চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানা আক্রমণ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর)
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানা আক্রমণ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর) পরিচালিত হয় ১৪ই আগস্ট। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় হয়।
১৪ই আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার হরিপুর পুল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর ও আমনুরায় পাকসেনাদের অবস্থানে ত্রিমুখী আক্রমণ করেন। তখন পাকবাহিনীর একটি ইনফ্যানট্রি ব্যাটালিয়ন ও একটি কোম্পানি চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে নিয়োজিত ছিল।
রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের ওপর অবস্থিত হরিপুর পুলের ওপর দুই সেকশনের কিছু বেশি সেনা পাহারারত ছিল। আমনুরা রেলওয়ে স্টেশনে ছিল এক প্লাটুন সেনা। আর এক প্লাটুন ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ স্টেশনে। এ প্লাটুনদুটির কাছে একটি ইঞ্জিন ও দুটি করে বগি থাকত। রাতে তারা আমনুরা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাঝে পেট্রলিং করত। এছাড়া এক প্লাটুন সেনা আমনুরা রেললাইনের কাছে বিদিরপুর নামক স্থানে দুটি রেলপুল পাহারা দিত।
আগস্ট মাসে রাজশাহীর সমগ্র পূর্বাঞ্চলের বন্যাকবলিত মানুষ যখন অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে দিনাতিপাত করছিল, তখন পাকবাহিনী জাঁকজমকের সঙ্গে ১৪ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় আলবদর- বাহিনীর কিছু সদস্য। পাকসেনাদের প্রশংসা করার জন্য বিকেলে নবাবগঞ্জ বিডি হলে সংবর্ধনা সভা ডেকে শহরের কিছু লোককে ভাড়া করা হয়। এ-রকম পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধারা এ আক্রমণ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন।
এ অপারেশনের জন্য মেজর গিয়াস ৮৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বাছাই করে তাঁদের তিনটি দলে বিভক্ত করে নিজে নেতৃত্ব দেন। ফরিদপুর বিওপি-তে সেদিন সকাল ৭টায় তিনি এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধাকে একত্রিত করেন। পদ্মা ও মহানন্দা নদীর মাঝামাঝি এ বিওপি-সহ আরো ৪টি বিওপি জুড়ে প্রায় ২শ বর্গমাইল এলাকা ২৬শে মার্চের পর থেকে মুক্ত ছিল। পাকবাহিনী বহু চেষ্টার পরও এ এলাকা অধিকার করতে পারেনি। অপারেশনের জন্য ৮৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে গঠিত তিনটি দলকে মেজর গিয়াস দায়িত্ব প্রদান করেন এভাবে-
(ক) প্রথম দলে ছিলেন ২০ জন যোদ্ধা। কমান্ডার নিযুক্ত হন সুবেদার ইসমাইল। তাঁকে ৩টি মাঝারি মর্টার আর ৯০টি বোমা দেয়া হয়। এ দলের দায়িত্ব ছিল রাত ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত গোলাবর্ষণ করা।
(খ) দুই নম্বর দলের ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডার নিযুক্ত হন সুবেদার আমিরুজ্জামান। এ দলের দায়িত্ব ছিল হরিপুর পুলের ওপর হামলা করা এবং প্রহরারত হানাদার বাহিনীর সদস্যদের হত্যা অথবা বন্দি করে পুলটিকে উড়িয়ে দেয়া, যাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আর রাজশাহীর মধ্যকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
(গ) তৃতীয় দলের কমান্ডার ছিলেন নায়েক সুবেদার আমান উল্লাহ। এ দলের ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বিদিরপুর রেলওয়ে পুলটি উড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব প্রদান করা হয়৷
সকাল ৯টায় মুক্তিযোদ্ধারা ছয়টি নৌকায় গন্তব্যস্থলের উদ্দেশে রওনা হন। সবমিলে ১৭ মাইল রাস্তা অতিক্রম করতে হয় তাঁদের। সন্ধ্যার দিকে লক্ষ্যস্থলের দুমাইলের মধ্যে পৌছে যান তাঁরা। গন্তব্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছে হরিপুর পুলের প্রায় ৬শ গজ পেছনে এক নম্বর ও দুই নম্বর দলকে অবস্থান নিতে মেজর গিয়াস নির্দেশ দেন। তখন রাত ৯টায় তিন নম্বর দলকে দুটি নৌকায় করে পাঠানো হয় বিদিরপুর রেলওয়ে পুলের উদ্দেশ্যে। এক নম্বর দলকে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়ার কথা বলে দুই নম্বর দলকে দুভাগে বিভক্ত করে পুলের দিকে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেন। পুলের প্রায় ১০০ গজের মধ্যে পৌছাতেই আধো আলো আর ছায়ার মধ্যে কিছু লোককে পুলের পাশে অবস্থান নিতে দেখা যায়। অত্যন্ত সতর্কভাবে অগ্রসর হওয়ার পরও শত্রুপক্ষ পুলের ওপর থেকে এলএমজি ও রাইফেল দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলি চালায়। কালবিলম্ব না করে মুক্তিযোদ্ধারাও শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। পেছন থেকে তাঁদের মেশিনগানের সহায়তা দেয়া হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যে পুল মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে ২ জন শত্রুসৈন্য নিহত হয়। অন্য ২ জন ঝাঁপ দিয়ে নদীতে পড়ে পালিয়ে যায়। একজন আহত হয় এবং বাকি ১১ জন শত্রুসেনা বন্দি হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজন শহীদ ও একজন আহত হন।
পুল দখল করার সঙ্গে-সঙ্গে এক নম্বর দল পুলের ওপর দিয়ে : চাঁপাইনবাবগঞ্জের দিকে দ্রুত অগ্রসর হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর থেকে মাত্র এক হাজার গজ দূরে রাস্তার পাশে মুক্তিযোদ্ধারা মর্টারের জন্য স্থান বেছে নেন এবং শহরের ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করেন। শত্রুপক্ষ এত কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের আশা করেনি। হানাদার বাহি” র আয়োজিত মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান সে-সময় জমে উঠছিল। কিন্তু প্রথম গোলা বিডি হলের কাছে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে প্রধান অতিথিসহ অন্যরা হল ছেড়ে পালিয়ে যায়। আলবদর, আলশামস – আর পাকসেনাদের কিছু সদস্যও শহর থেকে পালাতে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় দলটি তাঁদের অবস্থান পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই শত্রুসেনারা মেশিনগান আর রাইফেল থেকে গুলি ছোড়া শুরু করে। এ দল বিদিরপুর রেলওয়ে পুলটি দখল করতে পারেনি। এদিকে দুই নম্বর দল হরিপুর পুল ওড়াবার কাজ চালিয়ে যায়। পুলের গোড়ার কাছে ৫ ফুট পরিমাণ জায়গা খুঁড়ে ‘ডিপ মাইন’ চার্জ বসানো হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০০ পাউন্ড বিস্ফোরকের প্রয়োজন ছিল, যা সাধারণত খনিজ পদার্থের মাইন ফিল্ডে ব্যবহার করা হয়। ৬টি পুরাতন ধরনের ব্রিটিশ এ্যান্টি-ট্যাংক মাইন ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। সেগুলো জুড়ে দেয়া হয় পুল ওড়াবার জন্য। ১১০ পাউন্ড বিস্ফোরক দিয়ে প্রেশার চার্জ লাগানো হয়। মাটি ভার দিয়ে ডিপ মাইন চার্জ আর পুলের ওপর প্রেশার চার্জ লাগিয়ে রিংমেন সার্কিট লাগানো হয় কর্ডেক্স-এর সাহায্যে। ইতোমধ্যে মর্টার গ্রুপের কয়েকজন ফেরত এসে এ দলের সঙ্গে যোগ দেন।
রাত ঠিক ১২টা ৫ মিনিটে গগনবিদারী আওয়াজে বিস্ফোরণ ঘটে। আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মুক্তিযোদ্ধারা ছুটে যান পুলের অবস্থা দেখতে। তখন পুল আর সম্পূর্ণ দেখা যাচ্ছিল না, অর্ধেকটা কাত হয়ে পড়ে গিয়েছিল। শত্রুর যে দুই প্লাটুন সেনা আমনুরা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ছিল, তারা মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির আওয়াজে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তাদের পেট্রলে নামার রাস্তার দিকে রওনা দেয়। আমনুরা থেকে আগত পেট্রলটি পুলের কাছে পৌঁছে। আমনুরার পেট্রলটি মুক্তিবাহিনী চাঁপাইনবাবগঞ্জ দখল করে নিয়েছে মনে করে, অথচ তাদেরই লোকজন সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। নিজেদের মধ্যে তারা বেশ কিছুক্ষণ গোলাগুলি চালায়। সুযোগ বুঝে পুল ধ্বংসের উদ্দেশ্যে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দল সেখান থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। নিজেদের গুলিতে সেদিন শত্রুপক্ষের ৬ জন নিহত ও ৭ জন আহত হয়। এ আক্রমণে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ২ জন আহত হন। [মাযহারুল ইসলাম তরু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড