You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.29 | চাঁদহাট যুদ্ধ (নগরকান্দা, ফরিদপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

চাঁদহাট যুদ্ধ (নগরকান্দা, ফরিদপুর)

চাঁদহাট যুদ্ধ (নগরকান্দা, ফরিদপুর) সংঘটিত হয় ২৯শে মে ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা থানা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে চাঁদহাট বাজারে। এদিন নগরকান্দা থেকে ২০-২৫ জনের পাকিস্তানি সেনাদল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পায়ে হেঁটে চাঁদহাটের দিকে অগ্রসর হয়। সঙ্গে আবু জাফরের নেতৃত্বে একটি রাজাকার- দল ছিল। এ সংবাদ পৌছানোর পর কমান্ডার আজিজ মোল্লার নেতৃত্বে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত হন। তাদের হাতে ইতঃপূর্বে নগরকান্দা থানা থেকে উদ্ধারকৃত রাইফেল ও ব্যাটাগান এবং একটি মাত্র স্টেনগান ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি হন। চাঁদহাটের উত্তরে কুমারদিয়ার সামনে প্রতিরোধব্যূহ রচনা করা হয়। সেখানে কমান্ডার আজিজ মোল্লার সঙ্গে সশস্ত্র ৫ জন-সহ মোট ১০জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। পশ্চিম দিকে দোহিসারার রশিদ ফকিরের নেতৃত্বে ১০ জনের আরেকটি মুক্তিযোদ্ধা দল অবস্থান নেয়। আর নগরকান্দা-চাঁদহাট রাস্তায় আলতাফ হোসেন খানের নেতৃত্বে ৪ জন সশস্ত্র যোদ্ধা অবস্থান নেন। তাঁদের পেছনে ছিল ঢাল-সড়কি হাতে হাজারো জনতা। জনতার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছিল। পাকিস্তানি সেনারা যখন ৩০০ গজের মধ্যে এসে পড়ে, তখন আজিজ মোল্লা গুলি শুরু করার সঙ্গে-সঙ্গে তিন পাশ থেকে আক্রমণ শুরু হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের জবাবে পাকসেনারা ঝাঁকে-ঝাঁকে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। কিন্তু তাদের লক্ষ্য ব্যর্থ হয়। ঢালু স্থান থেকে গুলি করায় তা মুক্তিযোদ্ধাদের মাথার অনেক ওপর দিয়ে চলে যায়। পক্ষান্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে একাধিক পাকিস্তানি সেনা গুলিবিদ্ধ হয়। ফলে তারা পিছু হটতে শুরু করে। বুলেটবিদ্ধ এক পাকিস্তানি সেনা খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে ব্রাশফায়ার করতে থাকলে মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ রাস্তার ধার দিয়ে ক্রলিং করে সেখানে পৌঁছান এবং রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করলে পাকসেনাটি লুটিয়ে পড়ে। তখন তিনি তার হাত থেকে এলএমজি তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে গুলি করতে শুরু করেন। তখন চারপাশে সমবেত হাজার-হাজার জনতা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে ফেটে পড়ে। পাকিস্তানি সেনারা দিশেহারা হয়ে বিলে নেমে যায়। এই সময় তাদের পথপ্রদর্শক রাজাকার জাফর জনতার হাতে ধরা পড়ে। বিক্ষুব্ধ জনতা তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের স্টেনগানের ব্রাশফায়ারে এক সঙ্গে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা বিলের মধ্যে লুটিয়ে পড়ে। বিলটির চারপাশে হাজার-হাজার মানুষ পাকিস্তানি সেনাদের ঘিরে রাখে। জনগণ বিলের মধ্যে নেমে পাকিস্তানি সেনাদের সড়কি-বল্লম দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। এ-যুদ্ধের সময় ঈশ্বরদীর বাগাট, পাইককান্দাসহ বিভিন্ন গ্রামের মহিলারা চিড়া, গুড়, দুধ, রুটি, ডাব ইত্যাদি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে।
যুদ্ধে ঢাল-সড়কি হাতে লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা নাগারদিয়ার আবু বকর সরদার (পিতা ফাগু সরদার) এবং ঈশ্বরদীর নুরু (পিতা মুজিব মাতব্বর) শাহাদত বরণ করেন। ঢাল-সড়কি নিয়ে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র এগিয়ে দিতে গিয়ে মনোয়ারা বেগম নামে এক নারী শহীদ হন। পক্ষান্তরে ১ জন ক্যাপ্টেন, ২ জন লেফটেন্যান্ট-সহ ২৬ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। তিনটি মিডিয়াম মেশিনগান, একটি স্টেনগান, চারটি চায়নিজ রাইফেলসহ ৩০টি অস্ত্র ও বহু গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
আজিজ মোল্লা, রশিদ ফকির ও আলতাফ হোসেন ছাড়া যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন বারেক হাবিলদার (পরবর্তী সময়ে শহীদ), মোফাজ্জেল হোসেন খসরু, ইসরাইল, ইসহাক, দেলোয়ার হোসেন, আওয়াল প্রমুখ। উল্লেখ্য, পাকিস্তানি বাহিনী পরে অপর এক অভিযানে নগরকান্দার বিভিন্ন গ্রামে পুঁতে রাখা তাদের সৈন্যদের ১৮টি লাশ উদ্ধারে সক্ষম হয়। ঐ লাশগুলো আলীপুর গোরস্তানে দাফন করে। দুই সেনা কর্মকর্তার লাশ আলাদাভাবে এবং ১৬ সিপাহির লাশ একত্র করে দাফন করা হয়। ঐ কবরগুলো এখনও রয়েছে। স্বাধীনতার পর বিক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণ নামফলকসহ কবরের কিছু অংশ ভেঙে ফেলে। [আবু সাঈদ খান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড