত কারণে চারঘাটের দিকে পাকবাহিনীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল। ৩০শে মার্চ সকালে তারা পায়ে হেঁটে ঈশ্বরদী থেকে আড়ানী হয়ে রাজশাহী রওনা দেয়। সরদহ বাজারে এ খবর পৌঁছলে মকিবার রহমান এবং এসআই গাজীর নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা তাদের প্রতিরোধ করার জন্য একটি ট্রাকে করে আড়ানী রেলওয়ে ব্রিজের নিকট গিয়ে অবস্থান নেন। রাত ১২টার দিকে পাকবাহিনী ব্রিজের নিকট এলে প্রতিরোধযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলির এক পর্যায়ে পাকবাহিনী পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর ব্যবহৃত চারটি চাইনিজ রাইফেল ও কিছু গুলি প্রতিরোধযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। এটি আড়ানী রেলওয়ে ব্রিজ প্রতিরোধযুদ্ধ নামে পরিচিত।
৩১শে মার্চ বুধবার সকালে পুড়াভিটা-বালুদিয়াড় প্রতিরোধযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ-সময় নন্দনগাছী রেলওয়ে স্টেশন থেকে কয়েকজন পাকসেনা পায়ে হেঁটে শালুয়ার দিকে যাচ্ছিল। নন্দা ফার্মের সাঁওতাল আদিবাসীদের নিকট থেকে এ সংবাদ পেয়ে আব্দুল লতিফ মোল্লার নেতৃত্বে দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত ৩০ জনের অধিক একটি তীরন্দাজ বাহিনী পুড়াভিটা ও বালুদিয়াড়ের মাঝখানে রেল লাইনের ওপর পাকসেনাদের আক্রমণ করে। উভয় পক্ষের এই সম্মুখ যুদ্ধে তিনজন পাকসেনা নিহত হয় এবং আব্দুস সুবাহান নামে একজন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। এ-যুদ্ধে তিনটি চাইনিজ রাইফেল তীরন্দাজ বাহিনীর হস্তগত হয়।
১৩ই এপ্রিল বানেশ্বরে গণহত্যা পরিচালনা করে গাড়ির বিশাল বহর নিয়ে পাকবাহিনী চারঘাটের দিকে অগ্রসর হয়ে বেলা ১১টার দিকে সারদা ট্রাফিক মোড়ের নিকট পৌঁছায়। পূর্ব থেকে টিএন্ডটির নিকট বাংকারে অবস্থান নেয়া স্বেচ্ছাসেবকদের একট দল পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করে। কিন্তু পাকসেনাদের শক্তিশালী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে প্রতিরোধ ছেড়ে তাঁরা পিছু হটেন। এ-যুদ্ধে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এটি সারদা ট্রাফিক মোড় প্রতিরোধযুদ্ধ নামে পরিচিত।
রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের প্রভাষক এ বি সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা চারঘাটে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রতিরোধযোদ্ধারা বেশিক্ষণ টিকতে না পেরে পিছু হটেন।
১৩ই এপ্রিল পাকবাহিনী চারঘাট উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে এবং সারদা পুলিশ একাডেমি ও রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে ক্যাম্প স্থাপন করে। এ-দুটি ক্যাম্প থেকে তারা বিভিন্ন স্থানে অপারেশন চালাত। অনুপ্রবেশকালে পাকবাহিনী সারদা পুলিশ একাডেমি, মুক্তারপুর, আস্করপুর, নতুনপাড়া, কুটিপাড়া, থানাপাড়া ও গৌড়শহরপুর এলাকায় গণহত্যা চালায়।
পাকবাহিনীর দোসর হিসেবে চারঘাটে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। উল্লেখযোগ্য রাজাকাররা হলো— মো. কোরবান আলী (হাট ঝিকরা), মো. কাচু মিয়া (থানাপাড়া), মো. শাবান আলী (বৌড়শহরপুর) প্রমুখ। চারঘাট থানায় সরদহ ইউনিয়ন পরিষদ ছিল রাজাকারদের প্রধান প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের হাতে একটি করে রাইফেল দেয়া হতো। রাজাকারদের প্রতিমাসে ১০০ (একশত) টাকা বেতন ও তিনবেলা খাবার দেয়া হতো। পাকবাহিনী রাজাকারদের দিয়ে বিভিন্ন স্থাপনা পাহারা দেয়ার কাজ করাত। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অভিযান এবং অগ্নিসংযোগসহ নির্যাতনের ক্ষেত্রে রাজাকাররা মুখ্য ভুমিকা পালন করে। ১৩ই এপ্রিল চারঘাটের প্রবেশমুখে পাকবাহিনী বানেশ্বরের নাদের চেয়ারম্যানকে হত্যা করে। একইদিন তারা মাড়িয়া গ্রামে অভিযান চালিয়ে ১৪ জনকে হত্যা করে, যা মাড়িয়া গণহত্যা নামে পরিচিত। গণহত্যার পাশাপাশি তারা গ্রামের ঘরবাড়ি এবং বাজারের দোকানে অগ্নিসংযোগ করে। এরপর তারা সারদা থেকে শুরু করে চারঘাট বাজার হয়ে থানা পর্যন্ত ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায়। তারা মুক্তারপুর, আস্করপুর, নতুনপাড়া, কুটিপাড়া, থানাপাড়া ও গৌড়শহরপুর গ্রামের ১৮১ জন মানুষকে হত্যা করে। এটি চারঘাট গণহত্যা হিসেবে পরিচিত)।
১৩ই এপ্রিল পাকবাহিনী সারদা পুলিশ একাডেমি দখল করে ক্যাম্প স্থাপন করে এবং একাডেমিসংলগ্ন গ্রামগুলোতে অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীকে হত্যা করে, যা সারদা গণহত্যা- নামে পরিচিত। গণহত্যা শেষে তারা লাশগুলো পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এ গণহত্যায় থানাপাড়া গ্রামের প্রায় সব কর্মক্ষম পুরুষ শহীদ হন এবং ব্যাপক সংখ্যক মহিলা বিধবা হন। এরপর থেকে গ্রামটি বিধবাদের গ্রাম হিসেবে পরিচিত হয়। একই দিন পদ্মারচর গণহত্যা সংঘটিত, যাতে প্রায় ৪০০ নিরীহ মানুষ শহীদ হন।
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পাকবাহিনী শিবপুর গ্রামে বিমান হামলা চালায়। এ হামলায় তেনী নামে একজন নারী নিহত হন এবং অসংখ্য ঘরবাড়ি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ১৩ই এপ্রিল থানাপাড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মো. খুরশিদ আলম শিবলীর পিতা আজিজুর আলম ও ভাই পরাগ পদ্মার চরে পাকবাহিনীর হাতে নিহত হন। এ হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মো. শিবলী ১লা জুন দুজন সহযোদ্ধা আফসার উদ্দিন ও রিয়াজ উদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে ইউসুফপুরের বাদুড়িয়াতে একটি অপারেশন চালানোর জন্য আসেন। কিন্তু সে-রাতে অপারেশন চালানো সম্ভব হয়নি৷ তাই তাঁরা ইফসুফপুরের কারিগর পাড়া নিবাসী স্কুল শিক্ষক করিম মাস্টারের বাড়িতে অশ্রয় নেন। কিন্তু করিম মাস্টারের বিশ্বাসঘাতকতায় তাঁরা পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। পাকবাহিনী তাঁদের সারদা পুলিশ একাডেমিতে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য আদায়ের নির্মমভাবে নির্যাতন করে। কিন্তু তাঁরা কোনো তথ্য দেননি, বরং শিবলী বলেছেন পাকিস্তানকে তাঁরা ঘৃণা করেন, তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চান। এজন্য তাঁর ওপর নির্মম অত্যাচার করা হয়। তাঁর গায়ের চামড়া তুলে নেয়া হয়, ফাটা বাঁশের মধ্যে পা ঢুকিয়ে তাঁকে নির্যাতন করা হয়। এক পর্যায়ে তাঁদের তিনজনেরই চোখ বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নষ্ট করে দেয়া হয়। কিন্তু তখনো তাঁরা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দেন। অতঃপর ৩রা জুন পাকসেনারা চারঘাট ডাকবাংলোর সামনে নিয়ে তাঁদের হত্যা করে বড়াল নদীতে ফেলে দেয়। শিবলীর মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য পাকসেনারা তাঁর পায়ের গোড়ালির শিরা কেটে দেয়। পরে পুত্রশোকে পাগলপ্রায় শিবলীর মা জাহেরা খাতুন ছেলের লাশ নদী থেকে তুলে বাড়ির পাশে কবর দেন। অন্য দুজনের লাশ পাওয়া যায়নি। পাকবাহিনী চারঘাট এলাকায় ব্যাপক নারীনির্যাতন চালায়। নির্যাতনের শিকার বেশির ভাগ নারী পুলিশ একাডেমির পার্শ্ববর্তী গ্রাম থানাপাড়া, নতুনপাড়া, কুটিপাড়া ও গৌড়শহরপুর গ্রামের। পাকসেনারা বিভিন্ন অজুহাতে পার্শ্ববর্তী গ্রামে যেত এবং সুযোগ বুঝে নারীদের ধরে এনে কিংবা তাদের বাড়িতেই পাশবিক নির্যাতন চালাত। তাদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হন জাহেদা, এক অন্তঃসত্ত্বা নারী, রুমা, তহমিনা, শিশুকন্যা রোকেয়া প্রমুখ। তাছাড়া পুত্র ইপিআর সদস্য হওয়ায় বৃদ্ধ মাতা মহিজান বেওয়াকে পাকবাহিনী ক্যাম্পে নিয়ে আটকে রাখে। নারীনির্যাতনের প্রতিবাদ করায় পাকবাহিনী থানাপাড়ার মহসিনকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
তবে ঐসময় এখানে নারীনির্যাতনের এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ছিলেন পারুল বেগম (স্বামী মো. মোসলেম আলী, থানাপাড়া)। পিতার চাকরির সুবাদে করাচিতে লেখাপড়া করায় তিনি ভালো উর্দু বলতে পারতেন। পাকসেনারা গ্রামে প্রবেশ করলে অনেকে ভয়ে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিত। তিনি উর্দুতে পাকসেনাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন আর তখন তারা গ্রাম ছেড়ে চলে যেত।
১৩ই এপ্রিল পাকবাহিনী সারদা পুলিশ একাডেমি দখল করার সময় সরদহ বাজার ও চারঘাট বাজারে অগ্নিসংযোগ করে এবং দোকানের মালামাল লুট করে। পুলিশ একাডেমিতে ক্যাম্প স্থাপন করার পর পাকবাহিনী এবং তাদের দোসররা ডাকরাবাজার, নন্দনগাজী বাজার ও ইউসুফপুর বাজার লুট করে। তারা হিন্দুপাড়া, ঘোষপাড়া, কারিগর পাড়া, জেলেপাড়া, পালপাড়া, হেমন্তবাবুর বাড়ি, চারঘাট বাজারস্থ মারোয়াড়িদের বাড়ি এবং কামনীর হিন্দুপাড়ার অধিকাংশ ঘরবাড়িতে লুটপাট চালায়। পাকবাহিনীর নির্যাতন ও অত্যাচারে চারঘাট বাজারের প্রায় অর্ধশতাধিক মারোয়াড়ি পরিবার, উপজেলার অধিকাংশ হিন্দু পরিবার এবং ৪-৫ হাজার মুসলিম পরিবার শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেয়। চারঘাট পুলিশ একাডেমি ও রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির।
চারঘাট উপজেলায় দুটি বধ্যভূমি ও দুটি গণকবর রয়েছে। সারদা পুলিশ একাডেমি এবং লা দারা মাঠ ছিল পাকবাহিনীর বধ্যভূমি। পিটিসির প্রাচীরসংলগ্ন পূর্বপাশে ডাক্তার রজনীর পুকুর পাড় এবং রায় সাহেবের ইটভাটায় গণকবর রয়েছে। চারঘাটে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনী কয়েকটি অপারেশন পরিচালনা করে। তার মধ্যে ডাকরাহাট অপারেশন চারঘাট ইপিআর বিওপি অপারেশন – এবং সারদা পুলিশ একাডেমি অপারেশন – উল্লেখযোগ্য। কমান্ডার নজির, আজাদ আলী ও রুস্তম আলীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ডাকরাহাট অপারেশন চালান। এ অপারেশনে পাকবাহিনীর একজন দালাল নিহত এবং একজন রাজাকার আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা মো. হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে জহুর, মান্নান প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা চারঘাট ইপিআর বিওপি ক্যাম্পে অপারেশন চালান। এ অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পে অবস্থানরত রাজাকারদের পরাস্ত করেন। সেপ্টেম্বর মাসে হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা সারদা পুলিশ একাডেমিতে অপারেশন চালান। এ অপারেশনে ২৪- ২৫ জন পাকসেনা হতাহত হয়। ১৬ই ডিসেম্বর চারঘাট উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
চারঘাট উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. খুরশিদ আলম শিবলী (পিতা আজিজুর আলম, থানাপাড়া, চারঘাট সদর), আফছার উদ্দিন (পিতা মহির উদ্দিন, খোদ্দগোবিন্দপুর, ঝিকরা), রিয়াজ উদ্দিন (পিতা মাতু সেখ, খোদ্দগোবিন্দপুর, ঝিকরা), ইছাহাক (পিতা আব্দুর রশিদ, অনুপামপুর), চান মিয়া (পিতা হোসেন প্রামাণিক, আস্করপুর, সরদহ), মো. ইউসুফ আলী (পিতা হাচেন মোল্লা, গৌড়শহরপুর, সরদহ), মো. জালাল উদ্দিন (পিতা ইসমাইল হোসেন, কালাবীপাড়া, নন্দনগাছী), সাইদুর রহমান সাজু (পিতা আবুল কাশেম সরকার, চারঘাট), নবীর হোসেন (পিতা নেডু শেখ, গৌড়শহরপুর, সরদহ) ও মো. আবুল কাশেম (পিতা ওসমান আলী মিয়া, কালাবীপাড়া, নন্দনগাছী)।
চারঘাট উপজেলার শহীদদের স্মরণে সারদা পুলিশ একাডেমিতে একটি, বামুনদীঘী হাটে একটি এবং সারদা থানাপাড়ায় পল্লী বিদ্যুৎ মোড়ে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা আফসার উদ্দিন ও রিয়াজ উদ্দিন স্মরণে খোদ্দগোবিন্দপুর মোড়ে (নিতাই সাহার মোড়ে) একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে এবং রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে শহীদদের একটি নামফলক স্থাপন করা হয়েছে। [মো. সোনাউল হক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!