You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.25 | চরবাড়িয়া গণহত্যা (বরিশাল সদর) - সংগ্রামের নোটবুক

চরবাড়িয়া গণহত্যা (বরিশাল সদর)

চরবাড়িয়া গণহত্যা (বরিশাল সদর) সংঘটিত হয় ২৫শে এপ্রিল। এতে ৪৭ জন নিরীহ গ্রামবাসী হত্যার শিকার হয়।
বরিশাল শহর থেকে ৪ কিমি উত্তরে চরবাড়িয়া ইউনিয়ন। চরবাড়িয়া এবং শায়েস্তাবাদ ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে ঝুনাহার নদী বহমান। ঘটনার দিন পাকিস্তানি বাহিনী ৩টি গানবোটে করে এসে যখন বরিশাল শহর দখল করার উদ্দেশ্যে ঝুনাহার নদী অতিক্রম করছিল, তখন নদীর দুধারে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিরোধ করেন। উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী অস্ত্রের আক্রমণে ইরানী ও মাহজভী নামে দুটি স্টিমার ডুবে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। বাধাপ্রাপ্ত হয়ে হানাদার বাহিনী ঢাকায় যোগাযোগ করে। কিছুক্ষণের মধ্যে জঙ্গি বিমানের প্রহরায় দুটি হেলিকপ্টার থেকে ৩ বার তালতলী বাজারের পূর্বপাশে ছত্রীসেনা নামানো হয়। সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করে তারা ৩টি গানবোটের একটি তালতলী বাজারের পূর্বপাশে হাওলাদার বাড়ির সামনে, একটি তালতলী বাজারের পশ্চিম পাশে আবদুর রহমান খানের বাড়ির সমানে এবং অপরটি আরো পশ্চিমে মুন্সী আলী আজিম খানের বাড়ির সম্মুখে নোঙর করে। গানবোট থেকে নেমেই তারা ভারী অস্ত্র দিয়ে নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গণহত্যার সঙ্গে তারা লুণ্ঠন এবং শতাধিক ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক চরবাড়িয়া গণহত্যায় ৪৭ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, পিতা-পুত্র, মাতা-সন্তান, স্বামী-স্ত্রী কেউই তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। তারা ৯০ বছরের এক বৃদ্ধকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে- খুঁচিয়ে হত্যা করে। ট্রেন্সে এবং পুকুরে আশ্রয় নেয়া বেশ কয়েকজনকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। ৮ মাস থেকে ২ বছরের শিশু যেমন মায়ের কোলেই শহীদ হয়েছে, তেমনি শিশু পুত্রকে বাঁচাতে গিয়ে মা শহীদ হয়েছেন। পাকিস্তানি বাহিনীর দেয়া আগুনে শহীদদের কয়েজনের মৃতদেহ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। গণহত্যার সময় গুলিবিদ্ধ অনেকে এখনো বেঁচে আছেন। স্থানীয়রা গণহত্যায় শহীদদের কয়েকটি গণকবরে সমাহিত করে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ওয়াহেদ হাওলাদার বাড়ি গণকবর। নামসহ এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। শহীদদের স্মরণে তালতলী বাজারে তালিকা সম্বলিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।
চরবাড়িয়া গণহত্যায় শহীদ ৪৭ জন গ্রামবাসী হলেন— ইমাম উদ্দিন হাওলাদার (৯০) (পিতা সেফের উদ্দিন হাওলাদার, চরবাড়িয়া; কৃষক), মুন্সী আলী আজিম খান (৬৫) (পিতা নবী খান, সাপানিয়া; ইমাম), আব্দুর রহমান খান (৪৫) (পিতা আলী আজিম খান, চরবাড়িয়া; কৃষক), জবান আলী হাওলাদার (৫০) (পিতা নঈম উদ্দিন হাওলাদার, চরবাড়িয়া; চাকরি), মো. জালাল উদ্দিন হাওলাদার (৫৪) (পিতা ফয়জদ্দিন হাওলাদার, চরবাড়িয়া; চাকরি), লালবরু বেগম (৪৯) (স্বামী জালাল উদ্দিন হাওলাদার, চরবাড়িয়া; গৃহিণী), মোছা. রাহিমা বেগম (২২) (স্বামী আব্দুল জব্বার হাওলাদার, চরবাড়িয়া; গৃহিণী), মোসা. চানবরু (৩০) (স্বামী আবদুস ছত্তার হাওলাদার, চরবাড়িয়া; গৃহিণী), বাচ্চু (১০) (পিতা আবদুস ছত্তার হাওলাদার, চরবাড়িয়া), মো. আব্দুল ওহাব (৩৫) (পিতা হাতেম আলী হাওলাদার, চরবাড়িয়া; চাকরি), পলাশ (বয়স ৮ মাস ৮ দিন) (পিতা এডভোকেট আব্দুর রশিদ হাওলাদার, চরবাড়িয়া), আবুল ফজল রাড়ী (২৫) (পিতা জয়নাল আবেদীন রাড়ী, চরবাড়িয়া; গৃহস্থালি), ময়না বিবি (১৬) (স্বামী আবদুল ওহাব খান, চরবাড়িয়া; গৃহিণী), মুজাহার আলী হাওলাদার (২৭) (পিতা নুর মোহাম্মদ খান, চরবাড়িয়া; চাকরি), হাসান আলী হাওলাদার (৩৫) (পিতা জিন্নাত আলী হাওলাদার, চরবাড়িয়া; কৃষক), ফজলে আলী হাওলাদার (২৫) (পিতা আবদুল লতিফ হাওলাদার, চরবাড়িয়া; কৃষি), আবদুস ছত্তার রাড়ী (৪৫) (পিতা আবদুল আজিজ রাড়ী, চরবাড়িয়া; শ্রমিক), আলফোন্নেছা (৫৫) (স্বামী আবদুল আজিজ রাড়ী, চরবাড়িয়া; বৃদ্ধ), আব্দুল ওয়াহেদ হাওলাদার (৩৫) (পিতা ছবেদ আলী হাওলাদার, চরবাড়িয়া; কৃষক), এসহাক হাওলাদার (২৫) (চরবাড়িয়া; শ্রমিক), রিজিয়া বেগম (২২) (স্বামী এসাহাক হাওলাদার, চরবাড়িয়া; গৃহিণী), হুমায়ুন রাড়ী (২) (পিতা হোচেন উদ্দিন হাওলাদার, চরবাড়িয়া), মোসা. আঞ্জুমান নেছা (৪৯) (স্বামী হোসেন উদ্দিন হাওলাদার, চরবাড়িয়া; গৃহিণী), আব্দুল আজিজ হাওলাদার (৩৮) (পিতা ওফাজ উদ্দিন হাওলাদার, চরবাড়িয়া; কৃষক), আবুল কালাম (বয়স ১ বছর ৬ মাস) (পিতা আয়নাল আবেদীন হাওলাদার, চরবাড়িয়া), সেতারা বেগম (২২) (স্বামী মনসুর ফকির, চরবাড়িয়া; গৃহিণী), সাফিয়া বেগম (১৬) (পিতা আরজ আলী, চরবাড়িয়া), জবেদ আলী (৪০) (পিতা আদম আলী, চরআইচা, শায়েস্তাবাদ; নৌকার মাঝি), আব্দুল ওয়াজেদ হাওলাদার (১৫) (পিতা আবদুল মজিদ হাওলাদার, সাপানিয়া; শ্রমিক), চান শরিফ (৫৫) (পিতা নীল শরিফ, সাপানিয়া, বরিশাল; কৃষক), মো. আব্দুল বারী (৪০) (পিতা আক্রাম আলী হাওলাদার, উলালঘুনী; চাকরি), মো. আতাহার আলী হাওলাদার (২৫) (পিতা হাশেম আলী হাওলাদার, চর উলালঘুনী; ী; কৃষক), মো. সুলতান হাওলাদার (২৮) (পিতা আব্দুল গনি হাওলাদার, চর উলালঘুনী; কৃষক), মো. শাহজাহান মীর (২৫) (পিতা খোরশেদ মীর, চরবাড়িয়া; শ্রমিক), মতলেব আলী খান (২২) (পিতা সরুব আলী খান, চরবাড়িয়া; চাকরি), নয়ন হাওলাদার (১২) (পিতা জাফরআলী হাওলাদার, বাঢ়ী মহল; ছাত্র) এ এফ এম আলী আকবর (৪২) (পিতা আবদুল মজিদ মিয়া, বাইতুল আকবর, আমানতগঞ্জ; চাকরি), ছফুরজান বিবি (৫০) (স্বামী গহের আলী মীর, চরবাড়িয়া), কাবিল খান (৫০) (কর্ণকাঠী; শ্রমিক), আনসার কমান্ডার আব্দুল রশীদ হাওলাদার (৩০) (পিতা আফতাব উদ্দিন হাওলাদার, খালেদাবাদ, নুরিয়া স্কুলের পূর্বদিকে গাজীবাড়ি, আলেকান্দা), সেনাসদস্য মো. আনোয়ার হোসেন (২৫) (পিতা এন্তাজ উদ্দিন, হোসনাবাদ, চরবাড়িয়া), আব্দুল মালেক গাজী (৫০) (পিতা রত্তন গাজী, উলালঘুনী, চরবাড়িয়া), রকমত আলী (৪০) (পিতা আবদুল জব্বার হাওলাদার, পুরানপাড়া, চরবাড়িয়া; কৃষক), মো. জালাল আহমেদ (২০) (পিতা আব্দুস সত্তার হাওলাদার, কাগাশুরা, চরবাড়িয়া; শ্রমিক), জামাল (বয়স ২ বছর ৬ মাস) (পিতা হাসমত আলী, চরবাড়িয়া), ইপিআর সদস্য মোতালেব হাওলাদার (৪০) (পিতা আদম আলী হাওলাদার, মতাসার) ও কাজেম আলী (৩৫) (কেয়াজংগী, চরবাড়িয়া; শ্রমিক)। [লুলু আল মারজান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড