You dont have javascript enabled! Please enable it!

স্থানীয় মুক্তিবাহিনী চাঁদ কোম্পানি (চিলমারী, কুড়িগ্রাম)

চাঁদ কোম্পানি (চিলমারী, কুড়িগ্রাম) স্থানীয় একটি মুক্তিবাহিনী। কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী রণাঙ্গনের অন্যতম প্রধান কোম্পানি কমান্ডার আবুল কাশেম চাঁদের নামানুসারে এ কোম্পানি গড়ে ওঠে। তিনিই এ কোম্পানির প্রধান ছিলেন। মানকারচর সাব-সেক্টরের বিভিন্ন যুদ্ধে এ কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন আবুল কাশেম চাঁদ। সেখানে তিনি ছাত্রলীগ-এর সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলনে ঢাকার রাজপথে মিছিল-সমাবেশে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল। ৭০-এর নির্বাচনে তিনি চিলমারী-উলিপুর ও রৌমারী আসনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করেন। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর আবুল কাশেম চাঁদ নিজ এলাকা চিলমারীতে ফিরে আসেন। সেখানে তিনি সংগ্রাম কমিটি গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি চিলমারীতে স্থানীয় আনসারদের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু করেন। তিনি প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে রৌমারীতে অবস্থান নেন। মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর আবু তাহের, হামিদুল্লাহ খান, লে. নুরুন্নবীসহ সামরিক কর্মকর্তাদের এ এলাকায় আগমনের বহু পূর্বেই আবুল কাশেম চাঁদ রৌমারীতে সামরিক কার্যক্রম শুরু করেন। তিনি চিলমারীর সন্তান হওয়ায় চিলমারী, রৌমারী ও কুড়িগ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে অবগত ছিলেন। ফলে বিভিন্ন সময় বাঙালি সামরিক অফিসাররা তাঁকে এ এলাকায় নানা দায়িত্ব দেন। সেক্টর কমান্ডার মেজর তাহেরের নির্দেশে তিনি ঐতিহাসিক চিলমারী যুদ্ধের নকশা প্রণয়ন করেন। প্রথমে তিনি মাটি দিয়ে ঐ যুদ্ধ পরিকল্পনার নকশা প্রণয়ন করে সামরিক অফিসারদের দেখান। নকশা অনুমোদিত হলে তা কাগজে লিপিবদ্ধ করে চিলমারী যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। সেক্টরভিত্তিক পরিকল্পিত যুদ্ধের জন্য রৌমারী রণাঙ্গনে বেশকিছু কোম্পানি গঠন করা হয়। এসব কোম্পানির নামকরণ করা হয় কেম্পানি কমান্ডারদের নামে। চাঁদ কোম্পানি মানকারচর সাব-সেক্টর তথা রৌমারী রণাঙ্গণে অবস্থান নেয়। এরকম বেশ কয়েকটি কোম্পানির মধ্যে সুবেদার আফতাবের নেতৃত্বে গঠিত আফতাব বাহিনী, নজরুল ইসলাম ওরফে খায়রুল আলমের নামে খায়রুল আলম কোম্পানি, মাহবুব এলাহি রঞ্জুর নেতৃত্বে রঞ্জু কোম্পানির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ভয়াল ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে চিলমারী-উলিপুরে বহু অপারেশনে চাঁদ কোম্পানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৭ই অক্টোবরের চিলমারী যুদ্ধ, বালাবাড়ি রেলস্টেশন অপারেশন, চিলমারী থানা অপারেশন, কুড়িগ্রাম-উলিপুর সীমান্তের অর্জুনেরডারা ব্রিজ অপারেশন, কয়ারপাড়ের যুদ্ধ, উলিপুর ডাকবাংলো অপারেশন, হাতিয়ার যুদ্ধ, হালাবট অপারেশনে এ কোম্পানির কমান্ডার ও মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। ৬ই ডিসেম্বর চিলমারী হানাদারমুক্ত হওয়ার পর সেখানে সিভিল প্রশাসন চালু হলে আবুল কাশেম চাঁদ প্রশাসক নিযুক্ত হন। চাঁদ কোম্পানির উপঅধিনায়ক ছিলেন রবিউস সামাদ। এ কোম্পানির এলএমজি-ম্যান মো. আব্দুর রাজ্জাক, প্লাটুন ১- এর কমান্ডার এফএফ আব্দুল জব্বার টাইগার ওরফে ছক্কু, সহকারী কমান্ডার এ কে এম ফজলুল হক, সেকশন কমান্ডার মো. মকবুল হোসেন, মো. সহিদুল ইসলাম, মো. আব্দুস ছালাম; প্লাটুন ২-এর কমান্ডার ছিলেন এম এফ কাইজুল হক, সেকশন কমান্ডার ছিলেন মো. নওশের আলী, এফএফ ওহেদুল, মো. ইয়াকুব আলী; প্লাটুন ৩-এর সেকশন কমান্ডার মো. ওবায়ুদল হক, সহকারী কমান্ডার মো. মহির উদ্দিন, সেকশন কমান্ডার মো. মসিয়ার রহমান, মো. ইয়াকুব আলী, শহিদ আব্দুর রহিম এবং প্লাটুন-৩-এর কমান্ডার নূর আহম্মেদ আলো, সেকশন কমান্ডার এফএফ মো. আব্দুল জলিল, মো. আব্দুস সবুর, মো. মমিনুল হক, এফএফ পঁচু, সেকশন কমান্ডার মো. মহিউল আলম, মো. আব্দুর রহিম এ এলাকার বিভিন্ন যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ কোম্পানিতে ৩শর বেশি নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এসব মুক্তিযোদ্ধার মধ্য থেকে এক বা একাধিক প্লাটুন গঠন করে বিভিন্ন অপারেশনে পাঠানো হতো। চাঁদ কোম্পানির চিলমারী রেইড নিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র – থেকে এম আর আখতার মুকুল কথিকা প্রচার করেন। তিনি চাঁদ কোম্পানিকে ‘বিচ্ছু বাহিনী’ হিসেবে অভিহিত করেন। কোম্পানি কমান্ডার আবুল কাশেম চাঁদের সাহস ও কুশলী কর্মকাণ্ডে মিত্রবাহিনীর কমান্ডারা খুশি ছিলেন। জেনারেল গুলবক্স সিং গিল তাঁকে নিজের তাবুতে নৈশভোজে আমন্ত্রণ করে চিলমারী যুদ্ধের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। [এস এম আব্রাহাম লিংকন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!