মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র- থেকে প্রচারিত সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান চরমপত্র
চরমপত্র মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র- থেকে প্রচারিত সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। এর নামকরণ করেন বেতার কেন্দ্রের একটি বিভাগের সমন্বয়কারী আশফাকুর রহমান খান। এটি রচনা ও প্রচার করেন এম আর আখতার মুকুল। এম আর আখতার মুকুল ছাত্রজীবনে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন ভাষাসৈনিক। তিনি বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি তথ্য ও প্রচার অধিকর্তা ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার (২৬শে মার্চ) চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়ে ৫ দিন টিকে ছিল। এরপর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা হয়ে ২৫শে মে কলকাতার বালিগঞ্জ থেকে ৫০ কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন একটি ট্রান্সমিটারের সাহায্যে মুজিবনগর সরকারের তত্ত্বাবধানে চূড়ান্ত পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গরূপে এর প্রচারকার্য শুরু হয় (দ্রষ্টব্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র)।
কলকাতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শুরুর দিন থেকেই চরমপত্র অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হতে থাকে। চরমপত্র ছিল আসলে একেকটি কথিকা। এর শেষ কথিকাটি প্রচারিত হয় ১৬ই ডিসেম্বর। এ পর্যন্ত চরমপত্রের মোট ১১৭টি কথিকা প্রচারিত হয়। কথিকাগুলো এম আর আখতার মুকুল নিজেই রচনা এবং স্বকণ্ঠে পাঠ করতেন। প্রতিটি কথিকা প্রচারের জন্য সময় নির্ধারিত ছিল ৮-১০ মিনিট।
চরমপত্র রচনার প্রয়োজনে এম আর আখতার মুকুলকে প্রায়শই বিভিন্ন রণাঙ্গন পরিদর্শন করতে হয়েছে। ফলে যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনে তিনি সক্ষম হন। তাছাড়া পিতার চাকরির সুবাদে তাঁকে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুলে পড়াশুনা করতে হয়েছে। এর ফলে ঐসব এলাকার আঞ্চলিক ভাষা তিনি চমৎকারভাবে আয়ত্ত করেন। চরমপত্রে তিনি সেসব আঞ্চলিক ভাষার শব্দ ব্যবহার করায় সেগুলো একদিকে যেমন বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি সর্বস্তরের মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। মাঝে-মধ্যে তিনি উর্দু ও ফার্সি শব্দও ব্যবহার করতেন। তিনি কিছুকিছু নতুন শব্দও সৃষ্টি করেন, যেগুলো পরবর্তীকালে বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে। প্রথম দিকে তিনি চরমপত্রে মার্জিত ভাষা ব্যবহার করলেও পরে প্রধানত ঢাকাইয়া ভাষা ব্যবহার করেন। সেই সঙ্গে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাও ব্যবহার করেন।
চরমপত্র প্রধানত মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ ও উদ্দীপনা দানের জন্য রচিত ও পরিবেশিত হয়। তবে বাংলাদেশে শত্রু কবলিত সাড়ে ৬ কোটি জনগণ এবং ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী ১ কোটি শরণার্থীর মনোবল বৃদ্ধি করতে তা ছিল খুবই সহায়ক। এছাড়া এর মাধ্যমে গল্পের ছলে দেশী-বিদেশী রাজনীতি ও রণনীতির ব্যাখ্যা এবং রণাঙ্গনের খবরাখবর অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে উপস্থাপন করা হয়।
চরমপত্র ছিল আসলে একটি ব্যাঙ্গাত্মক অনুষ্ঠান। এ কারণেই এর স্রষ্টা এম আর আখতার মুকুল একে রসাত্মক করে তোলার জন্য নিজের কণ্ঠস্বরকে বিভিন্ন রূপ ও ভঙ্গিতে পরিবর্তন করে চরমপত্র পাঠ করতেন। এটি ছিল তাঁর এক বিশেষ উদ্ভাবনী শক্তি। আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার ও বিচিত্র কণ্ঠস্বরের কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় চরমপত্র দুই বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার নিকট অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। এ অনুষ্ঠানটি শোনার জন্য শ্রোতৃমণ্ডলী উন্মুখ হয়ে থাকত। যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমে এ অনুষ্ঠান শুনে দারুণভাবে উজ্জীবিত হতেন এবং স্বদেশের মুক্তির জন্য জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে প্রবল উৎসাহে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন।
চরমপত্রে ভাষার ব্যবহার ও সেক্ষেত্রে পরিবর্তন বুঝাতে দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রথম ও শেষ কথিকার কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলো। প্রথম কথিকা: ‘ঢাকা শহর ও নারায়ণগঞ্জ থেকে ভয়াবহ দুসংবাদ এসে পৌঁছেছে। গত ১৭ই এবং ১৮ই মে তারিখে খোদ ঢাকা শহরের ছ’জায়গায় হ্যান্ড গ্রেনেড ছোঁড়া হয়েছে। এসব জায়গার মধ্যে রয়েছে প্রাদেশিক সেক্রেটারিয়েট, স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান, হাবিব ব্যাংক, মর্নিং নিউজ অফিস, রেডিও পাকিস্তান আর নিউ মার্কেট। পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যদের দখলকৃত ঢাকা নগরীতে মুক্তিফৌজদের এধরনের গেরিলা তৎপরতা সামরিক জান্তার কাছে নিঃসন্দেহে এক ভয়ানক দুঃসংবাদ বৈকি।’
শেষ কথিকা: ‘কি পোলারে বাঘে খাইলো? শ্যাষ। আইজ থাইক্যা বঙ্গাল মুলুকে মছুয়াগো রাজত্ব শ্যাষ। ঠাস্ কইর্যা একটা আওয়াজ হইলো। কি হইলো? কি হইলো? ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পিঁয়াজী সা’বে চেয়ার থনে চিত্তর হইয়া পইড়া গেছিলো। আট হাজার আষ্টশ’ চুরাশি দিন আগে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট তারিখে মুছলমান-মুছলমান ভাই-ভাই কইয়া, করাচী-লাহুর-পিন্ডির মছুয়া মহারাজরা বঙ্গাল মুলুকে যে রাজত্ব কায়েম করছিল, আইজ তার খতম্ তারাবী হইয়া গেল।
চরমপত্র রচনা ও প্রচারের পেছনে এম আর আখতার মুকুলের স্ত্রী ড. মাহমুদা খানম রেবা-র অবদান ছিল অপরিসীম। এম আর আখতার মুকুল ভোর ৪টায় উঠে কথিকা লিখতে বসতেন এবং লেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁর স্ত্রী তাঁকে সকালের নাশতা পর্যন্ত খেতে দিতেন না। তিনি অনবরত স্বামীকে বলতেন, যত কষ্টই হোক চরমপত্র তাঁকে লিখতেই হবে। চরমপত্র মুক্তিযুদ্ধের এক অমূল্য সম্পদ। [দুলাল ভৌমিক]
তথ্যসূত্র: এম আর আখতার মুকুল, চরমপত্র, অনন্যা, ঢাকা ২০১০ (তৃতীয় মুদ্রণ)
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড