You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে চরভদ্রাসন উপজেলা (ফরিদপুর)

চরভদ্রাসন উপজেলা (ফরিদপুর) পদ্মার চরে অবস্থিত জেলার ক্ষুদ্রতম উপজেলা। ‘ভদ্র’ নামে একটি সম্প্রদায়ের ব্যাপক বসতি ছিল বলে এর নাম হয়েছে ‘চরভদ্রাসন’। চরাঞ্চল হলেও বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে সকল জাতীয় আন্দোলন-সংগ্রামে এখানকার জনগণের অংশগ্রহণ ছিল। ভাষা-আন্দোলনে আবদুস সাত্তার খান সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান- এবং সত্তরের নির্বাচনও এখানকার মানুষকে জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত করে। সত্তরের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে ফরিদপুর-৩ আসনে (চরভদ্রাসন-কোতোয়ালি-নগরকান্দা) <আওয়ামী লীগ প্রার্থী কে এম ওবায়দুর রহমান (আওয়ামী লীগের সমাজসেবা সম্পাদক) এবং ফরিদপুর-৪ আসনে (ভাঙ্গা-সদরপুর-চরভদ্রাসন) শামসুদ্দিন মোল্লা বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। ফরিদপুরে উভয় পরিষদের সবকটি আসনেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিজয়ী হন এবং সারা দেশে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হয়। এর ফলে অন্যান্য এলাকার মতো এ এলাকার জনগণও একটি সুন্দর আগামী দিনের অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি সামরিক শাসক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এর ফলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ থেকে অহসযোগ আন্দোলন চলতে থাকে। ৭ই মার্চ ফরিদপুরের অম্বিকা ময়দানে আওয়ামী লীগের এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট আদেলউদ্দিন আহমেদ এমএনএ-র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় বক্তৃতা করেন কে এম ওবায়দুর রহমান এমএনএ, শামসুদ্দিন মোল্লা এমএনএ, ইমামউদ্দিন আহমেদ এমপিএ, সৈয়দ হায়দার হোসেন এমপিএ, মোশাররফ হোসেন এমপিএ প্রমুখ। ছাত্রলীগ এর নেতা-কর্মীরা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে সভায় আসেন এবং সভামঞ্চে পতাকা উত্তোলন করেন। তাদের কণ্ঠে স্লোগান ছিল, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘মরতে হয় মরব, স্বাধীন বাংলা গড়ব’ ইত্যাদি। এদিন সন্ধ্যায় বিবিসি-তে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের খবর শুনে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ- মিছিল বের করে। মিছিলের স্লোগান ছিল, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কিছু, মানি না মানব না। এ আন্দোলন প্রতিটি থানা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। জেলা থেকে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়।
২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হওয়ার পর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুস সাত্তার খানকে সভাপতি এবং গঞ্জর আলী মোল্লাকে সাধারণ সম্পাদক করে থানা মুক্তিসংগ্রাম একশন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য ছিলেন মৌলবী আবদুল জব্বার, হাজী সলেমান শিকদার, ডা. প্রফুল্ল কুমার বিশ্বাস প্রমুখ। মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা-খাওয়াসহ এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ছিল এ কমিটির ওপর। কমিটির নেতৃত্বে ২৬শে মার্চের পর চরভদ্রাসন হাইস্কুল মাঠে ছাত্র-যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। এখানে প্রশিক্ষক ছিলেন সাবেক সেনাসদস্য জালালউদ্দিন আহমেদ। তাঁর নেতৃত্বে রাজাকার- ও মুজাহিদদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে এনে চরভদ্রাসন থানা মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়। পরবর্তীকালে এ বাহিনী জালাল বাহিনী নামে পরিচিতি লাভ করে। আবদুস সাত্তার খান ছিলেন এর মূল পরিচালক ও ব্যবস্থাপক। নৌবাহিনীর সাবেক সদস্য হাবিবুর রহমান ফরমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল হাজীগঞ্জে এসে অবস্থান নেয়। এ দলটি ফরমান বাহিনী নামে পরিচিত ছিল।
২৯শে মার্চ ফরিদপুরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও সমন্বয়ের জন্য যে জেলা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়, তার আহ্বায়ক ছিলেন কে এম ওবায়দুর রহমান এমএনএ। ২১শে এপ্রিল ফরিদপুর পতনের পর তিনি মুজিবনগরে চলে যান এবং সেখান থেকে ভারতের চাকুলিয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পলিটিক্যাল মোটিভেটর হিসেবে কাজ করেন। তিনি দক্ষিণ-পশ্চিম (প্রশাসনিক) অঞ্চল-২ এবং মুজিবনগর সরকারের শিল্প ও সংস্কৃতি বিভাগের সদস্য ছিলেন।
ইমামউদ্দিন আহমেদ এমপিএ ভারতের কল্যাণীতে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা ইয়ুথ ক্যাম্পের অন্যতম পরিচালক ছিলেন। এছাড়া তিনি ৮ নং সেক্টরের অধীনে মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা এবং তাঁদের উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় জালালউদ্দিন আহমেদ ছিলেন থানা কমান্ডার এবং হাবিবুর রহমান ফরমান ছিলেন ফরমান বাহিনীর কমান্ডার।
২১শে এপ্রিল সকালে পাকবাহিনী গোয়ালন্দ থেকে গাড়িবহর নিয়ে রাস্তার দুপাশে সেলিং করতে-করতে বিনা বাধায় ফরিদপুর শহরে প্রবেশ করে। তারপর তারা চরভদ্রাসনে প্রবেশ করে এবং হাজীগঞ্জস্থ চরভদ্রাসন থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। তবে এ ক্যাম্পে সাধারণত পাক মিলিশিয়া, রাজাকার ও পুলিশ বাহিনী থাকত।
স্থানীয় জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ-এর সমর্থকরা হানাদারদের সহায়তা করত। এডভোকেট আবদুল হাই চৌধুরী মোক্তার (চরভদ্রাসন)-কে সভাপতি করে উপজেলা শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যদের মধ্যে আবদুল হাই খান (চরহরিরামপুর), আবদুস সামাদ মৃধা (চরভদ্রাসন), সোরহাব উদ্দিন প্রামাণিক (গাজীরটেক), আবদুল মজিদ মোল্লা (পিতা আখিলউদ্দিন মোল্লা, চরভদ্রাসন), মোয়াজ্জেম হোসেন মৃধা (চরভদ্রাসন), বাবুল্লা মৃধা (চরভদ্রাসন), ইদ্রিস আলী (চরভদ্রাসন), সোহরাবউদ্দিন আহমেদ (চরহাজিগঞ্জ) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এরা সকলে পেশায় ছিল কৃষক। রাজাকার বাহিনীতে যারা ছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেলোয়ার হোসেন (পিতা পাঁচু খাঁ, চরহাজিগঞ্জ; কমান্ডার), সামসুল হক খান (চরভদ্রাসন), বাদশাহ (চরহাজিগঞ্জ) প্রমুখ। এরাও পেশায় কৃষক ছিল বাদশাহ রাজাকার পরে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়।
উপজেলায় বৈদ্যডাঙ্গী ও ভাংগীডাঙ্গী পাশাপাশি দুটি গ্রাম। দুটি গ্রামই ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। এপ্রিল/মে মাসে পাকসেনারা গ্রামদুটিতে হামলা চালিয়ে দুশতাধিক নিরীহ মানুষকে হত্যা করে, যা বৈদ্যডাঙ্গী-ভাংগীডাঙ্গী গণহত্যা নামে পরিচিত নিহতদের নদীর ধারে গণকবর দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ফসলি জমি হওয়ায় চাষবাষের কারণে সেই গণকবরের কোনো চিহ্ন আর নেই। সেদিন গ্রামদুটিতে অনেক নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন।
উপজেলায় পাকবাহিনীর স্থায়ী কোনো নির্যাতনকেন্দ্র বা বন্দিশিবির ছিল না। এজন্য তারা গজারিয়া ক্যাম্প ও ফরিদপুর ক্যাম্প ব্যবহার করত।
উপজেলায় পাক মিলিশিয়া, রাজাকার ও পুলিশের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি যুদ্ধ হয়। সেটি হলো চরভদ্রাসন থানা যুদ্ধ। নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে কমান্ডার জালালউদ্দিন আহমেদ ও আবু সাঈদ খানের (ঢাকা জেলার দোহার থানার গ্রুপ কমান্ডার)-এর নেতৃত্বে ৭০-৭৫ জন মুক্তিযোদ্ধা থানায় অবস্থিত পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এখানে তখন ৬০-৭০ জন হানাদার উপস্থিত ছিল। সন্ধ্যা ৭টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা একটি এলএমজি, স্টেনগান ও রাইফেল নিয়ে তিন দিক থেকে আক্রমণ করেন। সারারাত গুলি বিনিময় হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে হানাদারদের একাংশ ‘সারেন্ডার সারেন্ডার’ বলে কৌশলে পালিয়ে যায় এবং অবশিষ্টরা সকালে আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা এখান থেকে ৩০টি রাইফেল ও বেশকিছু গোলাবারুদ হস্তগত করেন এবং থানায় ক্যাম্প স্থাপন করেন। থানাযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পাকসেনা ও মিলিশিয়ারা সর্দারের ডাঙ্গায় বহু বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। নভেম্বর মাসের শেষদিকে সদরপুরের আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ২০-২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা হাজীগঞ্জে এসে অবস্থান নেন। ১৫ই নভেম্বর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- রফিকুদ্দিন মোল্লা হাবিব (পিতা সাদেক মোল্লা, গোপালপুর; ইপিআর সদস্য, ২৬শে মার্চ সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), মো. আব্দুর রশীদ মোল্লা (সুলতানপুর; সেনাসদস্য, কুমিল্লার ময়নামতিতে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ) এবং ইউনুছ (পিতা হাফিজুর রহমান)। [নাজমুল কবির মুনির]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!