You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুুক্তিযুদ্ধে চাঁদপুর সদর উপজেলা

চাঁদপুর সদর উপজেলা পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। এটি একটি ঐতিহাসিক নদী বন্দর হিসেবে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধে চাঁদপুরবাসীর রয়েছে অনন্য অবদান। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে চাঁদপুর সদর উপজেলা থেকে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ থেকে সদস্য নির্বাচিত হন যথাক্রমে মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং আবদুল করিম পাটোয়ারী। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা জনরায়ের প্রতি সম্মান দেখিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের অধিবেশন আকস্মিকভাবে স্থগিত ঘোষণা করেন। সঙ্গে-সঙ্গে সারা বাংলার ন্যায় চাঁদপুরেও এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এ-সময় ন্যাপ নেতা বরুণ দত্তগুপ্ত মাইকিং করে পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের ষড়যন্ত্রের কথা প্রচার করেন। তাঁর এ সাহসিক পদক্ষেপ চাঁদপুরবাসীকে রাজনৈতিকভাবে আরো সচেতন করে তোলে। কালীবাড়ি মোড়ে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন-সহ অসংখ্য ছাত্র-জনতা একত্রিত হয় এবং বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। উপস্থিত সর্বদলীয় নেতৃবৃন্দ প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করেন। এ মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন আবদুল করিম পাটোয়ারী এমপিএ, এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম এমপিএ, রফিউদ্দিন আকন্দ, চানবক্স পাটোয়ারী, আবুল কাশেম চৌধুরী, আবদুল আউয়াল, অধ্যাপক সৈয়দ আবদুস সাত্তার, ন্যাপ নেতা জীবন কানাই চক্রবর্তী, ফজলুল হক সরকার, লতিফ মাওলানা, এডভোকেট মাহবুব প্রমুখ। ২রা মার্চ নদীর ঘাটের বড় স্টেশনে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ জনগণ ভিড় জমায়। তারা ঢাকা থেকে চাঁদপুর অভিমুখী জলযান বেঙ্গল ওয়াটারের অপেক্ষায় থাকে নতুন খবর জানার জন্য। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ২রা ও ৩রা মার্চ ঘোষিত হরতাল চাঁদপুরবাসী যথাযথভাবে পালন করে। ছাত্রনেতা আবদুর রহমান, হানিফ পাটোয়ারী, মাহবুবুর রহমান, মাওলানা আবদুল লতিফ, আবু তাহের দুলাল, মমিন খান মাখন, অজয় ভৌমিক প্রমুখ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দানের খবর ৬ই মার্চ বাড়ি-বাড়ি গিয়ে সাধারণ জনগণকে অবহিত করেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য চাঁদপুর থেকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ৬ই মার্চ এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যবৃন্দ দুদিন পূর্বেই ঢাকায় আসেন।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর পরবর্তী করণীয় বিষয়ে ৯ই মার্চ কালীবাড়ি মোড়ের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম এমপিএ-র সভাপতিত্বে সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন আবদুল করিম পাটোয়ারী এমপিএ, ডা. আবদুস সাত্তার এমপিএ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট (অব.) এ বি সিদ্দিকী এমপিএ, জীবন কানাই চক্রবর্তী, মাওলানা আবদুল লতিফসহ বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দ। সভায় চাঁদপুরে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মিজানুর রহমান চৌধুরী এমএনএ-কে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় সংগ্ৰাম পরিষদ গঠন করা হয়। সংগ্রাম পরিষদে চাঁদপুর মহকুমার নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরিষদের অন্য সদস্যরা হলেন- আবদুল করিম পাটোয়ারী এমপিএ, হাফেজ হাবিবুর রহমান এমএনএ, এডভোকেট আবদুল আউয়াল এমএনএ, এম ওয়ালিউল্লাহ বিএসসি এমএনএ, সেকান্দার মাস্টার এমপিএ, গোলাম মোরশেদ ফারুকী এমপিএ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট (অব.) এ বি সিদ্দিকী এমপিএ, এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম এমপিএ, ডা. আবদুস সাত্তার এমপিএ, রাজা মিয়া এমপিএ, রফিজউদ্দিন আকন ওরফে সোনা আকন্দ (পুরান বাজার), বাচ্চু মিজি (পুরান বাজার), করিম খাঁ, টুনু চৌধুরী, আবুল কাশেম চৌধুরী, জীবন কানাই চক্রবর্তী, অধ্যাপক সৈয়দ আবদুস সাত্তার (বাংলা, চাঁদপুর সরকারি কলেজ) এবং অধ্যাপক এ জেড এম সামসুদ্দিন আহমেদ (হিসাববিজ্ঞান, চাঁদপুর সরকারি কলেজ)।
১০ই মার্চ চাঁদপুর কলেজ ছাত্র সংসদের উদ্যোগে রবিউল আলম খান কিরণকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১১ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- অজয় ভৌমিক (ছাত্রলীগ), আবদুর রহমান (ভিপি, চাঁদপুর কলেজ ছাত্র সংসদ; ছাত্র ইউনিয়ন), হানিফ পাটোয়ারী (সাধারণ সম্পাদক, চাঁদপুর কলেজ ছাত্রলীগ), মাহবুবুর রহমান (সাবেক ভিপি, চাঁদপুর কলেজ ছাত্র সংসদ; ছাত্র ইউনিয়ন), মাওলানা আবদুল লতিফ (সাবেক জিএস, চাঁদপুর কলেজ ছাত্র সংসদ), আবু তাহের দুলাল (ছাত্রলীগ), আজিজ (ছাত্রলীগ), মমিন খান মাখন (ছাত্রলীগ), হারুনুর রশীদ (ছাত্রলীগ) এবং সৈয়দ আবেদ মনসুর (ছাত্রলীগ)। সংগ্রাম কমিটি গঠনের পর নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে প্রতিটি উপজেলায় এর শাখা কমিটি গঠিত হয়। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ এবং সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যৌথ নেতৃত্বে পরিচালিত হয় চাঁদপুরের মুক্তিযুদ্ধ।
৯ই মার্চ থেকে আওয়ামী লীগের ঘোষপাড়া খালের পুল সংলগ্ন অফিসটি কন্ট্রোল রুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আবদুল করিম পাটোয়ারীর কালীবাড়ি মোড়ে চাঁদপুর মিলস নামের দোকানটি রাজনৈতিক আলোচনা এবং নেতৃবৃন্দের মিলনস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। অসহযোগ আন্দোলন-এর সময় এখান থেকে মিছিল আরম্ভ হয়ে পুনরায় এখানে এসে শেষ হতো। সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পরপরই চাঁদপুর আনসার ক্লাবের মাঠে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট (অব.) এ বি সিদ্দিকী এমপিএ-র নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করে সামরিক প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়। সামরিক বাহিনীর বেশ কয়েকজন বাঙালি সদস্য, পুলিশ, ইপিআর, আনসার বাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্য এবং ছাত্র- জনতাকে নিয়ে প্রায় তিনশ সদস্যের একটি দল গড়ে তোলা হয়। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট (অব.) এ বি সিদ্দীকের দিকনির্দেশনায় এ বাহিনীতে সুবেদার লুৎফর রহমান (রামগঞ্জ), সুবেদার নূর আহমেদ গাজী (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত), লে. দিদারুল আলম (পরবর্তীতে সেনা বিদ্রোহের অভিযোগে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে চাকরিচ্যুত), লেফটেন্যান্ট এম এ ওয়াদুদ (মতলব উত্তর; চাঁদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার) প্রমুখ প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এ দলটির হেডকোয়ার্টার্স ছিল শহরের আনসার ক্লাবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ চলে হাসান আলী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, ১৪ নম্বর কোয়ার্টার্স মাঠ ও মধুসূদন হাইস্কুল মাঠে। তাঁরা ছাত্র-জনতাকে সামরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সকলকে প্রস্তুত করতে থাকেন।
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পরই ছাত্ররা স্থানীয় প্রশাসনকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলতে ডাকাতিয়া নদীর পার্শ্ববর্তী ডাকবাংলোয় বোমা হামলা চালায়। বোমা হামলায় ৯ জন আহত হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে চাঁদপুর নতুন বাজার বালুর মাঠে কাঠের রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও ভাসানী ন্যাপের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অনেকে এতে সরাসরি জড়িত ছিলেন।
তাঁদের মধ্যে রবিউল আউয়াল খান কিরণ, আব্দুল মোমেন খান মাখন, আবু তাহের দুলাল, আ. আজিজ (সকদিরামপুর), মনিরুল হক, ওয়াহিদুর রহমান (কচুয়া), হানিফ পাটোয়ারী, মজিবুর রহমান, সৈয়দ আবেদ মনসুর, খসরু (নাজিরপাড়া), আ. মোমেন (ছোট সুন্দর), আবু তাহের রোস্তম, আ. লতিফ, গোলাম রাব্বানী (মিশন রোড), আ. খালেক (মতলব), কাবিল আহমেদ, চন্দন পোদ্দার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য শক্তিশালী বোমা তৈরির স্কোয়াড গঠন করা হয়। এ স্কোয়াডে ছিলেন অধ্যাপক সৈয়দ আবদুস সাত্তার, কমরেড আবদুর রহমান, মাওলানা আবদুল লতিফ, মাহবুবুল হক পাটোয়ারী, আবুল বাসার দুলাল, ফজলুর রহমান, আবুল কালাম, সুশীল সাহা, আবদুল খালেক, শংকর পোদ্দার, মোস্তফা রুহুল আনোয়ার, আনোয়ার হোসেন, আরিফ, দ্বিজেন্দ্র লাল, জীবন কানাই সাহা প্রমুখ। মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক মনির আহমেদ এ স্কোয়াডকে নানাভাবে সহায়তা দেন। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে এ স্কোয়াড অধ্যাপক সৈয়দ আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে পালপাড়ার পোদ্দার বাড়িতে বোমা তৈরি শুরু করে। চাঁদপুর কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হানিফ পাটোয়ারী গণি স্কুল, হাসান আলী স্কুল এবং চাঁদপুর কলেজ ল্যাবরেটরি থেকে বোমা তৈরির উপাদান সংগ্রহ করে নিজবাড়ি কোড়ালিয়ায় কিছু বিশ্বস্ত কর্মী নিয়ে হাতবোমা তৈরি করেন। ৯ই মার্চের পর ছাত্রলীগ নেতা আবদুল মমিন খান তাঁর বিশ্বস্ত বন্ধু শহীদুল্লাহ, জাবেদ, বাবুলাল কর্মকার, গণেশ কর্মকার, মিজান ও রতনসহ পালপাড়াস্থ নিজবাড়িতে বোমা তৈরি শুরু করেন।
চাঁদপুরের সাংস্কৃতিক কর্মীরা এ-সময় শহরের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধ ও গণজাগরণের গান গেয়ে সাধারণ মানুষজনকে উৎসাহ যোগাতেন। সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শ্যামল সেনগুপ্ত, দেবদাস ভৌমিক, শীতল ঘোষাল, চম্পক সাহা প্রমুখ।
২২শে মার্চ সংবাদ পত্রিকায় বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা ছাপা হলে চাঁদপুরের সর্বত্র পতাকা তৈরি শুরু হয়। বিশেষ করে কালীবাড়ির টাউন হলের সিদ্দিক মিয়ার দর্জির দোকানে অনেকগুলো পতাকা তৈরি করা হয়। ২৩শে মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবসকে প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে পালনের ডাক দেয়া হলে রাত ১২টা ১ মিনিটে ছাত্র ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী রেলওয়ে কাঁচাবাজার কলোনির মাঠ থেকে ডামি রাইফেল হাতে কুচকাওয়াজ করে কালীবাড়ি মোড়ে জড়ো হয়। তারা ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ স্লোগানে রাতের আকাশ প্রকম্পিত করে তোলে। এদিন চাঁদপর মহকুমার প্রশাসনিক ভবনসহ সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক সকল ভবনে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উড়তে থাকে।
চলমান সংকট নিরসনে ২৫শে মার্চ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ-এর জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য এবং ছবি চাঁদপুরের নেতৃবৃন্দ সাইক্লোস্টাইল করে সর্বত্র বিলি করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী এমএনএ চাঁদপুর চলে আসেন। ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় দেশের চলমান রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে পুরান বাজার লেজারাস কোম্পানি অফিসে মিজানুর রহমান চৌধুরী এমএনএ, আবদুল করিম পাটোয়ারী এমপিএ, এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম এমপিএ-সহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এক সভায় মিলিত হন। মিটিং চলাকালে রেডিও থেকে তাঁরা ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন জারির খবর শুনতে পান। আসন্ন গোলযোগের আশঙ্কায় উপস্থিত নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য সকলকে চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণের অনুরোধ জানান। এ রাতেই ১০টার দিকে এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম এমপিএ, নাজিরপাড়ার আতিকুল্লাহসহ কয়েকজন থানায় উপস্থিত হয়ে দারোগা হামিদুল হক চৌধুরীর সহায়তায় ১৪টি রাইফেল এবং একটি এলএমজি হস্তগত করেন। কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মুন্সী ফকির উদ্দিন (মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাদানের জন্য পরবর্তী সময়ে পাকবাহিনীর হাতে শহীদ) অসহযোগ আন্দোলনের সময় চাঁদপুর এলে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের অনুরোধে চাঁদপুর ট্রেজারিতে রক্ষিত অস্ত্রগুলো তাঁদের হাতে তুলে দেন।
চাঁদপুর শহরের ডব্লিউ রহমান এবং স্টার আল কায়েত জুট মিলস্-এর শ্রমিকরা পাকবাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সংগ্রাম পরিষদের সহযোগিতায় শ্রমিক নেতা বাচ্চু মিয়া, রফিউদ্দিন আকন্দ ওরফে সোনা আকন্দ এবং জীবন কানাই চক্রবর্তী বালুর মাঠ ও পুরান বাজার নূরিয়া স্কুল মাঠে শ্রমিকদের সমাবেশে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার আহ্বান জানান।
ব্যবসায়িক স্থান হিসেবে পরিচিত চাঁদপুর পুরান বাজার রক্ষার জন্য সকল ব্যবসায়ী মিলে একটি নাগরিক কমিটি গঠন করেন, যার সভাপতি হন রফিউদ্দিন আকন্দ। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- ইউনুস মিয়াজি, বাসু আকন্দ, কমিশনার ইদ্রিস খাঁ, জগবন্ধু সাহা, লক্ষ্মী সাহা, কালীদাস সাহা, মো. ইয়াসিন খান, ইউনুস মাঝি, আলহাজ্ব হাবিবুর রহমান, মাস্টার শফিকুল ইসলাম, কমিশনার হরিবিলাস সাহা প্রমুখ। এ কমিটি যুদ্ধকালে অসহায় লোকজনকে সহায়তা, লুটপাট ঠেকানো এবং গেরিলা যোদ্ধাদের আর্থিক সহায়তা দান করে।
ক্রমান্বয়ে শহর জনশূন্যে পরিণত হলে পাল বাজার রক্ষা করার জন্য ব্যবসায়ী ফটিক সাহার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। তাঁর অনুরোধে বাজার পাহারার দায়িত্ব দেয়া হয় লাঠিয়াল হিসেবে পরিচিত তরপুর চণ্ডি গ্রামের কোব্বাত আলী দর্জি, বিষ্ণুদি গ্রামের ইনু মাঝি, আবদুল খালেক মাঝি, হোসেন বোয়াল, মতি মাঝি প্রমুখকে। পাকিস্তানি বাহিনীর চাঁদপুর দখলের পূর্ব পর্যন্ত এখানে পাহারা চলে।
২৭শে মার্চ ঢাকা থেকে লোক মারফত ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ২৫শে মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার সংবাদ একটি চিরকুটের মাধ্যমে আবদুল করিম পাটোয়ারী এমপিএ-র চাঁদপুর মিলে আসে। এছাড়া মতলবের জয়নাল আবেদীন প্রধানের মাধ্যমেও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি সংগ্রাম পরিষদ হাতে পায়। চাঁদপুর ওয়ারলেস অপারেটরের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা মমিন খান মাখনসহ অনেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা জানতে পান। ২৬শে মার্চ সন্ধ্যায় মমিন খান মাখন ও জাবেদসহ কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি কপি করার উদ্যোগ নেন। তাঁরা হাসান আলী স্কুল এবং গণি স্কুলের সাইক্লোস্টাইল মেশিনটি জাবেদের বাসায় নিয়ে এসে স্বাধীনতার ঘোষণাটি কপি করে চাঁদপুর মহকুমায় বিলি করেন।
দক্ষিণাঞ্চলের গেটওয়ে হিসেবে পরিচিত চাঁদপুরে ২৭শে মার্চের পর পাকহানাদার বাহিনী কারফিউ তুলে নিলে বিভিন্ন জায়গা থেকে সড়ক ও নৌ পথে নিজ গন্তব্য দক্ষিণাঞ্চলে যাবার জন্য বহু লোক জড়ো হয়। সংগ্রাম পরিষদ ও বাজার কমিটি এসব লোকজনের থাকা, খাওয়া এবং নিরাপদে বাড়ি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে।
২৮শে মার্চ চাঁদপুর শহরে সর্বদলীয় একটি মিছিল বের হয়। মিছিল লন্ডন ঘাটের দিকে এগিয়ে এলে ঘাটের কুলিরা মিছিলে যোগ দেয়। কুলি সর্দার কোব্বাত আলীর নেতৃত্বে তারা এক বিহারি পুলিশ সার্জেন্টের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাকে জখম করে। ২রা এপ্রিল লাকসামে ২ জন পাকিস্তানি গুপ্তচর ধরা পড়ে। হানিফ পাটোয়ারী এবং মনির হোসেন এ ২ জনকে চাঁদপুর নিয়ে আসেন। টাউন হলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ৬ই এপ্রিল চাঁদপুরে এয়ার শেলিং হবে ধৃতদের কাছ থেকে এ কথা শোনার পর মেঘনার পাড়ে নিয়ে গুলি করে তাদের লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়। ৩রা এপ্রিল ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে পালপাড়ার পোদ্দার বাড়িতে বোমা তৈরির সময় আকস্মিক একটি বোমার বিস্ফোরণে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম ভূঁইয়া (কল্যাণদি, বাবুরহাট; বিএসসি পরীক্ষার্থী, চাঁদপুর কলেজ), সুশীল কুমার রায় (প্রতাপ সাহার বাড়ি; বিএসসি পরীক্ষার্থী, চাঁদপুর কলেজ), শংকর পোদ্দার (সাধুচরণ পোদ্দারের বাড়ি; প্রবেশিকা পরীক্ষার্থী) ও আ. খালেক (ধনুয়া, ফরিদগঞ্জ) শহীদ হন।
চাঁদপুরের খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া (বর্তমানে বাসদের একাংশের সভাপতি) ২৫শে মার্চ আগরতলায় গিয়ে বিএসএফ-এর সঙ্গে যোগাযোাগ করেন। ৩০শে মার্চের মধ্যে কুমিল্লা থেকে অগণিত শরণার্থী ভারতে গমন করে। ভারতীয় বিএসএফ কর্তৃপক্ষ খালেকুজ্জামান ভূঁইয়াকে মতিনগর ক্যাম্পে শরণার্থীদের দেখাশোনার দায়িত্ব দেন। এপ্রিলের শেষদিকে তাঁকে গেরিলা যোদ্ধা সংগঠনের জন্য কাঠালিয়া ক্যাম্পের দায়িত্ব দেয়া হয়। মুজিবনগর সরকার- নামে সুপরিচিত বাংলাদেশ সরকার- প্রতিষ্ঠার পর তাঁকে ওম্পিনগর ক্যাম্পের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ওম্পিনগর ক্যাম্প থেকে তাঁকে ২ নম্বর সেক্টর মেলাঘরে পাঠানো হয়। সাংগঠনিক দক্ষতার জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে এফএফ বাহিনীতে রিক্রুটের দায়িত্ব প্রদান করে। সেপ্টেম্বর মাসে তাঁকে সাব-সেক্টর নির্ভয়পুরে প্রেরণ করা হয়। এ সকল দায়িত্ব তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন।
৯ই এপ্রিল চাঁদপুর শহরের পতনের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ ও পরিকল্পিত যুদ্ধ পরিচালনার জন্য দক্ষ প্রশাসনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ উদ্দেশ্যে চাঁদপুর মহকুমা সংগ্রাম পরিষদকে একটি স্বাধীন আঞ্চলিক প্রশাসনে রূপ দেয়া হয়। চাঁদপুর মহকুমার ৫টি থানা ও পার্শ্ববর্তী বেগমগঞ্জ, রায়পুর, লাকসামসহ ৯টি থানা নিয়ে একটি জোন গঠন করা হয়। এ জোনকে ‘স্বাধীন এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অত্র অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সরকারের আদলে একটি নেতৃত্ব-কাঠামো গঠন করা হয়, যা ছিল এরূপ: আবদুর রব- রাষ্ট্রপতি, এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম এমপিএ- প্রধানমন্ত্রী, এডভোকেট আবু জাফর মঈনুদ্দিন- অর্থমন্ত্রী, আবদুল করিম পাটোয়ারী এমপিএ- আইন ও বিচার মন্ত্রী, বি এম কলিমুল্লাহ- স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং মিজানুর রহমান চৌধুরী এমএনএ- বানিজ্য মন্ত্রী। প্রশাসনিক কাঠামোর কেবিনেট সচিব ছিলেন জীবন কানাই চক্রবর্তী। এর সচিবালয় ছিল ডাকাতিয়া নদীর দক্ষিণ পাড়ে সূচিপাড়ায়। এর নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার আয়তন ছিল প্রায় ১২০০ বর্গমাইল। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস এ এলাকা অর্থাৎ শাহরাস্তি থানার সূচিপাড়া থেকে ফরিদগঞ্জ থানার নিম্নাঞ্চল পুরোটাই মুক্তাঞ্চল হিসেবে গণ্য হতো। এজন্য স্বাধীনতাবিরোধীরা এ এলাকার নাম দিয়েছিল ‘ইন্ডিয়া’। চাঁদপুরের এ সরকার যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সুবেদার আলী আকবরকে কমান্ডার-ইন-চিফ নিয়োগ করে। সেকেন্ড-ইন-চিফ নিযুক্ত হন জহিরুল হক পাঠান। সরকারের নির্দেশে ফরিদগঞ্জেরে নওগাঁ বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের জড়ো করা হতো। তাঁরা আইন ও বিচার মন্ত্রী আবদুল করিম পাটোয়ারী এমপিএ-র কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণে ভারতে যেতেন। এ সরকারের তত্ত্বাবধানে পানিয়ালা, পাইকপাড়া, কড়াইতলী, চিশতী, কামতা, টুবগী ও বাইচারতলীতে মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এ সরকার যুদ্ধ পরিচালনার জন্য জনসাধারণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করত। সংগৃহীত অর্থ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসা সহায়তা দেয়া হতো। দায়িত্বপ্রাপ্তরা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড থেকে ট্রেনিং এবং অস্ত্র সহায়তা পেতেন। উল্লেখ্য, ১০ই এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গঠনের পূর্বে এটি গঠিত হয়। আরো উল্লেখ্য যে, বরিশালে ২৬শে মার্চ দক্ষিণ বাংলা স্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ- নামে অনুরূপ একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল।
চাঁদপুর সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা হলেন- মিজানুর রহমান চৌধুরী এমএনএ, হাফেজ হাবিবুর রহমান এমএনএ, এডভোকেট আবদুল আউয়াল এমএনএ, এম ওয়ালিউল্লাহ বিএসসি এমএনএ, আবদুল করিম পাটোয়ারী এমপিএ, সেকান্দার মাস্টার এমপিএ, গোলাম মোরশেদ ফারুকী এমপিএ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট (অব.) এ বি সিদ্দিকী এমপিএ, এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম এমপিএ, ডা. আবদুস সাত্তার এমপিএ, রাজা মিয়া এমপিএ, রফিজউদ্দিন আকন্দ ওরফে সোনা আকন্দ (পুরান বাজার), বাচ্চু মিজি (পুরান বাজার), করিম খাঁ, টুনু চৌধুরী, আবুল কাশেম চৌধুরী, জীবন কানাই চক্রবর্তী, অধ্যাপক সৈয়দ আবদুস সাত্তার (বাংলা, চাঁদপুর সরকারি কলেজ), অধ্যাপক এ জেড এম সামসুদ্দিন আহমেদ (হিসাববিজ্ঞান, চাঁদপুর সরকারি কলেজ), আব্দুল কাদের মাস্টার, ইব্রাহিম বিটি, নুরুল ইসলাম মিয়াজী, নুরুল হক বাচ্চু মিয়াজী, প্রফেসর শামছুদ্দিন, এডভোকেট মুকবুল আহমেদ এবং শহীদুল্যা মাস্টার। মুক্তিযুদ্ধকালে চাঁদপুর সদর থানা ছিল ২নং সেক্টরের অধীন এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর), পরবর্তীতে মেজর এ টি এম হায়দার (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর)। চাঁদপুর মহকুমা কমান্ডার ছিলেন সুবেদার জহিরুল হক পাঠান (চাঁদপুর-মধুমতি অঞ্চল; দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকা— চাঁদপুর সদর, হাইমচর, ফরিদগঞ্জ, লক্ষ্মীপুরের কিছু অংশ, লাকসামের কিছু অংশ, হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি ও কচুয়ার দক্ষিণাংশ)। জেলা এফএফ কমান্ডার (কুমিল্লা জেলা) ছিলেন খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া (রূপসা, ফরিদগঞ্জ)। সহকারী জেলা এফএফ কমান্ডার ছিলেন আব্দুল আজিজ (সকদিরামপুর, ফরিদগঞ্জ)। চাঁদপুর মহকুমা এফএফ কমান্ডার ছিলেন খান মো. বেলায়েত হোসেন (ভাটেরগাঁও, ফরিদগঞ্জ, সরকারের সাবেক সচিব) এবং চাঁদপুর মহকুমা সহকারী এফএফ কমান্ডার ছিলেন আনোয়ার হোসেন মজুমদার (সেকদী, চাঁদপুর)।
জেলা পর্যায়ের অধিনায়করা হলেন- কমান্ডার শাহ মো. মহিউদ্দিন খান দুলু (দামোদরদী; অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল), সহ-অধিনায়ক আবুল কাশেম বেপারী (সফরমালী, চাঁদপুর), চাঁদপুর মহকুমা কমান্ডার রবিউল আউয়াল খান কিরণ, সহ-লিডার আবদুল মমিন খান মাখন (আঞ্চলিক লিডার, দক্ষিণাঞ্চল- চাঁদপুর-লাকসাম রেল লাইনের দক্ষিণ অংশ; যুদ্ধকালীন কোড নাম ডাকাতিয়া ‘ক’), সহকারী লিডার জহির উদ্দিন বাবর (আঞ্চলিক লিডার উত্তরাঞ্চল- চাঁদপুর-লাকসাম রেল লাইনের উত্তর অংশ; যুদ্ধকালীন কোড নাম ডাকাতিয়া ‘খ’) এবং সহ- অধিনায়ক খোরশেদ আলম বাচ্চু (হাটিলা, হাজীগঞ্জ; বিএলএফ, চাঁদপুর)।
চাঁদপুর সদর উপজেলা কমান্ডার মো. জাবেদ (সেপ্টেম্বর পর্যন্ত; মুক্তিযুদ্ধে শহীদ), কমান্ডার সৈয়দ আবেদ মনসুর (সেপ্টেম্বর মাসে জাভেদ শহীদ হওয়ার পর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত; বর্তমানে সুইডেন প্রবাসী), সহকারী কমান্ডার তাহের হোসেন রুস্তম (ছোট সুন্দর, চাঁদপুর সদর), নৌকমান্ড লিডার বদিউল আলম, বীর উত্তম, আমিন উল্লাহ শেখ, বীর বিক্রম- এবং সহকারী লিডার- মো. মমিন উল্লাহ পাটওয়ারী, বীর প্রতীক – (সরকারের সাবেক সচিব)। উল্লিখিত চারটি বাহিনী একটি সুবিন্যস্ত সশস্ত্র কাঠামোর মধ্যে চাঁদপুর মহকুমা (বর্তমানে জেলা) মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রতিটি বাহিনী তাদের নিজ-নিজ রণকৌশল অনুযায়ী যুদ্ধ পরিচালনা করে এবং কোনো-কোনো যুদ্ধ একাধিক বাহিনী একত্রিত হয়ে করে।
সুবেদার মেজর হিসেবে নূর হোসেন গাজী নিজেই একটি বাহিনী তৈরি করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। এছাড়া ফরিদগঞ্জের জহিরুল হক পাঠান কর্তৃক গঠিত পাঠান বাহিনী – এখানকার মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখে। ২রা এপ্রিল ধৃত ২ জন পাকিস্তানি গুপ্তচরের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ৭ই এপ্রিল দুপুরে ২টি পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান চাঁদপুর বড় স্টেশন ও পুরান বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা চালায়। এ-সময় ছাত্রনেতা হানিফ পাটোয়ারী ও আবেদ মনসুর বড় মসজিদের পাশ থেকে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল দিয়ে জঙ্গি বিমান দুটোকে লক্ষ করে গুলি ছোড়েন। বিমান হামলার পর আশঙ্কা তৈরি হয় যে, পাকিস্তানি বাহিনী লঞ্চযোগে চাঁদপুর বড় স্টেশনে আসবে। এ আশঙ্কায় ছাত্র- জনতা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র, রড, বর্শা, কোচ, জুইতা ইত্যাদি নিয়ে বড় স্টেশনের দিকে রওনা হয়। সড়ক পথে হানাদার বাহিনীর আগমন প্রতিরোধে তারা ৭ই এপ্রিল বিকেলে চাঁদপুর টেকনিক্যাল স্কুলের নিকট বিদ্যাপতি খালের ওপর সিএন্ডবি ব্রিজে গাড়ি ওঠার স্থানে বিশাল গর্ত খোঁড়েন। এ কাজে যুক্ত ছিলেন কুদ্দুস মৌলভী, মোহাব্বত আলী পাটোয়ারী, কাশেম আলী মিজি, ওহাব মিয়া প্রমুখ।
৮ই এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মেজর তৈমুরের নেতৃত্বে প্রায় ৮০টি সামরিক কনভয় নিয়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে চাঁদপুর অভিমুখে এগুতে থাকে। শাহরাস্তি এবং হাজিগঞ্জে তারা প্রতিরোধের সম্মুখীন হলে গণহত্যা চালিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। সন্ধ্যার দিকে তারা চাঁদপুর টেকনিক্যাল স্কুলের কাছে এলে আবার বেরিকেডের সম্মুখীন হয়। বাবুর হাট বাজারের স-মিল থেকে হানাদাররা গাছের বড়বড় অংশ এনে বিশাল গর্ত ও খাদের ওপর দিয়ে সামরিক কনভয়গুলো পাড় করে। রাত ৮টার দিকে তারা টেকনিক্যাল স্কুলের মাঠে সামরিক কনভয়গুলো জড়ো করে এবং স্কুলটিকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। এ খবর সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা জানতে পেরে রাত ৯টার দিকে ইপিআর সুবেদার আবদুর রবের নেতৃত্বে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলা এবং স্থানীয় ছাত্র-যুবকরা টেকনিক্যাল স্কুলের পূর্ব- দক্ষিণ কোণের নয়াবাগান থেকে হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। প্রায় ৩ ঘণ্টাব্যাপী চাঁদপুর টেকনিক্যাল স্কুল প্রতিরোধযুদ্ধ-এর পর হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। এ-যুদ্ধে সেকেন্দার পাটোয়ারীসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। ৮ই এপ্রিল সন্ধ্যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চাঁদপুরে শহরে অনুপ্রবেশ করে। তারা শহরতলীর টেকনিক্যাল উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। ৯ই এপ্রিল পাকবাহিনীর কমান্ডার মেজর জেনারেল রহিম খান টেকনিক্যাল স্কুলের আশেপাশে নৃশংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সকালবেলা চাঁদপুর শহরে প্রবেশ করে। সামরিক কনভয়গুলো নিয়ে তারা বড় স্টেশনে গিয়ে রেলওয়ে বিশ্রামাগার, রেলওয়ে থানা ও রেলওয়ে ডাকবাংলো দখল করে স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন করে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই তারা নুরিয়া হাইস্কুল, আক্কাস আলী হাইস্কুল, বে শিপিং কর্পোরেশন, ওয়াপদা রেস্ট হাউস, পুরান বাজার পুলিশ ফাঁড়ি এবং পৌরসভার দাতব্য চিকিৎসালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। চাঁদপুরকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৩৯তম ডিভিশনের হেডকোয়ার্টার্স ঘোষণা করা হয়। এর অধিনায়ক ছিল মেজর জেনারেল রহিম খান। চাঁদপুর মহকুমার দায়িত্বে ছিল ১১৭তম ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ নিয়াজি এবং ব্রিগেডিয়ার শেখ মঞ্জুর হোসেন। ক্যাম্প স্থাপনের পর স্থানীয় শান্তি কমিটি-র সহায়তায় হানাদাররা চাঁদপুর শহর ও শহরতলীতে হত্যা, লুট, নারীনির্যাতন এবং বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
৯ই এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চাঁদপুর শহর পুরো দখলে নেয়। এদিন সন্ধ্যায় তারা গান পাউডার ছড়িয়ে কালীবাড়ি থেকে পাল বাজার পর্যন্ত বেশ কয়েকটি দোকানপাট পুড়িয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। শহর দখলে নেয়ার পর মুসলিম লীগ-এর নেতা-কর্মীরা পাকসেনা কমান্ডার রহিম খানের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। তার পৃষ্ঠপোষকতায় শহরের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে সালাম মোক্তারকে চেয়ারম্যান করে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। শান্তি কমিটির অন্য সদস্যরা হলো- লতিফ খন্দকার, ছোট লতিফ, আয়েত আলী ভূঁইয়া, ইউনুস ভূঁইয়া, আহমেদ মিয়া, হেকিম বাদশা মিয়া, হামিদ মজুমদার, খালেক মোক্তার, জয়নাল বেপারী, মো. শামিম, বড় লতিফ খাঁ, আজিজ খান, হাবিবুল্লাহ চোকদার, মাওলানা আবদুল হক, সামসুল হুদা মাওলা, আবদুল মান্নান, ফজল মিজি, জয়নাল আবেদীন খান, এডভোকেট আবদুল হাকিম, মীর আবুল রাজ্জাক, বিহারি মন্নান, মকবুল পাটোয়ারী, আহমদুল্লাহ, এডভোকেট লুৎফর রহমান, শেখ হাবিবুর রহমান, আবদুর রব, মৌলবী আবদুল হক, আবদুল মজিদ মাতবর, ডেঙ্গু দেওয়ান প্রমুখ। পরবর্তী ২ মাসের মধ্যে তারা রাজাকার, আলবদর- ও -আলশামস বাহিনী গঠন করে। শহর ও গ্রামাঞ্চলের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার উদ্দেশ্যে তথাকথিত শান্তি কমিটি গঠিত হলেও কমিটির মূল কাজ ছিল— স্বাধীনতাপন্থীদের চিহ্নিত করা, তাঁদের হানাদার বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেয়া, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে গেরিলাদের খুঁজে বের করা, সংখ্যালঘুদের মালামাল লুট ও নারীর ইজ্জত লুট করা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে ভীতি সঞ্চার করা ইত্যাদি। এছাড়া তারা বুদ্ধিজীবী, প্রগতিশীল লেখক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী ও ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করে রাতের আঁধারে তাঁদের পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে তুলে দিত। পাকসেনাদের মনোরঞ্জনের জন্য নিয়মিত বাঙালি নারীদের ক্যাম্পে সরবরাহ করা তাদের অন্যতম কাজ ছিল। চাঁদপুর দিয়ে চলাচলকারী স্টিমার, লঞ্চ, রেল, বাস, রাস্তাঘাট, নৌকাসহ বিভিন্ন যানবাহন তল্লাশি করে এবং আশপাশের গ্রামাঞ্চলে হানা দিয়ে নিরপরাধ বাঙালিদের ধরে এনে তাদের ক্যাম্প সংলগ্ন নির্যাতন কক্ষে অমানবিক নির্যাতন শেষে বড় স্টেশন টর্চার সেলে পাঠানো হতো। এখানে বহু মুক্তিকামী মানুষকে টর্চার শেষে চোখ ও হাত-পা বেঁধে জীবন্ত নদীতে ফেলে দেয়।
চাঁদপুর সদর উপজেলার শীর্ষস্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধীরা হলো- চাঁদপুর পুরান বাজারের রাজাকার কমান্ডার মোহাম্মদ আলী, পাকিস্তানি কসাই মেজর ইফতেখার, রাজাকার কমান্ডার বাচ্চু, মন্তা প্ৰমুখ।
৮ই মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চাঁদপুর টেকনিক্যাল স্কুলের কাছে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের বেরিকেডের সম্মুখীন হয়। রাতে টেকনিক্যাল স্কুলে অবস্থানকালে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ চালান। পরদিন ভোরবেলা হানাদার বাহিনী সামরিক কনভয় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে থাকে। তাঁদের না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে তারা পেট্রল দিয়ে মিজি বাড়ি, আকন বাড়ি, খলিফা বাড়ি, আছরুদ্দিন বাড়ি, গাজী বাড়ি, খালেক বেপারীর বাড়ি, সৈয়াল বাড়ি, লবা গাজীর বাড়ি, মণীন্দ্র পালের বাড়ি, পালপাড়া, ঠাকুর বাড়ি, পণ্ডিত বাড়ি, খাঁ বাড়ি, রশিদ খাঁর বাড়ি ও শ্রীধাম ঠাকুর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এ- সময় হানাদার বাহিনীর একটি দল টেকনিক্যাল স্কুলের পাশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে প্রায় ২ লাখ টাকার মালামাল লুণ্ঠন করে। তাদের গুলিতে আফিয়া বেগম, কলিমুল্লাহ মিজি, ইসমাইল হোসেন ভলান্টিয়ার ও ঠাকুর বাড়ির একজন শহীদ হন। অগ্নিদগ্ধ হয়ে কয়েকজন শিশু নিহত হয়।
৯ই মার্চ ধ্বংস এবং হত্যাযজ্ঞ চালাতে-চালাতে হানাদাররা কমান্ডার রহিম খানের নেতৃত্বে ভোরবেলা চাঁদপুর শহরে প্রবেশ করে। ছায়াবাণী সিনেমা হলের কাছে তারা পানি বহনকারী একজন হোটেল কর্মচারীকে, একই সময় হাসান আলী স্কুল মাঠে গরু চরানো অবস্থায় এক বৃদ্ধ মহিলাকে এবং কালীবাড়ির মোড়ে পপুলার ফার্মেসির একজন কর্মচারীকে গুলি করে হত্যা করে।
চাঁদপুর শহর দখলের কয়েকদিনের মধ্যে শান্তি কমিটির সদস্যরা নতুন বাজার গুদারাঘাট সংলগ্ন দয়াল কুণ্ডের বাড়ি দখল করে নেয়। বাড়িটি পাকসেনা ও রাজাকারদের আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রতিরাতেই এখানে অসহায় নারী- পুরুষদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক হিসেবে রেলওয়ের টিটি আ. রশিদকে কালীবাড়ি স্টেশন থেকে ধরে এনে এখানে নির্যাতন শেষে হত্যা করে লাশ মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মোহাম্মদ ফজলুর রহমান (বালিয়া, ইচলী)। পাকবাহিনী শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের সহায়তায় মে মাসের ২য় সপ্তাহে পাল বাজার, নতুন বাজার এবং পুরান বাজারের দোকানপাট লুট করে। এ-সময় তারা বলতে থাকে ‘কাফের কা মাল লুটা লও’। এর এক মাসের মধ্যে আবারো এসব দোকানপাটে তারা লুণ্ঠন চালায়। আগস্ট মাসের শেষদিকে তারা পুরান বাজারের শত বছরের পুরনো হিন্দু মন্দির লুণ্ঠন শেষে তা আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে। এর কয়েকদিনের মধ্যে তারা নতুন বাজারের গোপালের আখড়ায় লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। এতে গোপালের আখড়ার ঐতিহ্যবাহী রথ আগুনে পুড়ে যায়। এর মধ্য দিয়ে হানাদার বাহিনী জনগণকে বোঝাতে চেয়েছে যে, এটি একটি ধর্মযুদ্ধ। অর্থাৎ ‘কাফের’দের বিরুদ্ধে মুসলমানদের যুদ্ধ। এরপর তারা আ. করিম পাটোয়ারী এমপিএ-র বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং তাঁর চাচার বাড়ি ডিনামাইট দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম এমপিএ-র বাড়ি ও মহকুমা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কাশেম চৌধুরীর বাড়ি রাজাকাররা দখল করে নেয়। এ বাড়ি দুটি পাকসেনা ও রাজাকাররা ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে। তারা নূরিয়া হাইস্কুল ও মধুসূদন হাইস্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে। রাজাকার কাজল (রঘুনাথপুর) ও নূরু গাজী নূরিয়া হাইস্কুল ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিল। বিভিন্ন এলাকা থেকে নারীদের ধরে এনে এখানে পাশবিক নির্যাতন চালাত এবং তাদের হত্যার পর লাশগুলো ডাকাতিয়া ও মেঘনা নদীতে ফেলে দিত। নারীনির্যাতনের জন্য শহরের ৪টি জায়গা ছিল উল্লেখযোগ্য। সেগুলো হলো— রেলওয়ে কলোনির রেস্ট হাউস, বাবুর হাট স্কুলের দোতলা, মিশন রোডের গিরিধাম ও সংলগ্ন একটি বাড়ি এবং নতুন বাজারস্থ দয়াল কুণ্ডুর বাড়ি। মিশন রোডের চৌচালা ঘরে বৃদ্ধ বাবা-মা দুটি যুবতি মেয়ে নিয়ে বসবাস করতেন। পাকসেনা ক্যাপ্টেন আনোয়ার সাদ্দামসহ ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসাররা তাদের লালসা মেটাতে এখানে আসত। মেয়ে দুটি তাদের ভোগের সামগ্রীতে পরিণত হয়।
পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে মেঘনা তীরের চাঁদপুর শহরটিকে কসাইখানায় পরিণত করে। এখানে তারা অনেকগুলো গণহত্যা চালায়। তার মধ্যে বাগাদী ইউনিয়ন গণহত্যা, দাসাদী ও শিলন্দিয়া গণহত্যা, ছোট সুন্দর গণহত্যা ও রঘুনাথপুর গণহত্যা উল্লেখযোগ্য। ২৪শে সেপ্টেম্বর নানুপুর সুইসগেট, ইসলামপুর গাছতলা, পশ্চিম সকদী মাদ্রাসা, নানুপুর চৌরাস্তা এবং বাঘড়া ব্রিজ পর্যন্ত এলাকার গ্রামগুলোতে পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যা চালায়। বাগাদী ইউনিয়ন গণহত্যায় ১৮ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন, যাদের মধ্যে ২ জনকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। চাঁদপুর হানাদারমুক্ত হওয়ার মাত্র দুদিন পূর্বে ৬ই ডিসেম্বর বাবুরহাট বাজার সংলগ্ন দাসাদী ও শিলন্দিয়া গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা একত্রিত হয়ে গণহত্যা চালায়। একই সঙ্গে তারা লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। এ গণহত্যায় ১৪ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। চাঁদপুর জেলার একটি ঐতিহাসিক গ্রাম ছোট সুন্দর। রাজাকার কমান্ডার বাচ্চুর সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৬ই আগস্ট ছোট সুন্দর বাজার ও পার্শ্ববর্তী তালুকদার বাড়িতে হামলা ও গণহত্যা চালায়। ময়মনসিংহস্থ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক সামছুল হক তালুকদার (কালু) এবং প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়াসহ বহু নর-নারী তাদের এ গণহত্যার শিকার হয়। ঐতিহ্যবাহী রঘুনাথপুর বাজারের সাপ্তাহিক হাটবারে প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়। ৮ই সেপ্টেম্বর এ বাজারে কমান্ডার মন্তার নেতৃত্বে অর্ধশতাধিক রাজাকার পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী গণহত্যা ও লুণ্ঠন চালায়। এ গণহত্যায় মুক্তিযোদ্ধা আ. মতিনসহ অর্ধশতাধিক সাধারণ মানুষ শহীদ হয়।
চাঁদপুর শহরতলীর টেকনিক্যাল উচ্চ বিদ্যালয়, বড় স্টেশন, রেলওয়ে ডাকবাংলো, রেলওয়ে থানা, নূরিয়া হাইস্কুল, মধুসূদন হাইস্কুল, আক্কাস আলী হাইস্কুল, বে শিপিং কর্পোরেশন, ওয়াপদা রেস্ট হাউস, পুরান বাজার পুলিশ ফাঁড়ি এবং পৌরসভার দাতব্য চিকিৎসালয় ক্যাম্প ছিল হানাদার বাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। প্রতিটি ক্যাম্পের পাশেই ছিল একটি করে নির্যাতন কক্ষ। বড় স্টেশন ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রধান ক্যাম্প ও নির্যাতনকেন্দ্র। এখানে ৭-৮টি নির্যাতন কক্ষ ছিল।
পাকিস্তানিদের দোসর রাজাকার-আলবদররা বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাঙালিদের ধরে নিয়ে যেত পাকিস্তানি সেনাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে। এ-সকল ক্যাম্পে জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতনের পর মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক মনে হলে তাদের বড় স্টেশন টর্চার সেলে পাঠিয়ে দিত। তাছাড়া গুদারাঘাট সংলগ্ন দয়াল কুণ্ডুর বাড়ি, এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম এমপিএ-র বাড়ি এবং মহকুমা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কাশেম চৌধুরীর বাড়িতে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পগুলোও ছিল তাদের নির্যাতনকেন্দ্র। এসব ক্যাম্পে হত্যা ও নির্যাতনের পাশাপাশি নারীনির্যাতনও চলত। নির্যাতিতদের মধ্যে মৈশাদী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমান মিয়াজী, চাঁদপুর বারের এডভোকেট জহিরের পিতা নূরুল ইসলাম মিয়াজী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নূরুল ইসলাম খান, মোক্তার ফজলুর রহমান গাজী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
চাঁদপুর সদর উপজেলা, চাঁদপুর শহর, শহরতলী বা আশপাশের এলাকায় স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের হত্যার পর লাশ গুম করতে বা লাশ মাটিচাপা দিতে পাকিস্তানি সেনাদের কোনো গণকবর তৈরি করতে হয়নি। শহরের পাশের মেঘনা এবং ডাকাতিয়া নদীতে চাঁদপুর ও আশপাশের জেলার হাজার-হাজার মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ ফেলে দেয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পুরো চাঁদপুরকে একটি বধ্যভূমিতে পরিণত করে। এর মধ্যে বড় রেলওয়ে স্টেশন বধ্যভূমি- এবং নূরিয়া হাইস্কুল বধ্যভূমি উল্লেখযোগ্য। মেঘনা নদীর পাড়ে রেলওয়ে স্টেশন এলাকাটি ছিল হানাদার বাহিনীর একটি বড় বধ্যভূমি। ৭১-এ এটি কসাইখানা নামে পরিচিত ছিল। এ বধ্যভূমিতে দোসরদের সহযোগিতায় হানাদার বাহিনী প্রায় ৫ হাজার বাঙালিকে হত্যা করে। পুরান বাজারের নূরিয়া হাইস্কুল ক্যাম্প ছিল আরেকটি বৃহৎ বধ্যভূমি। এ বধ্যভূমিতে হানাদাররা রেলগাড়ি, শরণার্থী নৌকা এবং বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল থেকে নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে নির্যাতন শেষে হত্যা করে তাদের লাশ মেঘনা নদীতে ফেলে দিত।
চাঁদপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকগুলো যুদ্ধ হয়। তার মধ্যে ওয়ারলেস বাজার যুদ্ধ, আশিকাটি বাজার যুদ্ধ, আকন্দহাট যুদ্ধ, মজুমদার বাড়ি যুদ্ধ, বাগাদী বাজার যুদ্ধ, সাহেব বাজার যুদ্ধ, সফরমালী যুদ্ধ-, মেঘনা নদীর যুদ্ধ, কালিভাংতি যুদ্ধ – বাবুরহাট যুদ্ধ-, ডাকাতিয়া নদীতে লঞ্চ আক্রমণ ও নৌকমান্ডো অপারেশন উল্লেখযোগ্য।
৮ই এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চাঁদপুর শহরে প্রবেশের পূর্বে চাঁদপুর সদর থানার ওয়ারলেস বাজারের পূর্বপাশের কড়ই গাছের নিচে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের প্রতিরোধযুদ্ধ হয়। উভয় পক্ষের যুদ্ধে ৫ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন এবং মুক্তিযোদ্ধা মো. সেকান্দর পাটোয়ারী (ট্রাক রোড, চাঁদপুর সদর) আহত হন।
১১ই জুলাই বিকেলে ২ জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা গ্রেনেড হামলা চালিয়ে চাঁদপুর পাওয়ার স্টেশনের সামনে পাহারারত ২ জন পাকিস্তানি সৈন্য এবং ২ জন পুলিশকে হত্যা করেন। ১৭ই জুলাই রাতে মুক্তিযোদ্ধারা বাবুরহাটের পূর্বপাশে কুমিল্লা-চাঁদপুর সড়কে আশিকাটিতে পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি কনভয়ের ওপর গ্রেনেড হামলা চালায়। এতে ৮ জন পাকসেনা নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়। এ-সময় গেরিলারা শান্তি কমিটির এক সভায় গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে ৭ জন দালাল আহত হয়।
১৯শে জুলাই দুপুরে বাবুরহাটে পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি গাড়ির ওপর গেরিলারা গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। এতে ৫ জন পাকসেনা নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়।
২০শে জুলাই আশিকাটি বাজারে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট মাহবুবের নেতৃত্বে দুই প্লাটুন সেনাসদস্য আশিকাটি বাজারের নিকট এম্বুশ করেন। টহলরত পাকসেনারা এম্বুশের মধ্যে এলে উভয় পক্ষের যুদ্ধে ১০ জন পাকসেনা নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।
৬ই সেপ্টেম্বর আকন্দহাটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি কোম্পানি এ বাজারে বেইজ স্থাপন করে। স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় পাকসেনাদের একটি দল এ ঘাঁটি আক্রমণ করলে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধে একজন মেজরসহ ৩৭ জন পাকসেনা নিহত হয়।
১২নং চান্দ্রা ইউনিয়নের বাখরপুর গ্রামের মজুমদার বাড়িতে ২৭শে সেপ্টেম্বর রাত দ্বিপ্রহরে পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। সকাল ৮টা পর্যন্ত চলা এ- যুদ্ধে সুবেদার নূর মোহাম্মদ গাজী, বীর বিক্রম-এর নেতৃত্বে ৪২ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। যুদ্ধে ৫ জন পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য নিহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ গাজীসহ কয়েকজন শহীদ হন।
৭ই অক্টোবর সকাল ৮টায় পাকিস্তানি বাহিনী বেশ কয়েকজন রাজাকার সহকারে চাঁদপুর থেকে ফরিদগঞ্জ যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। তারা বাগাদী বাজারের নিকট পৌঁছলে চাঁদপুর থানা বিএলএফ বাহিনীর সহ-অধিনায়ক তাহের হোসেন রুস্তমের নেতৃত্বে বিএলএফ বাহিনী ও হাবিলদার মো. জয়নালের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা যৌথভাবে পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করেন। এ আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে এবং পালিয়ে চাঁদপুর ফিরে যায়। এ-যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য আহত হয়।
চাঁদপুর থানার বিএলএফ-এর সহ-অধিনায়ক তাহের হোসেন রুস্তম ১৯শে অক্টোবর রাত্র আনুমানিক ৮টার সময় বিএলএফ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা মো. নাজমুল হোসেন ও মো. মন্টুকে নিয়ে চাঁদপুর পুরান বাজারে ৫নং ঘাটের একটি দোকানে পুরান বাজারের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য রাজাকার কমান্ডার মোহাম্মদ আলীকে গুলি করে হত্যা করেন।
২৪শে নভেম্বর সকাল ১১টায় চাঁদপুর সদর থানার অন্তর্গত পশ্চিম সকদী গ্রামের সাহেব বাজারস্থ ডাকাতিয়া নদীপথে পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি মালবাহী জাহাজে মুক্তিযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ করলে পাকিস্তানি সেনারাও পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন হাবিলদার (অব.) দেলোয়ার হোসেন ও কমান্ডার হানিফ পাটোয়ারী। এ গ্রামের ৭২নং পশ্চিম সকদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ছিল।
নভেম্বর মাসের শেষদিকে চাঁদপুর সদর উপজেলার সফরমালীর নিকট চাঁদপুর থানা এফএফ কমান্ডার শাহ মো. মহিউদ্দিন (দুলু) তাঁর বাহিনী নিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর ৬টি গানবোটের ওপর আক্রমণ করেন। আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকার নিহত হয়, ৪ জন পাকিস্তানি সেনা জীবিত ধরা পড়ে এবং অনেকগুলো অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা হস্তগত করেন।
চাঁদপুর শহরের অদূরে মেঘনা নদীতে ৯ই ডিসেম্বর দুপুর ১২টায় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে পাকিস্তানি সেনাদের বহনকারী দুটি জাহাজের ওপর আক্রমণ চালালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মেজর আ. রমিজসহ বহু পাকিস্তানি হানাদার নিহত হয় এবং অসংখ্য হানাদার আহত হয়।
নভেম্বর মাসের শেষদিকে হোসেনপুর এলাকার কালিভাংতিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ৫ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয় এবং ৯ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। এ-যুদ্ধে চাঁদপুর থানা এফএফ কমান্ডার শাহ মো. মহিউদ্দিন (দুলু), হোসেনপুর এরিয়া ইনচার্জ শাহ মো. শাহাদাত হোসেন, প্লাটুন কমান্ডার আবুল কাসেম বেপারী, আব্দুল মান্নান (বিষ্ণুপুর), সিরাজুল ইসলাম বরকন্দাজ (ফিশারী গেইট), সুলতান আহমেদ মিজি প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।
বাবুরহাটের আশেপাশে বড় রাস্তায় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা ডিসেম্বর মাসের গোড়ার দিকে পরিখা খনন করে পজিশন নেয়। সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ লোক মারফত এ খবর জানতে পেরে এফএফ বাহিনীর ৪-৫ জন মুক্তিযোদ্ধা তাদের ওপর আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি বাহিনী পাল্টা আক্রমণ চালায়। হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্রের মুখে এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন।
চাঁদপুর শহর থেকে সড়ক পথে পাকিস্তানি বাহিনী ফরিদগঞ্জ থানায় যাতায়াত করতে না পারায় সেখানে তাদের বাহিনীর জন্য রসদ, অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সহকারে লঞ্চযোগে ডাকাতিয়া নদীপথে ২৪শে নভেম্বর সকালে রওনা করে। লঞ্চটি বেলা ১১টার দিকে পশ্চিম সকদি সাহেব বাজারের নিকট পৌঁছলে নদীর পূর্ব পাড় থেকে ফরিদগঞ্জ থানা বিএলএফ কমান্ডার হানিফ পাটোয়ারীর নেতৃত্বে বিএলএফ বাহিনী লঞ্চটি আক্রমণ করে। লঞ্চ থেকে পাকিস্তানি বাহিনী পাল্টা গুলি করতে থাকে। এক পর্যায়ে সুবেদার রব তাঁর বাহিনী এবং বিএলএফ বাহিনীর সহ-অধিনায়ক তাহের হোসেন রুস্তমের নেতৃত্বে প্রায় ৩০-৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা হানিফ পাটোয়ারীর সঙ্গে যোগ দেন এবং লঞ্চের দিকে গুলি করতে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধাদের মারমুখী আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী গাজীপুর বাজারের পশ্চিম পাশে নদীর চরে লঞ্চটি উঠিয়ে দিয়ে সন্ধ্যার দিকে পালিয়ে যায়। বিএলএফ বাহিনী লঞ্চের মালামাল ও অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করে লঞ্চটি নদীতে ডুবিয়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের ১০নং সেক্টর গঠিত হয় বাংলাদেশ সমুদ্র-এলাকা, সমুদ্র বন্দরসমূহ, সকল নদনদী এলাকা ও নদী বন্দর নিয়ে। এ সেক্টরটি ছিল কর্নেল ওসমানীর সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীনে সকল নৌ-কমান্ডো ও নৌবাহিনী এ সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করে। ১০নং সেক্টরের কার্যক্রমের লক্ষ্য ছিল সমুদ্র ও নদীপথে পাকিস্তানি শত্রুদের নির্বিঘ্নে চলাচল বন্ধ করা এবং সমুদ্র ও নদী বন্দরসমূহ ব্যবহার করে অস্ত্র-গোলাবারুদ ও সামরিক কাজে ব্যবহৃত হয় এরূপ জিনিসপত্র আনা-নেয়ার কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করা। এতদুদ্দেশ্যে তদানীন্তন পাকিস্তান নৌবাহিনীর ৮ জন বাঙালি সদস্য এবং কয়েকশ ছাত্র- যুবককে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের সমন্বয়ে মুক্তিযুদ্ধের ১০নং সেক্টরের নৌকমান্ডো বাহিনী গঠন করা হয়।
২৯শে অক্টোবর নৌকমান্ডো মো. মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী বালিয়া গ্রামের আ. ওহাবের সহায়তায় ৫ পাউন্ড প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ নিয়ে চাঁদপুর শহরের পুরান বাজার ৫নং ঘাটের ডাল ভাঙ্গানোর মিল (আজাদ মিল)-এ অবস্থান নেন এবং সন্ধ্যার সময় নৌকাযোগে নদী পার হয়ে বার্মা ইস্টার্নের তেলের ডিপোতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তা ধ্বংস করেন। ফলে চাঁদপুর শহরের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়ে চতুর্দিক অন্ধকার হয়ে যায়।
২৯শে অক্টোবর লন্ডন ঘাট নামে পরিচিত চাঁদপুর নতুন বাজার সংলগ্ন নৌ-ঘাটিতে একটি জাহাজ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জন্য রসদ নিয়ে এসে অবস্থান নেয়। জাহাজটি ডুবিয়ে দেয়ার জন্য মমিন উল্লাহ পাটোয়ারীর নেতৃত্বে কমান্ডো ফজলুল কবির ও কমান্ডো আ. হাকিম ৩০শে অক্টোবর রাতের প্রথম প্রহরে সন্তর্পণে জাহাজের গায়ে লিমপেট মাইন লাগিয়ে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেন। এ অভিযানে জাহাজে অবস্থিত পাকিস্তানি সৈন্যদের মোকাবেলার জন্য ডাকাতিয়া নদীর দক্ষিণ তীরে সশস্ত্র অবস্থান নেন কমান্ডো শাহজাহান কবির, বোরহান উদ্দিন, সালাউদ্দিন, মাহবুবুর রহমান, সামছুল কবির, সিরাজ, সেলিম উল্লাহ খান, বাচ্চু মিয়া পাটোয়ারী প্রমুখ। মাইন লাগানোর ৩৫ মিনিট পর ৩টি মাইন বিস্ফোরিত হয় এবং জাহাজটি ডুবে যায়। ২০১০ সালে উক্ত জাহাজটি লন্ডন ঘাট থেকে উদ্ধার করা হয়। এটি বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ ড্রাই ডকইয়ার্ডে জব্দ অবস্থায় পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে।
২রা নভেম্বর কমান্ডো শাহজাহান কবির ও কমান্ডো সেলিম উল্লাহ খানের নেতৃত্বে একটি দল আমিরাবাদ লঞ্চঘাটে সয়াবিন তেলের ড্রাম বোঝাই ৫টি নৌকা আটক করে। নৌকাগুলোতে রক্ষিত ৩৮৫ ব্যারেল সয়াবিন তেল নিলামে বিক্রি করে প্রাপ্ত ১ লক্ষ ৭৩ হাজার টাকা চাঁদপুরের আ. করিম পাটোয়ারী এমপিএ-র নিকট হস্তান্তর করা হয়। তিনি এ অর্থ যুদ্ধোত্তর পুনর্বাসন কাজে ব্যয় করেন।
৪ঠা নভেম্বর প্রকাশ্য দিনের বেলায় জহিরাবাদ এলাকায় মেঘনা নদীতে অবস্থান নেয়া পাকিস্তান শিপিং কোম্পানির জাহাজ এম ভি সামীতে নৌ-কমান্ডো শাহজাহান কবির, সালাহউদ্দিন এবং সেলিম উল্লাহ খান লিমপেট মাইন লাগিয়ে জাহাজটি ডুবিয়ে দেন। জাহাজে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের বার্তা পেয়ে রেডক্রসের একটি জাহাজ এসে তাদের উদ্ধার করে। এ জাহাজ আক্রমণের খবর পেয়ে পাকিস্তানি গানবোট এসে নদীর তীরবর্তী এলাকায় নির্বিচারে গুলিবর্ষণ ও শেল নিক্ষেপ করে।
লন্ডন ঘাটে এম ভি লোরাম ডোবানোর পর থেকে রাত্রিকালে কোনো জাহাজ জাকাতিয়া নদীতে আর রাখা হতো না। চাঁদপুর শহর থেকে দূরে উত্তরে অথবা দক্ষিণে মেঘনা নদীতে সকল জাহাজ বা কার্গো অবস্থান করত। ৫ই নভেম্বর বিকেলে একটি চীনা পতাকাবাহী জাহাজ আকন হাটের কাছে মেঘনা নদীতে রাত কাটানোর উদ্দেশ্যে অবস্থান নেয়। রাতের বেলা নৌকমান্ডো মাহবুবুর রহমান, বাচ্চু মিয়া পাটোয়ারী, ফজলুল কবির এবং আ. হাকিম জাহাজটি লিমপেট মাইনের সাহায্যে ডুবিয়ে দেন।
পাকিস্তানি ওয়াটার ওয়েজের যাত্রীবাহী জাহাজ এম ভি লিলি ও এম ভি আলসামস ঢাকা-চাঁদপুর নৌপথে প্রতিদিন চলাচল করত। যুদ্ধকালে পাকিস্তানি সৈন্যরা এ রুটে চলাচলের জন্য জাহাজ দুটি ব্যবহার করত। ৭ই নভেম্বর এম ভি লিলি চাঁদপুরে যাত্রী নামিয়ে নিরাপদে রাত্রিকালে অবস্থানের জন্য একলাসপুর বাজারের কাছে খালের মুখে নোঙ্গর করে। এলাকায় অবস্থানকারী নৌকমান্ডোগণ এ সংবাদ পেয়ে জাহাজটিতে লিমপেট মাইনের বিস্ফোরণ ঘটান। মাইন বিস্ফোরণে জাহাজটি ডুবে যেতে দেখে জাহাজে অবস্থানকারী ক্রুরা দ্রুত জাহাজটি চালু করে নিকটবর্তী চরে নিয়ে গিয়ে জাহাজটি ফেলে রেখে দ্রুত পালিয়ে যায়। চট্টগ্রাম-লাকসাম-চাঁদপুর রেল লাইনটি নিরাপদ রাখার জন্য রাতের বেলা পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা বিশেষ টহলের ব্যবস্থা করা হয়। মাইশাদী গ্রামের অধিবাসী নৌকমান্ডো মমিন উল্লাহ পাটোয়ারী মাইশাদি ব্রিজসহ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর টহল ট্রেনটি উড়িয়ে দেয়ার জন্য ৯ই নভেম্বর রাতের বেলা রেল ব্রিজের মধ্যে ২০ পাউন্ড বিস্ফোরক এবং কমান্ডো আ. মান্নান রেল লাইন থেকে অল্প দূরবর্তী একটি টেলিফোনের পিলারে ৫ পাউন্ড বিস্ফোরক সংযোগ করে অদূরে ওঁৎ পেতে থাকেন। টহল রেল গাড়িটি ব্রিজের ওপর ওঠার মুহূর্তে বিস্ফোরিত হওয়ায় পাকিস্তানি সেনা বহনকারী রেল গাড়িটি দুর্ঘটনায় পড়ে এবং অনেকে নিহত ও আহত হয়। বেঁচে যাওয়া পাকিস্তানি সেনারা চারদিকে হাজার-হাজার রাউন্ড গুলি বর্ষণ ও মর্টার শেল নিক্ষেপ করে। এ সময় দূরবর্তী টেলিফোনের পিলারে কমান্ডো মান্নান বিস্ফোরণ ঘটান। পরের দিন সকাল বেলা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এলাকার ৮টি বাড়ির সকল ঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় এবং এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করে।
৮ই ডিসেম্বর চাঁদপুর থানা বিএলএফ-এর সহ-অধিনায়ক মো. তাহের হোসেন রুস্তমের নেতৃত্বে ৬০-৬২ জন বিএলএফ যোদ্ধা ভোর ৭টার সময় চাঁদপুর ইচলী ঘাট থেকে নদী পার হয়ে চাঁদপুর শহরে প্রবেশ করেন। শহরে অবস্থানরত ৭০- ৮০ জন রাজাকার অস্ত্রসহ বিএলএফ বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। এ-সময় রাজাকারদের নিকট থেকে বহু অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। বেলা ৮টার সময় চাঁদপুর শহর হানাদারমুক্ত হয় এবং মহকুমা প্রশাসকের অফিসের সম্মুখে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- সালাহ উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম (পিতা সাঈদ উদ্দিন আহমেদ, দাশাদী), নূর আহমেদ গাজী, বীর বিক্রম (পিতা ফরমান আলী গাজী, গোবিন্দিয়া), আবদুল হালিম, বীর বিক্রম (পিতা আলী হোসেন মিয়াজি, তরপুরচণ্ডী, বাবুরহাট), আব্দুল জব্বার পাটোয়ারী, বীর বিক্রম (পিতা আব্দুর রহমান পাটোয়ারী, চৌমুখা, কড়াইতলী), মমিনউল্লাহ পাটোয়ারী, বীর প্রতীক (পিতা মেহেরউল্লাহ পাটোয়ারী, মৈশাদী), আবদুল জব্বার, বীর প্রতীক (পিতা ইসমাইল হোসেন মিজি, কামরাঙা), মো. আলী আকবর মিজি, বীর প্রতীক (পিতা ওসমান আলী মিজি, পশ্চিম শকদি), মো. শাজাহান কবির, বীর প্রতীক- (পিতা মোহাম্মদ ইব্রাহীম, দাশদী, কল্যাণপুর) ও মো. শামসুল হক, বীর প্রতীক (পিতা ইসমাইল মিয়াজী, খাসিপুর)।
চাঁদপুর সদর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- নূর আহমেদ গাজী, বীর বিক্রম (চাঁদপুরের বাখরপুর গ্রামে শহীদ), আবদুল হালিম, বীর বিক্রম (কসবার চাঁদপুর গ্রামে শহীদ), মফিজুল ইসলাম সরদার (পিতা মো. আ. লতিফ সরদার, বিষ্ণুদী), রেহান উদ্দীন বেপারী (পিতা হাজী আ. আজিজ বেপারী, সিংহপাড়া, কুমিল্লা রোড), হাফেজুর রহমান (পিতা উত্তর শ্রীরামদী, জামতলা), শহীদুল্লাহ জাবেদ (পিতা হাজী মো. হেদায়েতুল্লাহ, শহীদ জাবেদ সড়ক; ১৩ই অক্টোবর শহীদ), দেলোয়ার হোসেন (পিতা তমিজ উদ্দীন ছৈয়াল, বিষ্ণুদী), কালা চাঁদ খান (পিতা আমজাদ খান, নিতাইগঞ্জ, পুরান বাজার), আবদুল মতিন বেপারী (পিতা আমজাদ আলী বেপারী, সোবহানপুর, নাগরা বাজার), আবদুল হাই পাটোয়ারী (পিতা ইয়াকুব আলী পাটোয়ারী, রাবীরচর, কামরাঙ্গা বাজার), আবুল বাসার (পিতা রমজান আলী মিজি, রামপুর, কামরাঙ্গা বাজার), জয়নাল আবেদীন (পিতা আলী আকবর বেপারী, চরভৈরবী), ইউসুফ খান (পিতা রামদাসদী, বহরীয়া), আবুল কালাম ভূঁইয়া (পিতা কল্যাণদী, বাবুরহাট), আয়াত উল্লাহ পাটোয়ারী (পিতা এবাদ উল্লাহ পাটোয়ারী, পুরান আদালতপাড়া), বাদশা মিয়া (পিতা আহম্মদ খান, দক্ষিণ ইচলী, বাগড়া বাজার), আ. সোবহান গাজী (পিতা হামিদ গাজী, বাঘাদী, বাগড়া বাজার), আবদুল মান্নান খান (পিতা ইউসুফ খান, উত্তর বালিয়া, হরিপুর বাজার), সাইফুদ্দিন আহমেদ (দাসদী, সফরমালী), জয়নাল আবেদীন (পিতা হাশেম, বিষ্ণুদী), মোকাম্মেল হোসেন (পিতা কারী আ. রহিম মিজি, বিষ্ণুদী), ইমদাদুল হক মৃধা (পিতা বন্দে আলী মৃধা, চরশোলদী, জসিম উদ্দিন (পিতা ছামাদ বেপারী, উত্তর গণ্ডাপাড়া), হানিফ গাজী (পিতা গফুর গাজী, কমলাপুর), মদিনুর ইসলাম পাটোয়ারী (পিতা ফজলুর রহমান পাটোয়ারী, রাড়ীরচর, বহরীয়া বাজার), আতিকুর রহমান বকাউল (পিতা মো. হাবিবুল্লাহ, দামোদরদী, মনোহরখালী), রিয়াজ উদ্দিন প্রধানিয়া (পিতা বিষ্ণুপুর, বড়দিয়া) ও আ. রব বেপারী (পিতা সৈয়দ আলী বেপারী, মৈশাদী)।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বেশকিছু স্মৃতিসৌধ এবং স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। ৩রা এপ্রিল হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বোমা বানাতে গিয়ে ৪ শহীদ কালাম, খালেক, শংকর ও সুশীলের স্মরণে ট্রাক রোডে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মুখে চাঁদপুরের বীর শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করে তাতে শহীদদের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। বড় স্টেশন বধ্যভূমিতে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ রক্তধারা। শহরের প্রাণকেন্দ্র শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সড়কে রেলওয়ে লেকের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিসৌধ অঙ্গীকার। চাঁদপুর পুলিশ লাইন্সে নির্মিত হয়েছে ‘চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ’ ভাস্কর্য। মিশন রোড থেকে চাঁদপুর-ফরিদগঞ্জ পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সড়ক। চৌধুরী ঘাট থেকে কালীবাড়ি পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মিজানুর রহমান চৌধুরী সড়ক। কালীবাড়ি থেকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে আ. করিম পাটোয়ারী সড়ক। কালীবাড়ি থেকে মিশন রোড পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সড়ক। হাসান আলী স্কুল থেকে আ. করিম পাটোয়ারীর বাড়ি পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে আবু ওসমান চৌধুরী সড়ক। ট্রাকস্ট্যান্ড থেকে ট্রাক রোড পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ জাবেদ সড়ক। মিশন রোড থেকে ইচলী পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ কালাম, খালেক, শংকর ও সুশীল সড়ক। এছাড়া শহীদ সামছুল হক তালুকদারের নামে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয়েছে। [মোহেববুল্লাহ খান ও মনিরুজ্জামান শাহীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!