চাতলগাঁও গণহত্যা (কুলাউড়া, মৌলভীবাজার)
চাতলগাঁও গণহত্যা (কুলাউড়া, মৌলভীবাজার) সংঘটিত হয় ৬ই এপ্রিল। এতে ৫ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। কুলাউড়া সদরের মোবারক মিয়ার মালিকানাধীন আজম বোর্ডিং ছিল আওয়ামী লীগ-এর নেতা-কর্মী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের একটি আশ্রয় স্থল। বোর্ডিং-এ তাদের জন্য বিনা পয়সায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এখান থেকে যোগাযোগ সহজ ছিল বলে বৃহত্তর সিলেটের নেতারা প্রায়ই এখানে মিটিং করতেন। তখন ঢাকা-সিলেট রেললাইনের কুলাউড়া জংশন ছিল পূর্বাঞ্চলের কেন্দ্র। রেলপথে শ্রীমঙ্গল, সাতগাঁও, শমশেরনগর, কমলগঞ্জ, বরমচাল প্রভৃতি স্থান কুলাউড়ার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত ছিল। এদিকে কুলাউড়া- শাহবাজপুর রেললাইনে সহজ যোগাযোগের কারণে বড়লেখা, জুড়ী এমনকি বিয়ানীবাজারের নেতৃবৃন্দ পর্যন্ত রাজনৈতিক নির্দেশনার জন্য কুলাউড়ার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। সিলেটে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা পৌঁছার পূর্বে কুলাউড়ায় তা পৌঁছে যেত রেল ও টেলিফোনের মাধ্যমে। স্থানীয় তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জব্বার তখন আজম বোর্ডিং- এ তাঁর একদল অনুসারী নিয়ে অবস্থান করতেন। ‘জব্বার বাহিনী’ নামে পরিচিত তাঁর দলে কামারকান্দির আছকির মিয়া ও রামপাশার হাবিব উল্লাহ প্রশিক্ষক ছিলেন।
৬ই এপ্রিল সকালে কেন্দ্রীয় নেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী- এমএনএ মাসুদ চৌধুরী ও সিরাজ উদ্দিন আহমদকে নিয়ে আজম বোর্ডিং-এ এসে ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ ও পুলিশ বাহিনীকে সংগঠিত থাকার পরামর্শ দিয়ে দ্রুত অস্ত্র সরবরাহের আশ্বাস দেন। দেওয়ান ফরিদ গাজীর উপস্থিতির সময় স্থানীয় নেতাদের মধ্যে আবদুল জব্বার, জয়নাল আবেদিন, তোতা মিয়া, তাইমুছ আলী, আবদুল খালেক চৌধুরী, আবদুল লতিফ খান, আবদুর রহিম প্রমুখ সেখানে ছিলেন। এখান থেকে ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল কুলাউড়া থেকে জুড়ী হয়ে গোলাপগঞ্জের পথে হেতিমগঞ্জ প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নিতে যায়।
এদিন বিকেলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল মৌলভীবাজার থেকে সড়কপথে কুলাউড়ার দিকে অগ্রসর হয়। জব্বার বাহিনীর দুই সদস্য আছকির মিয়া ও হাবিব উল্লাহ তাঁদের কাছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৫ জনের একটি দল নিয়ে কুলাউড়ার প্রবেশমুখ কাফুয়ার পুলে অবস্থান নেয়। হানাদাররা এগিয়ে এলে তাঁরা দেশীয় অস্ত্রে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। হানাদার বাহিনী গুলিবর্ষণ শুরু করলে দুপক্ষের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ শুরু হয়। এক সময় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। নিরাপদ স্থানে যাওয়ার সময় আছকির মিয়া ও হাবিব উল্লাহকে বহনকারী জিপটি উল্টে যায়। বৃষ্টির মতো নিক্ষিপ্ত হানদারদের গুলিতে হাবিব উল্লাহ ঘটনাস্থলে শহীদ হন। আছকির মিয়া পরে শাহাদত বরণ করেন। শহরে প্রবেশে বাঁধা পেয়ে বিক্ষুব্ধ হানাদাররা পার্শ্ববর্তী চাতলগাঁও- এ ঢুকে নির্বিচারে গুলি করতে থাকে। তাদের গুলিতে গ্রামের মসজিদের পাশে ৫ জন নিরীহ মানুষ শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে আবদুল কুদ্দুস ও কটুমিয়ার নাম জানা জানা যায়। চাতলগাঁও-এ কুলাউড়ার প্রথম গণহত্যা সংঘটিত হয়। এ গণহত্যার ফলে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেক মানুষ আশ্রয়ের সন্ধানে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। [হাসনাইন সাজ্জাদী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড