You dont have javascript enabled! Please enable it!

চন্দনদিয়া যুদ্ধ (শিবপুর, নরসিংদী)

চন্দনদিয়া যুদ্ধ (শিবপুর, নরসিংদী) ২৬শে সেপ্টেম্বর সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এ-যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত এবং ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
শিবপুর উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল, যা দ্বিতীয় আগরতলা নামে খ্যাত ছিল। ফলে পাকিস্তানি সেনারা শিবপুরে তাদের শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি। শিবপুর থানায় পাকিস্তানি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর, -রাজাকার ও আলবদরদের সংখ্যাও কম ছিল না। অল্পদিনের জন্য পাকিস্তানি সেনারা দুবার শিবপুর থানায় অবস্থান নেয়। তারা সড়ক পথে নরসিংদী সদরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ক্যাম্প থেকে শিবপুর পুটিয়া বাজার ক্যাম্পে যাতায়াত করত।
শিবপুর থানার গেরিলা ইউনিট কমান্ডার পুবেরগাঁও গ্রামের আব্দুল মান্নান খান হানাদার বাহিনীকে টার্গেট করেন। পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের জন্য তিনি তাঁর গ্রুপের প্রায় ৯০ জনেরও অধিক মুক্তিযোদ্ধাকে ৩টি গ্রুপে ভাগ করেন। ২৫শে সেপ্টেম্বর রাতে শাসপুর গ্রামে জেলা কাউন্সিলের রাস্তার উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম পাশে ৩টি গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা এম্বুশ করে অবস্থান নেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য মজনু মৃধার কমান্ডে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা চন্দনদিয়া গ্রামের দক্ষিণে মেঘনার শাখা নদী কলাগাছিয়া নদীর ব্রিজের কাছে এম্বুশ নিয়ে পাহারারত থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের এম্বুশ করে অবস্থান নেয়ার কাথা পাকিস্তানি সৈন্যরা জানতে পেরে পুটিয়া ক্যাম্পে যাতায়াত বন্ধ করে দেয়। এরপর কমান্ডার আব্দুল মান্নান খানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কলাগাছিয়া নদী পার হয়ে পূর্ব পাড়ে এম্বুশ করে অবস্থান নেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন করে এম্বুশের কথা জানতে পেরে কলাগাছিয়া নদীপথে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের পরিকল্পনা করে। হানাদার বাহিনীর গুলির আওয়াজ পেয়ে আব্দুল মান্নান খান তাঁর সহযোদ্ধাদের গুলি করতে-করতে চন্দনদিয়া ব্রিজের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন। অপরদিকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য মজনু মৃধার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা চন্দনদিয়া ব্রিজের সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন। ২৬শে সেপ্টেম্বর সকালে পাকিস্তানি সৈন্যদের চন্দনদিয়া ব্রিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখামাত্রই তাঁরা গুলি ছোড়েন। পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাল্টা গুলি ছুড়লে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। কামন্ডার আব্দুল মান্নান খান এবং মজনু মৃধার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড বেগে আক্রমণ হানতে থাকেন। প্রায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলে। এক পর্যায়ে উভয় পক্ষ এতটা কাছে চলে আসে যে, হাতাহাতি যুদ্ধ হওয়ার মতো। কমান্ডার মজনু মৃধাকে লক্ষ করে একজন পাকিস্তানি সৈন্য গুলি চালাতে উদ্যত হলে আমজাদ হোসেন নামে আরেক দুঃসাহসিক মুক্তিযোদ্ধা ঐ পাকিস্তানি সৈন্যকে লক্ষ করে গুলি ছোড়েন। পাকিস্তানি সেনাটি গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মজনু মৃধা প্রাণে বেঁচে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই শত্রুপক্ষের একটি গুলি আমজাদ হোসেনের শরীরে বিদ্ধ হয়। ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের আঘাতে বহুসংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলিবর্ষণ বন্ধ করে দেয়। তারা কৌশল পরিবর্তন করে কিছুক্ষণ পর পেছন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ করে মর্টার শেল নিক্ষেপ করে। মর্টার শেলের স্প্লিন্টার রায়পুরা উপজেলার খাগচর গ্রামের বিধ্বা মায়ের একমাত্র ছেলে রায়পুরা হাইস্কুলের ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা মো. ইদ্রিস আলীর শরীরে লাগে। সেখানেই তিনি শাহাদৎ বরণ করেন। মর্টার শেলের আরেকটি স্প্লিন্টারের আঘাতে নরসিংদী কলেজের বিজ্ঞান শাখার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আব্দুল মোতালিব মানিক (চান্দারটেক) শহীদ হন। দুজন শহীদ এবং একজন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে যোশর বাজার ক্যাম্পে চলে আসেন। চন্দনদিয়া যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কামরাব গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মো. নজরুল ইসলাম বিজয়ের আনন্দে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে না গিয়ে চন্দনদিয়া গ্রামের একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন। পরিশ্রান্ত থাকায় তিনি বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। চন্দনদিয়ায় বহু সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হওয়ার সংবাদ পেয়ে নরসিংদী ক্যাম্প থেকে আরো অনেক পাকিস্তানি সৈন্য চন্দনদিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে এসে পৌঁছায়। তারা ঘটনাস্থলের আশপাশের গ্রামে নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। অনেক নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এখানে এক বাড়িতে তারা রাইফেলসহ মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলামকে ধরে ফেলে। দীর্ঘদিন নির্যাতনের পর নজরুল ইসলাম ঘটনাচক্রে হানাদারদের হাত থেকে মুক্তি পান।
যুদ্ধ শেষে চন্দনদিয়া ধানক্ষেত থেকে নিহত পাকিস্তানি সৈন্যদের লাশ সংগ্রহ করে হানাদাররা গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। একদিনে সমস্ত লাশ নিয়ে যেতে না পারায় পরের দিন হেলিকপ্টারে করে বাকি সেনাদের লাশ নিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে শহীদ দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে যোশর বাজারে গার্ড অব অনার দিয়ে দাফন করা হয়। [রীতা ভৌমিক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!