চর মছলন্দ, চর আলগী ও চর কামারিয়া গণহত্যা (গফরগাঁও, ময়মনসিংহ)
চর মছলন্দ, চর আলগী ও চর কামারিয়া গণহত্যা (গফরগাঁও, ময়মনসিংহ) ১৫ই নভেম্বর সংঘটিত হয়। হানাদার বাহিনীর এ নারকীয় গণহত্যায় অর্ধশতাধিক মানুষ শহীদ হন।
ইকবাল-ই-আলম কোম্পানির একটি গ্রুপের নেতা ছিলেন মফিজ চেয়ারম্যান। এ গ্রুপের ঘাঁটি ছিল নয়ার চর। কয়েকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে সাহস ও সাফল্য প্রদর্শন করায় এ গ্রুপটি পাকবাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয়। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত গেরিলা বাহিনীর এ সদস্যদের অবস্থানের খবর পেয়ে ভারী অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে হানাদার বাহিনীর প্রায় শতাধিক সৈন্যের একটি দল স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি (রমজান মাস) উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী তিনটি গ্রাম চর মছলন্দ, চর আলগী ও চর কামারিয়ায় সকালবেলা অতর্কিতে আক্রমণ করে।
ভোরবেলা পাকিস্তানি বাহিনী চরের দিকে অগ্রসর হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের গতিবিধি আঁচ করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়েন। কিন্তু দ্রুত তাঁরা শত্রুসেনাদের বিপুল জনবল ও অস্ত্রবলের খবর জানতে পারেন। স্থানীয় জনগণের সহায়তায় তাঁরা ব্রহ্মপুত্র নদের খেয়া পারাপার ও নৌকা বন্ধ করে দেন। অবস্থা বুঝে হানাদার বাহিনী গফরগাঁও বাজার থেকে রৌহা গ্রামের দিকে যায়। অতঃপর রাজাকার- মফিজ ও বাবুলের সহযোগিতায় তারা নৌকা সংগ্রহ করে নদী পাড় হয়ে চর কামারিয়ায় অবস্থান নেয়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি পার্শ্ববর্তী নান্দাইল থানায় নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান।
নদী পার হয়ে হানাদাররা বাড়ি-বাড়ি তল্লাশি করে কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে না পেয়ে ৩টি গ্রামে নৃশংস তান্ডব শুরু করে। তারা চর মছলন্দ, চর কামারিয়া ও চর আলগী গ্রামের ১৪৬২টি বাড়িতে আগুন দেয় এবং গণহত্যায় চালায়। এ গণহত্যায় প্রত্যক্ষদর্শী বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুজিব বাহিনী-র গফরগাঁও অঞ্চলের ডেপুটি লিডার মো. আমজাদ আলী এবং চর আলগীর মাদ্রাসা শিক্ষক আব্দুল কুদ্দুস মাস্টার। পাকবাহিনী বাড়িতে হানা দিলে বাড়ির নারী ও শিশুরা আশেপাশের জঙ্গল ও ধানক্ষেতে আশ্রয় নেয়। হানাদার বাহিনী ঘোষণা করে নারী ও শিশুরা নিরাপদ, তাদের কোনো ভয় নেই। কুদ্দুস মাস্টার নামে গ্রামের একজন তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের বাড়িতে আসতে বলে। স্ত্রী ভয়ে না এলেও তাঁর ৭ বছর বয়সী পুত্র আব্দুল্লাহ বাবার কাছে আসে। এরপর হানাদার বাহিনী বাবা ও ছেলেকে এক দড়িতে পিছমোড়া দিয়ে বেঁধে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। চর মছলন্দ গ্রামের কুরতলী পাড়ায় এক বৃদ্ধা ছিলেন অন্ধ। পাকবাহিনী ঐ পাড়ায় প্রবেশ করছে দেখে বৃদ্ধার ছেলে মা-কে কোলে নিয়ে পালাতে থাকে। সম্মুখ থেকেও আরেকদল হানাদার আসার খবরে ছেলে তার বৃদ্ধা অন্ধ মা-কে মারবে না ভেবে রাস্তার পাশে বসিয়ে রেখে নিজে নিরাপদ আশ্রয় নেয়। হানাদাররা এ অন্ধ বৃদ্ধাকেও রেহাই দেয়নি। তাকে টেনে হিঁচড়ে সামনের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। কুরতলী পাড়ায় আমানউল্লাহ শেখের ছেলে উসমান আলী (কেফু পাগলা)। সে গ্রামের মিছিল শুনে ‘জয় বাংলা’ শিখে প্রায়ই চিৎকার করে তা বলত। পাকিস্তানিরা মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেটিকেও নৃশংসভাবে হত্যা করে।
চরের এই গ্রামত্রয়ে হত্যাযজ্ঞ চালানোর সময় পাকবাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পায়নি মসজিদ ও পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন শরীফও। তারা জনৈক আমীর আলীকে মসজিদে কুরআন পাঠরত অবস্থায় হত্যা করে। আব্দুর রহমান নামের এক ব্যক্তি প্রাণভয়ে মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিলেন, হানাদাররা মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয়। হানাদার বাহিনীর চর মছলন্দ, চর আলগী ও চর কামারিয়া গণহত্যায় অর্ধশতাধিক গ্রামবাসী শহীদ হন। তাদের মধ্যে ৩০ জনের পরিচয় জানা যায়। তারা হলেন- ফজর আলী (পিতা উমেদ আলী), মহব্বত আলী (পিতা উমেদ আলী), মোহাম্মদ আলী (পিতা উমেদ আলী), আলিমন নেছা (স্বামী আ. গফুর), ছফির উদ্দিন (ছফু), সূৰ্য্যত আলী (পিতা ছফির উদ্দিন), শহর আলী, আ. কুদ্দুস আলী (পিতা নাছির উদ্দিন ফকির), আব্দুল্লাহ (পিতা শহীদ আ. কুদ্দুস মাস্টার), চাঁন মিয়া (পিতা আ. জব্বার ওরফে মইলা শেখ), আ. রহমান কড়ি, আমির আলী মাস্টার (পিতা আ. রহমান সরকার), আ. রহিম আকন্দ (পিতা কেনা আকন্দ), আইয়ুব আলী ফকির, আলীমদ্দিন (পিতা আ. রহমান সরকার), নিজাম উদ্দিন গতা (পিতা আউলি শেখ), নূর হোসেন (পিতা বেছু শেখ), আমীর আলী (পিতা আছর আলী শেখ), উসমান আলী ওরফে কেফু পাগলা (পিতা আমান উল্লাহ শেখ), বদর উদ্দিন (বদু), ফজর আলী (পিতা ওয়াহেদ আলী), আব্দুল বারেক, গিয়াস উদ্দিন (পিতা আহম্মদ আলী), ইন্নছ আলী (পিতা ইব্রাহীম সরকার), সিরাজ উদ্দিন (পিতা ছোবেদ আলী), হাফিজ উদ্দিন, বুদির মা, আবলি শেখ (আব্দুল শেখ), আব্দুর রহমান (নিজাম উদ্দিন) ও টিয়ার মা। [নিপা জাহান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড