You dont have javascript enabled! Please enable it! চণ্ডীদ্বার গণহত্যা (কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) - সংগ্রামের নোটবুক

চণ্ডীদ্বার গণহত্যা (কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া)

চণ্ডীদ্বার গণহত্যা (কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) সংঘটিত হয় জুন মাসের শেষদিকে। এতে কয়েকশ নারী, পুরুষ ও শিশু হত্যার শিকার হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাধীন কসবা থানার উত্তর-পূর্ব দিকে আগরতলা সীমান্তের কাছাকাছি গোপীনাথপুর ইউনিয়নের নিভৃত পল্লীগ্রাম চণ্ডীদ্বার। আখাউড়া থেকে রেলে কুমিল্লা যাবার পথে ইমামবাড়ি স্টেশনের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে গ্রামটির অবস্থান। একাত্তরে এ গ্রামটিতে চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের নির্মম তাণ্ডব। দিনের পর দিন এখানে নারীনির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড ঘটে।
সারাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে, তখন বহুলোক এদিক দিয়ে ভারতের ত্রিপুরায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। জুন মাসের শেষদিকে একদিন ভৈরব ও নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শতাধিক নারী-পুরুষ প্রাণের ভয়ে পালিয়ে এসে চণ্ডীদ্বার ও হরিয়াবহ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তখন রাত হয়ে যাওয়ায় এবং এলাকাটি শত্রুমুক্ত থাকায় স্থানীয় লোকজনের পরামর্শে তারা গ্রামের একটি বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়। ২২শে জুন সকালে ভারতে যাবার পথে রাজাকাররা তাদের ওপর আক্রমণ করে। রাজাকারদের এলোপাতাড়ি আক্রমণে অনেকেই আহত হয়। কেউ-কেউ পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও তাদের মধ্য থেকে অন্তত ২৫ জনকে বন্দি করে রাজাকাররা কসবায় পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে কয়েক দিন বন্দি রাখার পর তাদের হত্যা করে মাটিচাপা দেয়া হয়। নারীদের ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন।
জুন মাসের শেষদিকেই আরেকদিন নবীনগর, রামচন্দ্রপুর ও নরসিংদীর শতাধিক নারী-পুরুষ ভারতের আগরতলায় যাবার পথে কসবা থানার শিমরাইল গ্রামের দুর্গাচরণের বাড়ি এবং চণ্ডীদ্বার গ্রামে আশ্রয় নেয়। শিমরাইলের বিমলসহ তিনজন যুবক তাদের সাহায্যকারী ছিল। নৌকাযোগে বাদৈর-হাতনির বিল দিয়ে অগ্রসর হয়ে তারা সিনাই নদীর তীরে এসে নামে। তখন মধ্যরাত। আগের দিন বিকেলেও একদল লোক এসে গ্রামের একটি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিল। আবহাওয়া ভালো ছিল না। শরণার্থীরা খুবই ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত এবং উদ্বিগ্ন। ছোট শিশুদের কান্না আর ক্ষুধার যন্ত্রণায় সকলেই অস্থির। রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে। কেউ-কেউ রওয়ানা দিয়েছে। কেউ- কেউ রওনা দেয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। এরই মধ্যে কসবার টি আলীর বাড়িতে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের কাছে শরণার্থীদের অবস্থান সম্পর্কে খবর পৌছে যায়। স্থানীয় রাজাকাররা রাতেই এ খবর পৌঁছে দেয়। সকালের মধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা এসে অতর্কিতে শরণার্থীদের ওপর হামলা করে। প্রথমে তারা টাকা-পয়সা ও স্বর্ণালংকার লুট করে। তারপর শুরু করে বেয়নেট চার্জ। নারীদের ওপর চালায় পাশবিক অত্যাচার। প্রাণে বাঁচার জন্য সকলেই দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে হাহাকার আর নারী-পুরুষ ও শিশুদের আর্ত চিৎকার। পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের মানুষও প্রাণভয়ে গ্রাম ছাড়ে পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু অনেকেই পালাতে পারেনি। গুলির শব্দে সারা এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এলাকাটি বিরান ভূমিতে পরিণত হয়। শিশু ও নারীদের ওপর এ আক্রমণ ছিল এক বর্বর ঘটনা।
বিমলের দলটিতে ৭২ জন নারী-পুরুষ ও শিশু ছিল। লাতুয়ামুড়ায় তারা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনীর আগমন টের পেয়েই তারা ভারতের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল। কিন্তু গ্রামের পাশেই তারা হত্যার শিকার হয়। চণ্ডীদ্বার স্কুলে তখনো কিছু শরণার্থী ছিল। দরজা-জানালা লাগিয়ে তারা আত্মগোপন করতে চেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী ঘরের দরজা ভেঙে টেনে-হিঁচড়ে বেয়নেট চার্জ করে নির্মমভাবে তাদের সকলকে হত্যা করে। চণ্ডীদ্বার বাজার ও সিনাই নদীর তীরে শতশত লাশ পড়ে থাকে। [জয়দুল হোসেন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড