You dont have javascript enabled! Please enable it!

চাঁদহাট যুদ্ধ (মুকসুদপুর, গোপালগঞ্জ)

চাঁদহাট যুদ্ধ (মুকসুদপুর, গোপালগঞ্জ) সংঘটিত হয় ২৯শে মে। এতে ২৭ জন পাকসেনা ও রাজাকার- নিহত হয় এবং ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চাঁদহাট যুদ্ধ বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার একটি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ। এ-যুদ্ধ ছিল এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের টার্নিং পয়েন্ট। এ-যুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা- জনতার মহাবিজয়, আর পাকবাহিনীর আতঙ্কের কারণ। এ- যুদ্ধের কথা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র- থেকে ফলাও করে প্রচার করা হয়। এম আর আক্তার মুকুল – তাঁর -চরমপত্র -এ এ-যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘বাংলার বিচ্ছু বাহিনী পাক হানাদারদের জব্বর মাইর দিছে।’ এতে সারা বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা উজ্জীবিত হন।
২৭শে মে রাজাকার জাফরের নেতৃত্বে ৫-৬ জন রাজাকার রাইফেল নিয়ে চাঁদহাটে আসে। তারা প্রথমে বর্নিক পাড়ার ভুবন পোদ্দারের বাড়িসহ কয়েকটি বাড়িতে গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে এবং চাঁদা নেয়, সাহাপাড়ার বলাই সাহার বাড়িতে গিয়ে ডাব পেড়ে খায়। মুক্তিযোদ্ধা আ. আজিজ মোল্লার গ্রুপের সদস্যরা এ খবর পেয়ে তাহাদের ধরতে গেলে রাজাকাররা রাইফেল ফেলে পালিয়ে যায়। তারা নগরকান্দা থানায় গিয়ে ফরিদপুর সেনা ক্যাম্পে সংবাদ দেয় এবং আজিজ মোল্লার দলকে ধরার জন্য পরদিন ২৮শে মে প্রায় ৫০ জন পাকসেনা ও রাজাকার নিয়ে জাফর রাজাকার চাঁদহাট অভিমুখে যাত্রা করে।
২৯শে মে সকাল ৮টার দিকে তারা নগরকান্দা থানা থেকে রওনা হয়ে ঈশ্বরদী-নুঘুরদিয়া পার হয়ে দমদমার খালের পাড় দিয়ে আসতে থাকে। এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা আগের দিনই তাদের আসার খবর পেয়ে যান। আ. আজিজ মোল্লার নেতৃত্বে আ. ওয়াজেদ মোল্লা (লোহাইড়), আ. রশিদ ফকির, ইসরাইল ফকির, মতি কাজি, ওলিয়ার রহমান, আলতাপ হোসেন খান, আবু বকরসহ ১৪-১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা সিন্ধান্ত নেন যে, তাঁরা পাকসেনাদের বিনাযুদ্ধে যেতে দেবেন না। তাই হানাদাররা যে-পথ দিয়ে আসছিল, তাঁরা সেই পথের কুমারদিয়া বিলের দক্ষিণ পাশে পরিখা খনন করে অবস্থান নেন। ওয়াজেদ মোল্লার নিকট চাইনিজ এসএমজি ছিল। তিনি এবং আ. আজিজ মোল্লার সঙ্গের কয়েকজন দক্ষিণ পাশে পজিশনে থাকেন। আ. রশিদ ফকির ও ইসরাইল ফকিরসহ কয়েকজন ২টি রাইফেল ও ১টি বন্দুক নিয়ে পূর্বদিকে শ্রীবর্দী গ্রামের পাশে এবং অলতাফ হোসেন খান ও ওলিয়ার রহমানসহ ৪-৫ জন পশ্চিম পাশে অবস্থান নেন। আলতাফ হোসেনদের নিকট রাইফেল ও বন্দুক ছিল। পাকসেনারা রেঞ্জের মধ্যে আসতেই ওয়াজেদ মোল্লা তাঁর এসএমজি দিয়ে ব্রাশ ফায়ার শুরু করেন। এতে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং বাকিরা পজিশনে চলে যায়। এরপর উভয় পক্ষে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে ফায়ার করতে থাকেন। পাকসেনারা বুঝতে পারে যে, তাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। তারা ভীত হয়ে পড়ে। অপরদিকে তিন পাশের গ্রামের সাধারণ জনগণ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে সমগ্র এলাকা কাঁপিয়ে তুললে পাকসেনারা আর টিকে থাকতে পারেনি। হাজার- হাজার জনতার গগনবিদারী ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস বেড়ে যায়। তাঁরা প্রাণপণ যুদ্ধ করে এগিয়ে গেলে পাকসেনারা পিছু হটার চেষ্টা করে। মুক্তিযোদ্ধারা আরো নিকটে গিয়ে তাদের লক্ষ করে গুলি করতে থাকেন। এভাবে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ভায়াবহ যুদ্ধ চলে। পাকসেনারা বিলের ভেতর কাদা- পানিতে আটকে যায়। কয়েক জন ছোট-ছোট পাটক্ষেতের মধ্যে পড়ে ছিল। রাজাকার জাফরও তাদের মধ্যে ছিল। বাকিরা পালিয়ে যায়। পথ ভুলে ১ জন পাকসেনা পুরাপাড়ার দিকে চলে গেলে সেখানে তাকে হত্যা করে তার অস্ত্রটি নিয়ে যাওয়া হয়। দইসরা গ্রামের আলেপ বিশ্বাস দেশীয় অস্ত্র ঢাল-শড়কি নিয়ে পাকসেনাদের ওপর অক্রমণ করতে গেলে বাগাট ধোপাবাড়ির নিকট পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হন। ওয়াজেদ মোল্লার এসএমজি এবং তাঁর অদম্য সাহস ও নৈপুণ্য এ-যুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রাখে। যুদ্ধে ১ জন ক্যাপ্টেন ও ১ জন লেফটেন্যান্টসহ ২২ জন পাকসেনা ও রাজাকার জাফরসহ ৫ জন রাজাকার নিহত হয়। তাদের ১টি এলএমজি, ৩টি এসএমজি, ১টি চাইনিজ রাইফেল, ২৩টি রাইফেল এবং বেশকিছু গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
এ-যুদ্ধের দু-তিন দিন পর পাকসেনারা উত্তরে নগরকান্দা থানা, পূর্বে ভাঙ্গা থানা, দক্ষিণে মুকসুদপুর থানা এবং পশ্চিমে বোয়ালমারী থানার ২-৩ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অভিযান চালায়। আকাশ পথে হেলিকপ্টার থেকে পাকসেনাদের নামিয়ে দেয়। তারা চাঁদহাট, কুমারদিয়া, ঈশ্বরদী, ছোট পাইটকান্দী, দইসারা, ব্রাহ্মণডাঙ্গা, পুরাপাড়া, শ্রীবর্দী, কানফর্দী, আসফর্দী, বাগাট, গজারিয়া, মেহেরদিয়াসহ বিভিন্ন গ্রামের কয়েকশ ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয় এবং শতাধিক মানুষকে হত্যা করে। [মো. ফিরোজ খান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!