মুক্তিযুদ্ধে চাটখিল উপজেলা (নোয়াখালী)
চাটখিল উপজেলা (নোয়াখালী) ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল রামগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ২১শে জুলাই রামগঞ্জ থানার ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে চাটখিল উপজেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই এ অঞ্চলের ছাত্রসমাজ পাকিস্তানি শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এ বাঙালিদের প্রতি স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানালে তাতে সাড়া দিয়ে চাটখিলের ছাত্র-জনতা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
চাটখিলে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন- মো. আব্দুল রশিদ এমএনএ, নূরুল আহমেদ কালু চৌধুরী এমপিএ, গিয়াসউদ্দিন মাস্টার (থানা আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি), হাবিবউল্যা (থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক), আবুল কাশেম চৌধুরী (থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি), শওকত কামাল (নোয়াখালী জেলা ছাত্রলীগ-এর প্রচার সম্পাদক), মাওলানা বাকী, গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী, রহমত উল্যাহ মিয়া, ইউসুফ মিয়া, আবুল কাশেম পাটোয়ারী, জালাল আহমদ, জি এম রুহুল, আবদুর রব চৌধুরী, আবদুল মান্নান (ছাত্রলীগ নেতা), বজলুর রশিদ চৌধুরী, কমরেড নূরুল ইসলাম (শ্রমিক নেতা), সামছুল আমিন, প্রধান শিক্ষক আমিন উল ইসলাম, আতিক উল্যা চুন্নু প্রমুখ। এঁদের নেতৃত্বে এখানে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে ছুটিতে থাকা এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনা-সদস্যরা বিভিন্ন স্কুল ও কলেজ মাঠে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। ডামি রাইফেল ও বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলে।
চাটখিলের যুদ্ধকালীন থানা কমান্ডার ছিলেন সিরাজুদ্দৌলা, ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন আমির হোসেন। দত্তপাড়া কলেজ টিমের কমান্ডার ছিলেন শওকত কামাল। জোনাল কমান্ডার ছিলেন একরামুল হক।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন নোয়াখালীতে প্রবেশ করতে শুরু করে, তখন চাটখিলের মুক্তিকামী মানুষ এখানকার প্রবেশ পথের পুল ও কালভার্টগুলো ভেঙ্গে এবং কিছু-কিছু রাস্তা কেটে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এছাড়া মল্লিকা দিঘীর পাড়ে রাস্তার পাশে তারা কয়েকটি বাংকার খনন করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এ উপজেলায় তেমন কোনো ভালো রাস্তা ছিল না। এটা ছিল একটা বিছিন্ন দ্বীপের মতো। তাই পাকবাহিনী এখানে কোনো ক্যাম্প স্থাপন করতে পারেনি। ২৭শে এপ্রিল সকালে তারা প্রথম এখানে অনুপ্রবেশ করে এবং বিকেলে এখান থেকে চলে যায়।
পাকবাহিনী এ উপজেলায় জামায়াতে ইসলামী ইসলামী ছাত্র সংঘ, মুসলিম লীগ, এনএসএফ ও <নেজামে ইসলামী-র কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে রাজাকার- বাহিনী গঠন করে। রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার ছিল আনোয়ার হোসেন। পাকবাহিনীর দোসর হিসেবে তৎপর ছিল মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মোজাম্মেল হক, এমদাদ উল্যা মুন্সি, সামসুল হক, লুৎফর রহমান মাস্টার, আবু সুফিয়ান প্রমুখ।
১৩ই মে ভোরে শতাধিক পাকসেনা কড়িহাটি বাজারে প্রবেশ করে মালামাল লুণ্ঠন করে। তারা নারীনির্যাতন চালায় এবং বহু লোককে ধরে এনে মারধর ও বেয়নেট চার্জ করে। তারা মাস্টার বীরেন্দ্র সূত্রধর, খন্দকার আবদুর রব, খন্দকার আবদুর রেজ্জাক ও মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন (সেনাসদস্য)-কে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাঁদের নির্যাতন করে আপানিয়া পুলের কাছে নামিয়ে দেয়। পাকসেনারা কড়িহাটির তছলিমা বেগম, মাজেদা খাতুন, আনোয়ারা বেগম ও তাহেরা আক্তারের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শওকত কামালের বাড়ির মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এসব অপকর্মে সহযোগিতা করে তাদের এ দেশীয় দোসর মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। ২৭শে এপ্রিল পাকসেনারা চাটখিল বাজারের পাশে স্থানীয় এক মেম্বারের বাড়িতে আয়েশা নামের এক মহিলার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। ১৮ই মে তারা মল্লিকা দিঘীর পাড়ে সিরাজুল ইসলাম (পিতা মহব্বত আলী, ঘোমাতলী), ইদ্রিস মিয়া (পিতা পিতু মিয়া, বৈকণ্ঠপুর) এবং অপর একজনকে হত্যা করে। ৯ই সেপ্টেম্বর পাকবাহিনীর ৩০ জনের একটি দল রাজাকার কমান্ডার আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে পুনরায় মল্লিকা দিঘীর পাড়ে আবদুল মালেক (পিতা আবদুল হালিম, রামনারায়ণপুর), ফজলুর রহমান (পিতা রাব্বানি উল্ল্যা, রামনারায়ণপুর), আবুল কালাম ও আবদুল ওয়াদুদকে (পিতা আবদুল মান্নান, রামনারায়ণপুর) হত্যা করে। এরপর তারা নোয়াখালীর ক্যাপ্টেন আবদুর রব চৌধুরীর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এতে পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করে তাদের দোসর মোজাম্মেল হক, এমদাদ উল্যা মুন্সি, সামছুল হক, লুৎফর রহমান মাস্টার, আবু সুফিয়ান প্রমুখ। ৪ঠা সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী রাজাকারদের সহযোগিতায় জয়াগ বাজারের কাছে রাজার বাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভেতরে ১৩ জন মুক্তিকামী তরুণকে গুলি করে হত্যা করে। এটি রাজার বাড়ি গণহত্যা হিসেবে পরিচিত।
চাটখিলে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি কোনো যুদ্ধ হয়নি। রামগঞ্জ, বিপুলাবার, নাথের পেটুয়া, হাপানিয়া পুল ও বজরা চৌরাস্তার যুদ্ধে বিভিন্ন সময় এখানকার মুক্তিযোদ্ধারা অংশ নেন।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আবুল মঞ্জুর, বীর উত্তম (পিতা মো. নজিবুল্লাহ, কামালপুর), আব্দুল হাকিম, বীর বিক্রম (পিতা দীন মোহাম্মদ, পাঁচগাঁও), ওয়ালিউল্লাহ, বীর বিক্রম (পিতা মো. করিম বক্স, ছোট জীবননগর), রুহুল আমিন, বীর বিক্রম (পিতা জালাল আহাম্মদ মুন্সী, সিংহবাহরা) আব্দুর রব চৌধুরী, বীর বিক্রম (পিতা মো. আকরাম উদ্দিন, নোয়াখোলা), আবুল বাশার, বীর বিক্রম (পিতা আব্দুল লতিফ মুন্সী, বদলকোট উত্তরপাড়া), আবদুর রাজ্জাক, বীর প্রতীক (পিতা জাবেদ উল্লাহ ভূঁইয়া, ছয়ানী টগবা), আবু তাহের আহমেদ, বীর প্রতীক (পিতা হাজী সাইদুর রহমান, ভাওর বাগানবাড়ি), আবুল কালাম আজাদ, বীর বিক্রম (পিতা মো. আবদুল গণি, সাতড়াপাড়া), আব্দুল গফুর, বীর প্রতীক (পিতা বশির উল্লাহ সর্দার, ছয়ানী টগবা), আব্দুল হালিম, বীর প্রতীক (পিতা আহমদ আলী, খালিশাপাড়া), মোহাম্মদ, বীর প্রতীক (পিতা আব্দুর রব পাটোয়ারী, বালিয়াধর), মো. শরীফ, বীর প্রতীক (পিতা সুলতান আলী, ছয়ানী টগবা), মো. শহিদুল্লাহ, বীর প্রতীক (পিতা ফজলুল হক মুন্সি, বাদলকোট), মোশাররফ হোসেন, বীর প্রতীক (পিতা মোবারক উল্লাহ, ভীমপুর)।
চাটখিল উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- হাবিলদার রুহুল আমিন, বীর বিক্রম (২৭শে নভেম্বর নোয়াখালীতে যুদ্ধে শহীদ), আব্দুর রব চৌধুরী, বীর বিক্রম (বিলোনিয়ার যুদ্ধে শহীদ), আবুল বাশার, বীর বিক্রম (৯ই মে বিবিরবাজার যুদ্ধে শহীদ), হাবিলদার নূর মোহাম্মদ, বীর প্রতীক (৭ই ডিসেম্বর সোনাইমুড়িতে যুদ্ধে শহীদ), মো. শরীফ, বীর প্রতীক (৯ই মে কুমিল্লার কটক যুদ্ধে শহীদ), আব্দুল গফুর, বীর প্রতীক (চুয়াডাঙ্গা জেলার ধোপাখালীর যুদ্ধে শহীদ), আবুল বাসার (পিতা ছেরাজুল হক, দৌলতপুর), সিপাহি আব্দুর রব (পিতা বদু মুয়াজ্জিন, ছয়ানী টবগা), মোহাম্মদ হোসেন (পিতা মহব্বত আলী, মির্জাপুর), জয়নাল আবেদীন (পিতা আকবর মোল্লা, ভীমপুর), মো. সিরাজুদ্দৌলা (পিতা মো. আব্দুল হালিম, প্রসাদপুর), ইদ্রিস মিয়া (পিতা ছেলামত উল্ল্যা বেপারী, রামনারায়ণপুর), মুনসুর আলী (পিতা জিতু মিয়া, বৈকুণ্ঠপুর), সিপাহি আনোয়ারুল হক (পিতা আব্দুল ছমেদ, কল্যাণনগর), আবদুল ওয়াদুদ (পিতা আব্দুল মান্নান, রামনারায়ণপুর), আবুল কালাম (পিতা আব্দুল মান্নান, রামনারায়ণপুর), সিরাজুল ইসলাম (পিতা মহব্বত আলী, রামনারায়ণপুর), আব্দুল মালেক (পিতা আব্দুল হালিম, রামনারায়ণপুর), ফজলুর রহমান (পিতা রাব্বান উল্ল্যা, রামনারায়ণপুর), মো. সেলিম (পিতা ফজলুর রহমান, শোশালিয়া), মস্তাজুল করিম (পিতা জোবায়েদ উল্ল্যা পাটোয়ারি, খালিশপাড়া), এ টি এম সিরাজুল ইসলাম (পিতা মো. ইউনুছ মিয়া, বদলকোট), শহীদ মোহাম্মদ হোসেন (পিতা আবদুল বারেক পাটোয়ারি, রেজ্জাকপুর), ল্যান্স নায়েক অহিদ উল্ল্যা (পিতা ফজলুল কবির পাটোয়ারী, রেজ্জাকপুর), এম রহমান (পিতা আব্দুল গণি, হীরাপুর), হাবিলদার জয়নাল (ইপিআর; পিতা মো. হাবিব উল্ল্যা, কাকড়াপাড়া), শারাফত উল্ল্যা সেনা (পিতা আম্বর আলী সেনা, কাকড়াপাড়া), শফিকুর রহমান (পিতা নাদরেজ্জামান, নিজভাওর), নায়েক মো. নূরুল ইসলাম (পিতা আব্দুল করিম প-িত, রমাপুর), এরশাদ আলী (পিতা নূর মিয়া মুন্সী, গোবিন্দপুর), খোরশেদ আলম (ইপিআর; পিতা মতিউর রহমান, শ্রীনগর), রহমত উল্ল্যা (পিতা মফিজ উল্ল্যা, শংকরপুর), জি এম রুহুল আমিন (পিতা ছেরাজুল হক মাস্টার, শ্রীরায়), মোহাম্মদ হোসেন (পিতা সুজা মিয়া মাস্টার, শ্রীপুর), আবু তাহের (পিতা জয়নাল আবেদীন, সংকরপুর), আব্দুর রব চৌধুরী (পিতা আক্রম আলী, নোয়াবিলা) ও আব্দুল মান্নান (ফতেহপুর)।
মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে চাটখিল উপজেলা কমপ্লেক্সের ভেতরে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের রাজার বাড়িতে গণহত্যায় শহীদ ১৩ জনের নামে একটি স্মৃতিফলক এবং গান্ধী আশ্রমের ২ জন সেবক শহীদের নামে স্মৃতিফলক রয়েছে। [শওকত কামাল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড